অনিন্দ্য সুন্দর হাইওয়ে, চারদিকে সারিবদ্ধ গাছপালা, দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া পড়ন্ত সূর্যের আলোর হালকা লালচে আভা, আর রাজসিক গাড়িতে সওয়ার হয়ে মৃদুমন্দ হাওয়ার বুক চিরে ছুটে চলা – এই স্বপ্নাতুর অভিজ্ঞতা যাকে একবার ছুঁয়েছে, স্বর্গীয় সে অনুভূতি তাকে বারবার সে স্বাদ পেতে উদগ্রীব করবেই। একটা নিজস্ব গাড়ির স্বপ্ন থাকে প্রতিটা মানুষেরই, সে স্বপ্ন মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। বাংলাদেশে নিজস্ব গাড়ির ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নাম টয়োটা। আর এমন রাজসিকতায় রীতিমতো অতুলনীয় মর্যাদায় আসীন গাড়িটির নাম করোলা।
১৯৫০-এর দশকের শেষদিকের কথা, জাপানের অর্থনীতি তখন মাত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। অর্থনীতি ও অবকাঠামো বিনির্মাণের লক্ষ্যে নেমে শুরুতেই এর নির্মাতারা ঠিক করলেন, প্রতিটি পরিবারের হাতে একটি ফ্যামিলি কারের চাবি তুলে দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে শুরু হলো মহাযজ্ঞ, অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে দুর্দান্ত সব গাড়ি তৈরি করতে শুরু করল টয়োটা। পারফর্মেন্সই নিজের হয়ে কথা বলতে শুরু করল, জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তাই খুব বেশিদিন তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৬৪ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের পর আরও সহজলভ্য হয়ে ওঠে মোটরযানগুলো, উন্মোচিত হয় সম্ভাবনাময় এক বিশাল ক্ষেত্র। আর সেই সম্ভাবনাকে লুফে নিয়েই এগিয়ে আসে টয়োটা, লক্ষ্য একটি পরিপূর্ণ ফ্যামিলি কার তৈরি করা।
শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়, ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু হলো ‘টয়োটা করোলা’ মোটরগাড়ির। কে জানত সেদিন, এই গাড়িই একদিন গোটা বিশ্বের মোটরযানের ইতিহাস এলোমেলো করে দিতে পারবে! আজ প্রতি ২৩ সেকেন্ডে একটি করোলা গাড়ি তৈরি হয়, প্রতি ৩৬ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে অন্তত একটি করোলা গাড়ি বিক্রি হয়। এতটাই এর জনপ্রিয়তা! মোটরগাড়ি কেনার কথা উঠলেই অবধারিতভাবেই প্রথম সারিতে উচ্চারিত হয় এই গাড়িটির কথা।
তাতসুয়ো হাসেগাওয়া ছিলেন বিমান প্রকৌশলী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বিমানের ডিজাইন করতেন। করোলা গাড়ির প্রেস রিলিজের পর তিনি যখন দায়িত্ব বুঝে পেলেন, তখন তিনি গাড়িটির তৎকালীন ধারণাতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এলেন অ্যারোডাইনামিক্সের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে। চলতি সব গাড়ি থেকে ক্রেতাদেরকে সামান্য ভালো পারফর্মেন্স দিতে চাওয়া তাতসুয়ো যে নিজের অজান্তেই এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন মোটরযান ইতিহাসে, সেটা হয়তো তখনও তিনি ভাবতেই পারেননি।
আশির দশকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রসার ঘটতে শুরু করে এ ব্র্যান্ডের, কালের বিবর্তনে তা এখন একচেটিয়া ব্যবসা করছে বাংলাদেশের গাড়িবাজারে। ২০০১ সাল থেকে অ্যালিয়ন কিংবা প্রিমিও গাড়িগুলোর বিশালকায় দর্শন, ঐচ্ছিক পুশ-স্টার্ট এবং উড ট্রিম বৈশিষ্ট্যের কারণে করোলার যেন কিছুটা চাহিদা পড়তির দিকে চলে যেতে শুরু করেছিল। করোলা’র লিগ্যাসি ধরে রাখার জন্য এমন কিছু একটা প্রয়োজন ছিল, যা বাজারে অ্যালিয়ন কিংবা প্রিমিও’র সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। আর এখানেই করোলা অলটিসের প্রবেশ, যা বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপিয়ে দিয়েছে গত কয়েক বছর ধরে বেশ শক্তপোক্ত জায়গা করে নেওয়া গাড়িগুলোর বর্তমান অবস্থান।
করোলার জনপ্রিয়তার পেছনে ‘ফ্যামিলি কার’ কনসেপ্টটির গুরুত্ব নেহায়েত কম নয়। ঘরের সোফার মতো সিট, কালার টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, কমপ্যাক্ট গাড়ি হওয়া সত্ত্বেও উঁচু ছাদ– গাড়িটাকেই একটুকরো বাসা করে তোলার মতো দারুণ একটা ব্যাপার জাপানে প্রথমবারের মতো নিয়ে আসার পরই বদলে গিয়েছিল টয়োটার হালচাল। তখনকার সেই চারাগাছ কালের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছে মহীরূহ, আর সেই মহীরূহে নবতম পুষ্পের নাম ২০১৮ টয়োটা করোলা আলটিস।
যা কিছু নতুন
অ্যালিয়ন কিংবা প্রিমিও’র মতো গাড়িগুলো যদি আপনি বিশালত্বের জন্য পছন্দ করে থাকেন, তবে আলটিস আপনার মন কেড়ে নিতে প্রস্তুত। বর্তমানে বাজারে প্রচলিত অ্যালিয়ন বা প্রিমিও থেকে প্রায় তিন ইঞ্চি চওড়া এবং এক ইঞ্চিরও বেশি লম্বা এই গাড়িটি উচ্চতার দিক থেকেও প্রায় সমান, বড়জোর এক-আধ ইঞ্চি কম হতে পারে। এর অর্থ হলো, গাড়িটির ইন্টেরিয়র জায়গা যথেষ্ট এবং স্বাচ্ছন্দ্যকর। আরামদায়ক সিট হওয়াতে গাড়িটির পেছনের সিটে বসে আরামসে ভ্রমণ করতে পারবেন যাত্রীরা, যথেষ্ট জায়গার সংকুলানের কারণে দমবন্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও শূন্যের কোঠায়। যাদের বিরক্তিকর হর্নের আওয়াজ কপাল কুঁচকে দেয় সঙ্গে সঙ্গে, এই গাড়িটি তাদের জন্যও এনে দিয়েছে দারুণ সুসংবাদ। গাড়িটির হর্নের আওয়াজ প্যাঁ-পোঁ শব্দে যাত্রী কিংবা ড্রাইভারের কান ঝালাপালা করে দেবে না, অন্য যেকোনো গাড়ির তুলনায় এর আওয়াজ যথেষ্ট কোমল। গাড়ির ছোট্ট, প্রশান্ত একটা হর্নের শব্দই হয়তো আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই বদলে দিতে পারে! ঢাকার জমজমাট হর্নের রাস্তাঘাটে এই গাড়ি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার যোগ্যতা রাখে বৈকি!
গাড়ির হেডলাইট অনেকক্ষেত্রেই ভ্রু কুঁচকানোর অবকাশ এনে দেয়। হেডলাইট থেকে আলো সরাসরি সামনের গাড়ির ড্রাইভারের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ বিপজ্জনক পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য আলটিসে যোগ করা হয়েছে তীক্ষ্ম, অথচ তীর্যক আলোপ্রদায়ী হেডলাইট। গাড়িটিতে যোগ করা হয়েছে রিয়ার কম্বিনেশন ল্যাম্প, যাতে উপরের সাদা লেন্স এবং নিচের লাল রঙের লেন্সের কারণে চোখের প্রশান্তি ছড়ানো আলো দেয়। গাড়ির পেছনের টেইল লাইটগুলোও বেশ তীক্ষ্ম এবং দারুণ কার্যকর। আর এই প্রজন্মের গাড়িগুলোর মধ্যে ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে কার্যকর এই হেডলাইট ও টেইল লাইট নিঃসন্দেহে গাড়িটিকে এগিয়ে রাখবে অন্য সবার চেয়ে।
দৃষ্টিনন্দন ডিজাইনের এই গাড়িটি কাঠামোগত দিক থেকে প্রায় নিখুঁত, দরজা থেকে শুরু করে গাড়ির ধার- কোথাও কোনো তীক্ষ্মতার চিহ্নমাত্র নেই। গাড়ির সম্মুখ ঢালটি দেখতে যেমন দারুণ, তেমনি উইন্ডশিল্ডটাও বড়। সর্বোপরি, গোটা গাড়ির বিনির্মাণে যত্নের ছাপটা সুস্পষ্ট। গাড়িটা যে করোলা’র চিরায়ত অভিজ্ঞতা থেকেও অসাধারণ কিছুই যাত্রীদেরকে উপহার দিতে চলেছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
ইন্টেরিয়র ডিজাইন
বরাবরই করোলার বৈশিষ্ট্যমূলক গঠনে কাঠকে উপেক্ষা করতে দেখা যায়। কাঠের তুলনায় প্লাস্টিক যথেষ্ট নমনীয় ও স্বাচ্ছন্দ্যকর, বাটনগুলোও ড্রাইভারের সুবিধা অনুযায়ী একদমই সাধারণ ও চিরাচরিত লে-আউটেই করা হয়েছে। গাড়ির এ মডেলে রয়েছে সাতটি এয়ারব্যাগ, এবিএস, ভিএসসি, অটোমেটিক ক্লাইমেট কন্ট্রোল, অটো ফোল্ডিং আয়না, স্টিয়ারিং-নির্ভর কন্ট্রোল, ক্রুজ কন্ট্রোল, পিছনের দিকে স্বাচ্ছন্দ্যকর আর্মরেস্ট এবং ড্রাইভারের সিটসংলগ্ন বৈদ্যুতিক সুসমন্বয়। আপডেটেড এই মডেলে রাখা হয়েছে ফ্রন্ট ও রিয়ার বাম্পার, নতুন করে নকশাকৃত হুইল এবং এলইডি ফগ ল্যাম্পসহ বাই-বিম এলইডি হেডল্যাম্প। আগের গাড়িগুলোর হালকা তামাটে কিংবা ধূসর বর্ণ থেকে বেরিয়ে এসে এই মডেলের ইন্টেরিয়রটাকে করা হয়েছে ডার্ক, যা গাড়ির অভ্যন্তরীণ পরিবেশটাই বদলে দেবে।
গাড়িটিতে ক্লাইমেট কন্ট্রোল ইন্টারফেস-সংলগ্ন তিনটি টোগল সুইচ রয়েছে, যা এর ব্যবহারকে করে তুলেছে সহজতম। বাড়াতে চাইলে উপরে টানুন, কমাতে চাইলে নিচের দিকে; ব্যস, এর চেয়ে সহজ আর কিচ্ছু নেই! এছাড়াও বিশালকায় জানালাগুলো গাড়িতে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হতে দেবে না, বরং এনে দেবে দারুণ প্রশান্ত এক ভ্রমণানুভূতি।
আমাদের দেশে রাস্তাগুলো কিছুটা রুক্ষ এবং এবড়োথেবড়ো হয়ে থাকে সচরাচর, যা কখনো কখনো গাড়ির ভেতরে বসে থাকা যাত্রীদের সময়টাকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। এ কারণে গাড়িটিতে রাখা হয়েছে আকস্মিক উঁচ-নিচ পথের প্রতি অনমনীয়তা এবং উঁচু গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স, যাতে অন্তত ঝাঁকিতে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে না বসে।
যারা গাড়িতে বিনোদনের ব্যাপারটাকে বিন্দুমাত্র হেলাফেলার নজরে দেখেন না, তাদের জন্য রয়েছে দারুণ রেসপন্সিভ টাচস্ক্রিন অডিও সিস্টেম। প্রখর রোদ কিংবা দেখার জন্য একটু দুরূহ কোণসংক্রান্ত কারণে কখনো কখনো ডিসপ্লে মনিটর দেখাটা কিছুটা কঠিন বলে মনে হতে পারে, তবে শব্দের দিক থেকে বিশেষ অভিযোগ করার জায়গা থাকে না।
এই গাড়ির ১.৬ লিটার ডুয়াল ভিভিটি-আই ইঞ্জিনটি ১২০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতায় ৬,০০০ আরপিএম গতিতে ১১৪ পাউন্ড/ফুট টর্ক সরবরাহ করে। মসৃণ, নীরব এবং আশ্চর্যজনক জ্বালানীসাশ্রয়ী এ ইঞ্জিন। ময়লা কিংবা এবড়োথেবড়ো রাস্তাতেও বিস্ময়কর মাইলেজ পাওয়া যায়, ভালো রাস্তায় চালালে সেটাকে আরো বেশ খানিকটা বাড়বে তো বটেই।
শেষ কথা
করোলা শব্দটির অর্থ ফুলের মুকুট। গাড়ির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে করোলা তার নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে এসেছে বরাবরই। হয়তো মিনি বা বিটলের মতো স্নিগ্ধ চেহারা নেই; এসকর্ট কিংবা গলফের মতো আনন্দময় ড্রাইভিং অভিজ্ঞতাও সবসময় দেওয়া সম্ভব হয় না- কিন্তু একঘেঁয়ে সব বৈশিষ্ট্যের পরও করোলার মাথায় এই সুবিন্যস্ত মুকুটের পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ কারণ, নির্ভরতা।
করোলা মূলত জনপ্রিয় এর নির্ভরযোগ্যতা, সাশ্রয়ী ফিচার, কর্মদক্ষতা এবং দারুণ রিসেল রেটের কারণে। গাড়িটি প্রচণ্ড আকর্ষণীয় চেহার না হলেও; তাকে যেটা করতে বলা হয়, সেটা কিন্তু সে ঠিকঠাক করে দিতে বিশেষ পারদর্শী। আর অতিসম্প্রতি যুক্ত হওয়া নিত্যনতুন সব ‘সেফটি কিট’ এবং গাড়ির মধ্যে বিস্তর জায়গা এবার একে করে তুলেছে আরো দারুণ। নতুন হলেও করোলার পূর্বতন অভিজ্ঞতা থেকে বাজি ধরে বলাই যায়, গাড়িটি অন্তত সময় এবং আর্থিক দিক থেকে হতে চলেছে দারুণ টেকসই ও সাশ্রয়ী।
বেশিরভাগ সময়ই ফ্যামিলি গাড়ির ক্ষেত্রে মূল চিন্তার বিষয়টা হয়, “গাড়িটা বড় হবে তো? ফ্যামিলি কার কিনে লাভ কী, যদি সবাই মিলে তাতে চড়তেই না পারলাম!” এই গাড়িটি অন্তত সেদিক থেকে উতরে যাবে। বাংলাদেশের লক্করঝক্কর রাস্তায় অনায়াসে ঘোড়ার মতো ছুটতে সক্ষম এই গাড়ি একই সঙ্গে নিশ্চিত করে দীর্ঘ ওয়ারেন্টি সময় এবং ডিলার সার্ভিস। এছাড়া গাড়িটিতে চুরির হাত থেকে বাঁচার জন্য রয়েছে ‘Anti-theft System with Immobilizer’। এছাড়া টয়োটার গাড়িতে বরাবরই একটা বিষয় খেয়াল রাখা হয়, কাস্টমার যদি কোনোদিন গাড়িটি বিক্রয় করে দিতেও চান কোনো কারণে, তিনি যেন যথেষ্ট ভালো মূল্যটাই পেতে পারেন। বহু বছর চালিয়ে রিসেল করা হলেও যদি মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়, তবে আর কী চাই!
স্পোর্টস কার হিসেবে এটাকে দাবি করা যাবে না সেটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে বরাবরের মতোই এবারও গাড়িটিতে মিলবে যথেষ্ট আয়েশী পরিবেশ। এক্সটেরিয়রের দিকেও সমান নজর রাখার কারণে গাড়িটিতে চড়ার অভিজ্ঞতাও হবে দারুণ, অন্তত পূর্বসূরীদের তুলনায় সেটা নিঃসন্দেহে হতে চলেছে যুগান্তকারী। হয়তো সামনে করোলা স্পোর্টিং গাড়ির দিকেও ঝুঁকবে, হয়তো ঝুঁকবে না। কিন্তু যতদিন অবধি সে দিনটা না আসছে, নিঃসংকোচে দাবি করা যায়, ২০১৮ আলটিস এবার করোলার পুনর্জন্মই ঘটাতে চলেছে গাড়ির বাজারে!