অ্যাডেল এডওয়ার্ডস, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অধিবাসী ৩১ বছর বয়সী এক নারী। পাঁচ সন্তানের জননী অ্যাডেলের এক অদ্ভুত আসক্তি ছিল সোফার কুশনের ভেতর থাকা ফোম খাওয়ার প্রতি। ২১ বছর আগে তার মা-বাবার ডিভোর্সের সময় থেকে তার এই বদভ্যাসের শুরু। এক বছরে সাতটি সোফা খেয়ে শেষ করার ইতিহাসও তার রয়েছে!
ফ্লোরিডারই আরেক অধিবাসী টেম্পেস্ট হেন্ডারসন একজন কলেজছাত্রী। শৈশবে তিনি সাবানের ঘ্রাণ নিতে পছন্দ করতেন। ঘ্রাণের প্রতি এটি তার নিছক ভালো লাগা নয়, একপ্রকার আসক্তিই ছিল বলা চলে। পরবর্তীতে তিনি গুঁড়ো ডিটারজেন্ট খেতে শুরু করেন। তার ভাষ্যমতে, তিনি এর নোনতা, মিষ্টি আর তেতো স্বাদের মিশ্রণ বেশ উপভোগ করেন। সকালে ঘুম থেকে জেগে তার প্রথম কাজই ছিল ডিটারজেন্টের বাক্সে আঙুল ডুবিয়ে এর স্বাদ নেওয়া। এরপর সারাদিনে হাত ধোয়া বা গোসলের সময় তিনি সাবানের স্বাদ নিতেন। তার এই আসক্তি এতটাই তীব্র ছিল যে, সপ্তাহে তিনি পাঁচটি সাবানের বার খেয়ে শেষ করতে পারতেন!
এদিকে ফ্রান্সের অধিবাসী এক ব্যক্তি তো নিজের পেটটাকে যেন আস্ত একটা পিগি ব্যাংকই বানিয়ে নিয়েছিলেন। টানা দশ বছর ধরে তিনি যে পরিমাণ ধাতব মুদ্রা নিজের পেটে চালান করেছেন, তার সর্বমোট মূল্যমান ছিল ৬৫০ ইউএস ডলার! এই মুদ্রাগুলো হজম তো হয়ইনি, উল্টো ঐ ব্যক্তির পেটের ভেতর জমা হয়ে ক্রিকেট বলের মতো একটি দলা তৈরি করেছিল।
এরকম বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস আছে বৃহত্তর ম্যানচেস্টারে বসবাসরত ৫ বছরের বালক জ্যাক তাহিরেরও। মূক, অটিস্টিক এই শিশুটি সারাক্ষণই কিছু চিবানোর প্রয়োজন বোধ করে। কিন্তু তার মানসিক অবস্থার কারণে সে খাদ্য আর অখাদ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। তাই সে তার সামনে কিছু পেলেই তা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে- হোক তা দেয়ালের প্লাস্টার, কার্পেট, সুতা, কাগজ, চুল, পাথর কিংবা মাটি।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কর্ণাটকের এক গ্রামের বাসিন্দা পাকিরাপ্পা হুনাগুন্ডি। ১০ বছর বয়স থেকে এই ব্যক্তি ইট, মাটি ও নুড়ি পাথর খেয়ে আসছিলেন। তার এই আসক্তি এমনই তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে, প্রতিদিনকার স্বাভাবিক খাবার খাওয়া হোক বা না হোক, ইট-পাথর তার খেতেই হতো।
কিন্তু এদের এই বিচিত্র, অস্বাভাবিক এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণ কী? এটি কি কোন রোগ?
না, এ ধরনের বদভ্যাস কোনো রোগ নয়, তবে এটি খাদ্যগ্রহণ সংক্রান্ত এক প্রকার ব্যাধি (Eating Disorder)। এই ব্যাধির নাম ‘পাইকা’ (Pica)।
কী এই পাইকা?
পাইকা বলতে মূলত বোঝায় পুষ্টিগুণবিহীন কোনো বস্তু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা এবং সেই বস্তু ক্রমাগত খেতে থাকা। তবে কারো এই ধরনের অভ্যাসকে পাইকা ডিজঅর্ডার বলে ঘোষণা করতে হলে এই অভ্যাসের স্থায়ীত্বকাল অবশ্যই এক মাসের বেশি হতে হবে।
কীভাবে হলো এই অদ্ভুত নামকরণ?
ম্যাগপাই পাখির ল্যাটিন নাম ‘পাইকা’, যে কিনা সাধারণত কোন বাছবিচার ছাড়াই যেকোনো কিছু খেতে অভ্যস্ত। এর নাম থেকেই ‘পাইকা‘ ব্যাধিটির নামকরণ করা হয়েছে।
পাইকা কাদের হয়?
মূলত শিশুদের দুই-তিন বছর বয়সের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এক থেকে ছয় বছর বয়সী ১০%-৩০% শিশুর মধ্যে পাইকা লক্ষ্য করা গিয়েছে। বয়ঃপ্রাপ্তদের মধ্যে সাধারণত গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে এই ব্যাধি দেখা দিতে পারে।
কারণ
পাইকার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সঙ্গে এর যোগসূত্র পাওয়া যায়।
যেমন-
১) পুষ্টিগুণবিহীন বস্তু খেতে স্বাদ অনুভব করা।
২) শরীরে মিনারেলের (আয়রন বা জিংক) অভাব।
৩) মানসিক সমস্যা যেমন- অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (OCD), অটিজম, স্কিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পাইকার প্রবণতা দেখা দেয়।
৪) অতিরিক্ত ভয়, মানসিক চাপ, মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ, শৈশবে নির্যাতনের শিকার হওয়া।
৫) দারিদ্র্য।
৬) মা-বাবার অবহেলার শিকার শিশুরা তাদের দিকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্যও এমন আচরণ করতে পারে।
৭) অঞ্চলভেদে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রথা হিসেবেও এমন সব বস্তু খাওয়ার রীতি প্রচলিত থাকতে পারে, যা সাধারণত ‘খাবার’ নয়। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য-সুরক্ষার জন্যে চিনামাটি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।
পাইকা কী কী ধরণের বস্তু নিয়ে হতে পারে?
পাইকা ব্যাধিগ্রস্তরা যে কত বিচিত্র ধরনের জিনিস খেতে আগ্রহ বোধ করে, তার একটা তালিকা নিচে দেওয়া হলো-
- ধূলা
- কাদা মাটি
- ছাই
- চক
- দেয়ালের প্লাস্টার ও রঙের আস্তরণ
- পাথর
- সাবান ও ডিটারজেন্ট
- কাগজ
- আঠা
- বোতাম
- চুল
- গায়ে মাখার পাউডার
- বেকিং সোডা
- টুথপেস্ট
- সিগারেটের ছাই ও ফিল্টার
এই তালিকার বাইরে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ আরও নানান কিছু, এমনকি মলমূত্র পর্যন্ত খেতে পারে।
একজন ব্যক্তি কোন বস্তুটি খাচ্ছেন, তার ওপর ভিত্তি করে পাইকার বিভিন্ন নামকরণও করা হয়। যেমন-
- জিওফেজিয়া: কাদা, মাটি, ধুলা ও চক খাওয়া
- হায়ালোফেজিয়া: কাঁচ খাওয়া
- প্যাগোফেজিয়া: বরফ খাওয়া (যখন তা ব্যাধির পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়)
- ট্রাইকোফেজিয়া: চুল এবং উল খাওয়া
- জাইলোফেজিয়া: কাঠ খাওয়া
- কটোপাইরিওফেজিয়া: ব্যবহৃত দেশলাইয়ের কাঠির পোড়ানো অংশ খাওয়া
- অ্যামাইলোফেজিয়া: কর্নস্টার্চ ও পেস্ট খাওয়া
- ইউরোফেজিয়া: মূত্র পান করা
- হেমাটোফেজি: রক্ত পান করা
এসব অখাদ্য খেলে কী কী জটিলতা দেখা দিতে পারে?
অখাদ্য সব বস্তু খাওয়ার ফলে পাইকা ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কোনো উপকার তো হয়ই না, বরং দেখা দিতে পারে নানান শারীরিক জটিলতা।
১) যেসব বস্তু হজমযোগ্য নয়, সেগুলো খাওয়ার ফলে পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া হতে পারে।
২) খেয়ে ফেলা বস্তু হজম না হওয়ার ফলে তা পেটের ভেতর দলা পাকিয়ে বেজোয়ার (Bezoar) তৈরি হতে পারে ও পরিপাকতন্ত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে।
৩) ধারালো বস্তু (যেমন কাঁচ, ধাতব কোনো কিছুর টুকরো) খাওয়ার ফলে পরিপাকতন্ত্র কেটে যেতে বা ফুটো হয়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে নাটালি হেয়রাস্টের কথা উল্লেখ করা যায়, যে মাত্র তিন বছর বয়সে একটি লাইটবাল্ব খেয়ে ফেলায় প্রায় মৃত্যুমুখে পৌঁছে গিয়েছিল।
৪) দেয়াল থেকে রঙের আস্তরণ তুলে খাওয়ার অভ্যাস খুবই মারাত্মক। রঙের মধ্যে থাকা সীসা বা অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ থেকে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা পরবর্তীতে শিশুর মস্তিষ্কে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। এছাড়া স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত সংবহনতন্ত্র ও রেচনতন্ত্রের ওপরেও সীসা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৫) গর্ভাবস্থায় সীসাযুক্ত কোনো কিছু খাওয়ার অভ্যাস গর্ভবতী মা ও তার গর্ভস্থ সন্তান উভয়ের জন্যেই ক্ষতিকারক।
৬) কাদা, মাটি বা দূষিত কিছু খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তার সঙ্গে বিভিন্ন রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করে মারাত্মক সংক্রমণ করতে পারে।
৭) ধারালো বা শক্ত ধরনের বস্তু চিবিয়ে খেতে গিয়ে দাঁত ও মুখ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৮) এ ধরনের খাবার যে কোনো সময় গলায় আটকে যেতে পারে।
৮) এসব অখাদ্য খাওয়ায় ব্যস্ত থাকার কারণে স্বাভাবিক খাবারে অরুচি আসতে পারে এবং শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানসমূহের ঘাটতি হতে পারে।
প্রতিকার
পাইকা ব্যাধি থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য কিছু উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন-
১) শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। শিশুকে খাদ্য এবং অখাদ্যের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।
২) ‘খাবার নয়’ এমন সব বস্তু খেয়ে ফেললে কী কী জটিলতা হতে পারে, তা শিশুকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
৩) যে নির্দিষ্ট বস্তুটি খাওয়ার প্রতি শিশু আসক্ত হয়ে পড়ছে, সেটি তার নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
৪) শিশুর পুষ্টির চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫) শিশু তার আসক্তির বস্তুটি খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখলে তাকে উৎসাহ দিন, প্রশংসা করুন, সম্ভব হলে ছোটখাটো কিছু দিয়ে তাকে পুরষ্কৃত করুন। যদি সে কথা অমান্য করে অভ্যাস চালিয়েই যায়, তাহলে তাকে হালকা শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, তবে উচ্চস্বরে বকাঝকা বা প্রহার করা কখনোই উচিত নয়।
৬) যদি পাইকা চরম আকার ধারণ করে, তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। তিনি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকলে তা খুঁজে বের করবেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেবেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্যও নিতে হতে পারে।
চলুন, আবারও অ্যাডেল এডওয়ার্ডসের পাইকার কাহিনীতে ফিরে যাই। তার পরিপাকতন্ত্রের ভেতর একবার ফোম জমতে জমতে দলা তৈরি হয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে ল্যাক্সেটিভের মাধ্যমে তা অপসারণ করা হলেও চিকিৎসকেরা তাকে সাবধান করেন এই বলে যে, এই ফোম পরিপাকতন্ত্রের ভেতর জমে এমনভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে যে, এর চাপে পরিপাকতন্ত্র ফেটে যেতে পারে। চিকিৎসকেরা অ্যাডেলের শরীরে আয়রনেরও ঘাটতি সনাক্ত করেন। তার আয়রনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি তাকে মানসিক রোগের চিকিৎসাও দেওয়া হয়।
টেম্পেস্টের ব্যাপারে চিকিৎসকেরা বলেন, ডিটারজেন্টের প্রতি তার যে আসক্তি, সেটি থেকে তার খাদ্যনালী, পাকস্থলীসহ পরিপাকতন্ত্রের যেকোনো অংশে ক্ষত হতে পারে। আশার কথা হচ্ছে যে, টেম্পেস্ট তার আসক্তি কাটিয়ে উঠতে উদ্যোগী হয়েছেন।
আর সেই ফরাসি ব্যক্তি, যিনি নিজের পেটকে পিগি ব্যাংক বানিয়ে ফেলেছিলেন, তাকেও তার বদভ্যাসের জটিলতার জন্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি পেটে ব্যথা এবং হজম ও মল ত্যাগে সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। অবশেষে চিকিৎসকগণ পরীক্ষা করে তার পেটের ভেতর ১২ পাউন্ড ওজনের দলাটি আবিষ্কার করেন। সার্জারির মাধ্যমে ঐ দলা অপসারণের সময় শল্যচিকিৎসকগণ তার পেটে সুঁই ও গলার হারও খুঁজে পান।
পাইকার ভুক্তভোগী যাদের কাহিনী আমরা জানলাম, তারা প্রায় প্রত্যেকেই খুব অল্প বয়স থেকে এই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসটির চর্চা করে আসছেন। সাধারণত ছোট শিশুরা না বুঝে আশেপাশের কোনো বস্তু মুখে দিয়ে ফেলাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পুষ্টিগুণবিহীন কোনো অখাদ্যের প্রতি শিশুর অতিরিক্ত আসক্তি থাকা অবশ্যই বিপজ্জনক হতে পারে। তাই শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের ব্যাপারে সচেতন হোন এবংপাইকা ও তৎসংক্রান্ত জটিলতা থেকে শিশুকে মুক্ত রাখুন।