ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি ভারত। চিন্তা-ভাবনা, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে নানা ভাষা, রীতিনীতি, কৃষ্টি সবকিছুতেই ভারত অন্য সব দেশ থেকে অনেক ভিন্ন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে যেমন আধুনিক ভারতকে চেনা যায়, ঠিক তেমনি নানা ধর্মীয় গোঁড়ামি, অদ্ভুত সব রীতিনীতিতেও দেশটি পিছিয়ে নেই। ১৩০ কোটির উপর জনসংখ্যার বহুত্ববাদী দর্শনে সমৃদ্ধ ভারতে ছড়িয়ে থাকা এমনই কিছু রীতিনীতি নিয়ে সাজানো হয়েছে এই লেখাটি।
বিকানের কারণি মাতা মন্দির, যেখানে ইঁদুর-পূজা হয়
রাজস্থানের বিকানের থেকে ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত দেশনোক। আর সেখানেই অবস্থিত এই কারণিমাতা মন্দির। এই মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মন্দিরটির মধ্যে বসবাসরত বিশ হাজারের অধিক ইঁদুর। অনেকেই মন্দিরটিকে ‘ইঁদুরের মন্দির’ হিসেবেও চেনে। চতুর্দশ শতকের হিন্দু সন্ন্যাসিনী কারণি মাতা তার অনুগামীদের কাছে পূজিত হতেন মা দূর্গার অবতার হিসেবে। তার রহস্যময় অন্তর্ধানের পরে তৈরি হয় ছোট্ট এই মন্দিরটি। মন্দিরের কালো ইঁদুর নাকি কারণি মাতার বংশধর, এদের বলে ‘কাব্বাস’। আর সাদা ইঁদুর তো কারণি মাতা স্বয়ং ও তার ছেলেরা!
এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। অনেকে বলেন, কারণি মাতার সৎ ছেলে লক্ষণ কপিল সরোবরে পানি খেতে গিয়ে ডুবে গেলে, মাতা যমরাজকে আহ্বান করেন তার ছেলেকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। যমরাজ লক্ষণ ও কারণি মাতার সব ছেলেকে ইঁদুর হিসেবে পুনর্জন্ম দেন। আবার একটি তথ্য অনুযায়ী, ২০ হাজার সৈনিক কাছাকাছি একটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে দেশনোকে আশ্রয় নেন। যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসার মতো গুরু অপরাধ করা সত্ত্বেও কারণি মাতা তাদের প্রাণ নেননি। বরং, ইঁদুর হিসেবে মন্দিরে থাকার ব্যবস্থা করেন।
এই মন্দিরে ইঁদুরের এঁটো খাওয়া অসম্ভব পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত হয়। প্রতি বছর কারণি মাতা উৎসবের সময়ে এখানে প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। সেসময় যারা সেখানে পুজো দিতে আসেন, তারা ইঁদুরের এঁটো প্রসাদ খেয়ে পুণ্য অর্জন করে থাকেন বলে ভক্তদের বিশ্বাস। এসময় একমাত্র ভাগ্যবান ভক্তরা কালো ছাইরঙা ইঁদুরের ভিড়ে একটি সাদা ইঁদুরকে দেখতে পান। এ অঞ্চলে ইঁদুর মারা অপরাধ মানা হয়। তাই কেউ পারতপক্ষে এখানকার কোনো ইঁদুর মারার কথা ভাবতে পারেন না। যদি কেউ ভুল করেও একটি ইঁদুর মেরে ফেলেন, তাহলে তাকে অনুরূপ সোনার ইঁদুর বানিয়ে দিতে হয়।
সদ্যজাত সন্তানের নামকরণ করা নিষেধ গ্রাম কংথংয়ে
মেঘালয় রাজ্যের একটি ছোট পাহাড়ি গ্রাম কংথং। মেঘের আড়ালে থাকা গ্রামটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। গ্রামের মানুষেরা মূলত ঝাঁটার কাঠির গাছ চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামে মানুষদের পড়াশোনার প্রতি বেশ উৎসাহ রয়েছে, প্রায় প্রতিটি পরিবারের শিশুরা স্কুলে যায়। তবে গ্রামটি অন্য এক কারণে অনন্য হয়ে রয়েছে। বহুকাল থেকেই এখানকার বাসিন্দারা আজব এক রীতি মেনে চলছে। জন্মের পর এখানে সদ্যোজাত শিশুর কোনো নামকরণ করা হয় না।
এই গ্রামের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, প্রত্যেক গ্রামবাসীর নিজস্ব একটা সুর রয়েছে। একটি শিশু জন্মগ্রহণের পর মা নিজেই তার পছন্দের সুরটি শোনান সবাইকে, যার মধ্য দিয়ে পরিচিত হয় শিশুটি। আবার কখনো কখনো আত্মীয় প্রতিবেশীরাও সদ্যজাত সন্তানের মাকে তাদের পছন্দের সুরটি শোনান। মায়ের যে সুরটি পছন্দ হয়, সেটিই হয়ে ওঠে তার সন্তানের পরিচয়।
কংথং গ্রামটিতে প্রত্যেক মানুষের নিজের নামের বদলে জড়িয়ে রয়েছে নিজের একটি সুর, যা একান্তই তার নিজস্ব আর তা অন্য সবার থেকে স্বতন্ত্র। স্থানীয় ভাষার এই সুরকে বলা হয়ে থাকে ‘জিঙ্গরওয়াই লওবেই’।
কংথং-এর পাহাড়ী পরিবেশে নিয়ত শুনতে পাওয়া যায় তাদের সেই সুরগুলো। এই সুর শুনতে অনেকটাই পাখির ডাকের মতো মনে হয়ে থাকে। আর এ কারণেই গ্রামটি ‘হুইসলিং ভিলেজ’ নামেও পরিচিতি লাভ করেছে।
কর্ণাটকের সুব্রমনিয়া মন্দিরে এঁটো পাতের উপর গড়াগড়ি দেয়ার উৎসব
বর্ণ বৈষম্য ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন সমস্যাগুলোর একটি। বর্তমান আর্থিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে এসব প্রথায় কিছুটা পরিবর্তন আসলেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো এর দারুণ প্রতিপত্তি রয়েছে। ভারতের অনেক জায়গায় এখনও প্রবলভাবে মেনে চলা হয় বর্ণভিত্তিক বিভিন্ন অন্ধ কুসংস্কার। তার এক অন্যতম প্রমাণ কর্ণাটকের সুব্রমনিয়া মন্দিরের পালিত হওয়া মদে স্নান নামে এক আজব প্রথা।
এই প্রথাটি বেশ কয়েকশো বছরের পুরনো। এই প্রথা অনুসারে সমাজের উঁচু জাতের ব্রাহ্মণ সমাজের লোকদের খেয়ে উঠে যাওয়ার পর তাদের পড়ে থাকা উচ্ছিষ্টের উপর গড়াগড়ি দেয় সমাজের নিচু জাতের মানুষেরা। এদের অনেকেরই বিশ্বাস, এই কাজটি করলে রোগব্যাধি তাদের কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। ২০১০ সালে কর্ণাটক সরকার এই উৎসব নিষিদ্ধ করে। কিন্তু স্থানীয় লোকেদের প্রবল বিরোধিতার কারণে রাজ্য সরকারকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হয়।
মহারাষ্ট্রে উঁচু স্থান থেকে শিশুকে ছুঁড়ে ফেলা
বিতর্কিত এই প্রথাটি মহারাষ্ট্রের সোলাপুর গ্রামে ঘটে থাকে। এটি গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ পালন করে থাকে। বাবর উমর দরগাহটি এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ এক দরগা। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে, এখানে এসে কেউ কোনো মানত করলে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। সন্তান লাভের আশায় অনেক নিঃসন্তান দম্পতি এখানে এসে প্রার্থনা করে। আবার অনেকে তার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর দীর্ঘ জীবন কামনায় দরগার ওপর থেকে শিশুটিকে ছুঁড়ে ফেলে আর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন চাদর দিয়ে তাকে লুফে নেয়।
এমন ভয়ানক প্রথা নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে মহারাষ্ট্র সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন নানা ব্যবস্থা নিতে চাইলেও স্থানীয় দুই সম্প্রদায়ের জনগণের বিরোধিতার মুখে প্রশাসন পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে স্থানীয়ভাবে প্রশাসন থেকে ঘোষণা করা হয়, কাউকে এই নিয়ম মান্য করার ব্যাপারে জোর করা যাবে না। কাউকে এই প্রথা মানতে বাধ্য করা হলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
মাথায় নারকেল ফাটানো
তামিলনাড়ুর কারুর জেলার মহালক্ষ্মী মন্দিরে তামিল আদি মাসের ১৮ তারিখে এক অদ্ভুত উৎসব পালিত হয়। এদিন মন্দিরে উপস্থিত হয় শত শত মানুষ। মন্দিরের পুরোহিতের কৃপা প্রাপ্তির আশায় মন্দির চত্বরে আগত ভক্তরা সারিবদ্ধ হয়ে বসে পড়ে। পুজো শেষ করে মন্দিরের পুরোহিতরা একে একে ভক্তদের মাথায় নারকেল ফাটানোর চেষ্টা করেন। এখানকার ভক্তদের বিশ্বাস- এ বিষয়টি তাদের জীবনে অপার সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
আবার অনেকে এর পেছনে অন্য এক গল্প রয়েছে বলে জানান। ইংজেরা যখন ভারত শাসন করছিল তখন ইংরেজ প্রশাসন একবার এই মন্দির ভেঙে এই স্থান দিয়ে রেললাইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় জনগণ এর তীব্র আপত্তি জানায়। এই মন্দিরের প্রতি স্থানীয়দের প্রবল আস্থা দেখে ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের ভক্তি পরীক্ষার জন্য এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার আহ্বান করে। যদি ভক্তরা তাদের মাথা দিয়ে পাথর ভাঙতে পারেন, তাহলে এই মন্দির ভাঙা হবে না। অনেকের মতে, সেদিনের সেই পাথর ভাঙা আজ নারকেল ফাটানোয় পরিবর্তিত হয়েছে।
সর্বোপরি, আর একটি অদ্ভুত প্রথা দিয়ে আজকের আয়োজনের ইতি টানবো। ভারতের অনেক পরিবারের মেয়েদের বিয়ের সময় তার কুষ্ঠি বিচার করা হয়। এই কুষ্ঠি হচ্ছে মেয়েটির জন্মতিথি সংক্রান্ত জ্যোতিষীর নানা বিচার-বিশ্লেষণ সংক্রান্ত নথি। এই বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মেয়ের কোনো মঙ্গল দোষ খুঁজে পেলে তাকে ‘মাঙ্গলিক দোষ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই দোষ খণ্ডনের জন্য অনেকে সেই মেয়েকে কোনো পশু বা পাথরের সাথে বিয়ে দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে বিবাহযোগ্যা মেয়েটি মঙ্গল ‘দোষ মুক্ত’ হয়। এই অদ্ভুত প্রথা একবিংশ শতকে এসেও অনেক পরিবারেই মেনে চলেন। অনেক সুপরিচিত ও সুখ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিদের মাঝেও এমন রীতি প্রয়োগের প্রমাণ মেলে।
ফিচার ইমেজ- YouTube.com