ভালো লাগা, ভালো না লাগা। না, কোনো অসুস্থতা বা শরীর খারাপ লাগার কথা বলা হচ্ছে না। আবার মন খারাপের কথাও বলা হচ্ছে না। এই ভালো না লাগা মানে কিছুই ভালো না লাগা; এর সাথে আপনার শরীর, মন, স্ট্যাটাস, অফিসের প্রমোশন, পরীক্ষার রেজাল্টের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা এমনই এক অনুভূতি, যাতে যে কেউ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে।
ধরুন, সামনে আপনার কোনো বড় পরীক্ষা, অথচ আপনার পড়তে ভালো লাগছে না। আবার কারও হয়তো অফিসের কাজের ডেডলাইন আছে, বসের আদেশ সেটা ঠিক পাঁচটার মধ্যে করা চাই। কিন্তু লাঞ্চ টাইম পার হতে চলল- কাজ শুরুই করা হয়নি। করতে ভালো লাগছে না। এই কাজগুলো কিন্তু একা একা সম্পন্ন হয়ে যাবে না, আপনাকেই করতে হবে। কিন্তু এই ‘ভালো লাগছে না’ অনুভূতি থেকে বের হতে পারছেন না। তাহলে সমাধান কী? পরীক্ষা তো দিতে হবে, আবার বসকে কাজও দিতে হবে, তা-ই না?
এই অনুভূতি কিন্তু একান্ত আপনার। কোনো কোনো সংস্কৃতিতে একে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও একে বাগে আনতে নানা উপদেশ দেওয়া হয়। কারণ কিছু করার মাধ্যমেই আপনি উপার্জন করতে পারবেন, যা আপনাকে জীবনধারণের খোরাক জোগাবে। সেখানে কিছু না করে অলস সময় নষ্ট করার মানে জীবনটাই বৃথা। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক অতি জটিল। তাই কীসে আপনি খুশি হবেন, বা কীসে আপনার ভালো লাগবে- তা আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষই আলাদা, তাই মানিয়ে চলার ধরনগুলোও এক নয়।
ইতালির কথাই ধরা যাক। ‘ডলসে ফার নিয়েন্তে’ (Dolce Far Niente) নামে তাদের একটি ধারণা রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়- ‘মধুর আলস্য’, বা কিছুই না করার মিষ্টতা। এটি দিয়ে তারা আসলে যা বোঝায়, তা কেবল অলস বসে থাকা নয়, বরং বিরক্ত না হয়ে, একঘেয়েমিতে না ভুগেও ঐ একটি মুহুর্তকে উপলব্ধি করা, চারপাশের প্রশংসা করা এবং জীবনের ঘোড়দৌড় থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়া।
জাপানি ভাষায়ও একটি শব্দ রয়েছে– ‘বোকেটো’ (Boketto)। বাংলা অর্থ ‘নির্দিষ্ট কিছু সম্পর্কে চিন্তা করা ছাড়া শূন্যদৃষ্টিতে দূরে তাকানো’। যখন আমরা অনেক বেশি চাপের মধ্যে থাকি, তখন আমাদের মন কখনও কখনও নিজে থেকেই বোকেটো অবস্থায় চলে যায়। কিন্তু কখনো কখনো যদি ইচ্ছাকৃতভাবেই আমরা আমাদের চিন্তাভাবনায় লাগাম টানতে পারি, তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও সুফল বয়ে আনতে পারে।
একবার ভাবুন তো, আপনি বসে আছেন আপনার কাজের টেবিলে, হাতে এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই। কিন্তু, আপনি কি কোনো চিন্তা ছাড়া আছেন? হয়তো ভাবছেন, এরপর আপনার কোন কাজটা করতে হবে বা বাসার জন্য কী বাজার করতে হবে। অথবা আপনার হুট করেই মনে পড়েছে স্কুল জীবনের কোনো স্মৃতি, বন্ধু বা কোনো শিক্ষকের কথা।
আবার হয়তো আপনি নতুন কোনো জায়গায় বেড়াতে গিয়েছেন, পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পটাপট ক্যামেরায় ছবি তুলতে লাগলেন, যাতে এই জায়গার স্মৃতি রোমন্থন করতে পারেন ভবিষ্যতে। দেখা গেল, বাসায় এসে আপনি যখন ছবিগুলো দেখছেন, তখন কিছুতেই মনে করতে পারছেন না যে ঐ মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কী ছিল। এমনকি আপনি কি আসলেই নিজ চোখে এই সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন কি না, তা-ও যেন বেমালুম ভুলে গেছেন।
আমরা যখন যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, সবসময় অতীত অথবা ভবিষ্যতের চিন্তায় মশগুল থাকি। বর্তমান বলেও যে একটা কাল আছে, যার মধ্যেই আমরা আসলে বেঁচে আছি, সেই বর্তমানকে নিয়ে আমরা কখনো ভাবি না। তবে হ্যাঁ, কোনো কাজ না থাকলে এখন আমরা আমাদের মুঠোফোনের পর্দায় সময় কাটাই, কিন্তু নিজেদের সাথে নয়।
যখন অনবরত কিছু না কিছু নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি; ভালো ফলাফল, আরও ভালো চাকরি-ভালো বেতন, বাড়ি-গাড়ি এসবের পেছনে ছুটতে থাকি, আমাদের মস্তিষ্ক তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আবার সাময়িক বিরতি নেবার বাহানায় যখন আমরা মোবাইলের সাথে সময় কাটাই, তখন সেখান থেকে আমাদের সাময়িক ভালোলাগার অনুভূতি হয়। একই অনুভূতি আমরা পেতে পারি সাঁতার বা সাইকেল চালাতে শিখে। আবার কোনো অন্ধ পথিককে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েও আপনার এ অনুভূতি হতে পারে। সবকিছুর পেছনে আছে ডোপামিন নামের হরমোনের কারসাজি। মনের ভাব নিয়ন্ত্রণ, আবেগ বা উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার নিয়ন্ত্রণ মূলত ডোপামিনের কারণে হয়ে থাকে।
সাইকেল চালানো বা সাঁতার শেখার মতো কাজগুলো কিন্তু একদিনে সম্ভব হয়ে ওঠে না। নিয়মিত এর পেছনে সময় দিতে হয়। যেমনটা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে চাইলে নিয়মিত পড়তে হয়, যার সাথে কঠিন অধ্যবসায় জড়িত। কিন্তু বর্তমানের ইউটিউব, ফেসবুক আর ভিডিও গেমস ডোপামিন ক্ষরণকে দ্রুতগতি দিয়েছে। এখন বেশি খুশি হতে আপনাকে ঘাম ঝরানো কঠিন অধ্যবসায় করা লাগছে না। কথায় আছে “ঘোড়া দেখে খোঁড়া হওয়া”; আমাদের মস্তিষ্কের অবস্থা এখন সেরকম।
আমাদের মস্তিষ্ক তাই আর বই পড়ে খুশি হতে চায় না, বরং ফাঁক পেলেই সামাজিক মাধ্যমের নিউজফিড স্ক্রলিংয়ে সুখ খোঁজে। আর যত তাড়াতাড়ি এই সুখের অনুভূতি আমরা পাই, তত তাড়াতাড়িই সেটা হারিয়ে যায়; আর আমরা বিষণ্ণ হয়ে পড়ি, একঘেয়েমিতে ভুগি অথবা অল্পতেই বিরক্ত হই। প্রথমেই যে ভালো না লাগার কথা বলেছিলাম, তার কারণ কিন্তু এ-ই। ক্রমাগত ছুটে চলা অথবা অপ্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার- একটা পর্যায়ে এসে এই ভালো না লাগার উপলব্ধিকে বাড়িয়ে তোলে। এ থেকে বের হতে আবারও আপনি মোবাইলকেই হাতে তুলে নেন, আর স্ক্রল করতে শুরু করেন। কিন্তু এতে করে কিন্তু আপনার মানসিক সুখ-শান্তি অধরা হয়ে যায়। আর একসময় তা শারীরিক অসুস্থতার কারণও হয়ে দাঁড়ায়।
তাহলে উপায় কী? আসুন, ইতালিয়ান ‘ডলসে ফার নিয়েন্তে’ অথবা জাপানি ‘বোকেটো’তে ফিরে যাই। ভাবছেন- কখন, কোথায় বা কীভাবে শুরু করবেন?
প্রথমে ধরেই কোনোকিছু হয় না। সব কিছুতেই সময় দিতে হয়, তবেই তা থেকে ফল পাওয়া যেতে পারে। মনে করুন, আপনি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। হাতে ফোন আছে? পকেটে ঢুকিয়ে ফেলুন। আপনার সাময়িক ‘কিছু না করা’র যাত্রা শুরু করুন। এটি আপনি প্রতিদিন করতে চাইলে সকালে ঘুম থেকে উঠে বা রাতে ঘুমানোর সময়েও অভ্যাস করতে পারেন। আপনার শরীর, মন; দুই-ই একসময় এর থেকে উপকৃত হবে।
‘কিছু না করা’র সময় একটি আরামদায়ক, শান্ত পরিবেশ বেছে নিতে পারেন, যা আপনাকে ঐ মুহূর্তের উপর মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। হতে পারে আরামদায়ক সোফা, বা আপনার বিছানা- তারপর আরাম করুন। আরাম করতে বলছি, পরবর্তী রুটিন বা কাজের তালিকা নয় কিন্তু। ভবিষ্যতের পালে হাওয়া দিতে যাবেন না যেন। হালকা গরম পানিতে স্নান আপনাকে নিরুদ্বেগ হতে সাহায্য করতে পারে, যদি আপনি এতে একটু বেশি সময় দিতে চান। আবার হাতে নিতে পারেন গরম এক কাপ চা বা কফি (কিংবা যা আপনার প্রিয়), সময় দিন ঐ মুহূর্তে। চাইলে বসতে পারেন কোনো পার্কের বেঞ্চে অথবা নদী-লেকের পাড়ে। তারপর, কী করবেন? কিছুই করবেন না!
‘কিছু না করা’র সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ হলো- কীভাবে করবেন। কারণ আমরা সত্যিকার অর্থে আরাম করতে ভুলে গিয়েছি।
প্রথমেই একটু আরাম করে বসুন। মোবাইল বা কম্পিউটার বন্ধ করুন, নোটিফিকেশন বা ভাইব্রেশন মোড অফ রাখবেন, যাতে সেগুলো কিছু সময়ের জন্য আপনার এই ‘কিছু না করা’র প্রয়াসে বাধা দিতে না পারে। বিষয়টা আসলে বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ দেয়া- সেটা আপনি আপনার মতো করে ভেবে নিন। হালকা কোনো সুর শুনতে পারেন অথবা চোখ বন্ধ রাখতে পারেন, দূর দিগন্তে তাকিয়েও থাকতে পারেন। আবার শ্বাস-প্রশ্বাসের কিছু অনুশীলন আপনাকে ‘বোকেটো’ মোডে নিতে সাহায্য করতে পারে।
ড. রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় তার বই ‘দ্য ফোর পিলার প্ল্যান’-এ ‘৩-৪-৫ শ্বাস প্রশ্বাস’ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। নাক দিয়ে ৩ সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিন, ৪ সেকেন্ড ধরে রাখুন আর ৫ সেকেন্ড ধরে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন এবং পুনরাবৃত্তি করুন। এ পদ্ধতি আপনাকে আপনার স্নায়ু শান্ত করতে এবং খোশমেজাজ পেতে সহায়তা করবে।
আর একটি সহায়ক পরামর্শ হলো, আপনার আশেপাশের সমস্ত ঘড়ি সরিয়ে রাখা। কিছুই না করার কোনো সময়সীমা নেই, সুতরাং যতক্ষণ আপনি প্রয়োজন মনে করছেন, ততক্ষণ ‘কিছুই না করার’ চেষ্টা করতে পারবেন; তা হোক দুই মিনিট বা এক ঘণ্টা। যখন আমাদের চোখের সামনে বা হাতের কাছে ঘড়ি থাকে, তখন আমাদের অভ্যাস হলো সময় দেখা এবং নিশ্চিত করা যে, আমরা আসলে ‘সময় নষ্ট করছি না’। তবে সঠিকভাবে আরাম করার জন্য, আপনার প্রয়োজন ‘এই মুহুর্তে’ উপস্থিত থাকা। এবং ঘড়ি এই কাজকে কঠিন করে তোলে। সুতরাং আপনি ততক্ষণ ‘কিছুই করবেন না’, যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার মনে হয় যে যথেষ্ট হয়েছে। সময় এক্ষেত্রে কোনো ব্যাপার নয়। যতটুকু সময় আপনি ‘আসলেই কিছু করেননি’– সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।