রবার্ট লুইস স্টিভেনসন তার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অভ ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড (১৮৮৬)-এ মানুষের দুটো আলাদা সত্তা দেখিয়েছেন। একজন মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রের বাইরে তথা সমাজের সামনে প্রকাশিত চরিত্রের বাইরে আরেকটি লুকায়িত সত্তা বা চরিত্র রয়েছে যেটি আগাগোড়া নেতিবাচক। আমাদের যা অবদমিত ইচ্ছা বা নেতিবাচক কামনা, যা বাস্তবতা বিবর্জিত, তা-ই আমাদের লুকিয়ে থাকা সত্তার মূল বৈশিষ্ট্য। লেখক স্টিভেনসন আজ থেকে প্রায় শতাধিক বছর আগে এই কল্পকাহিনী লিখে গেলেও বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা তার বর্ণিত উপন্যাসের মতোই হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে আমরা এখন দুটো আলাদা জগতে আলাদা সত্তা ধারণ করে বাস করছি। একটা আমাদের বাস্তবের দুনিয়া, আরেকটা হচ্ছে তথাকথিত ভার্চুয়াল দুনিয়া। বর্তমানে প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীই ভার্চুয়াল জগতে আরেকটি স্বতন্ত্র সত্তা ধারণ করেন। আর এই স্বাতন্ত্র্য এতটাই যে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার সাথে তার বিন্দুবিসর্গ মিলও থাকে না। এই মাধ্যমগুলোর প্রতিটি প্রোফাইলই একেকটি আলাদা সত্তার বিমূর্ত রূপ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর এই পরিমাণ ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কী ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ এসব মাধ্যমে মানুষ এত বেশি সময় ব্যয় করছে, এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছে যে কখনো কখনো তার বাস্তবজ্ঞান আর থাকছে না। বাস্তবতা তার কাছে নিরর্থক হয়ে মেকি ভার্চুয়াল দুনিয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে করে মানুষের মনের ওপর স্বভাবতই চাপ পড়ছে, তার ভাবনাচিন্তার পরিধি পাল্টে যাচ্ছে। বিশেষত ফেসবুক বর্তমানে তরুণ সমাজকে বেশি প্রভাবিত করছে। তরুণরা ফেসবুককে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে ধরে নিচ্ছে, তারা ফেসবুকের বিকল্প ভাবতে পারছে না। মেকি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এভাবে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার ফলে তরুণ সমাজ আজকে তাদের সমস্ত মানসিক উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে। তারা হয়ে পড়েছে মানসিকভাবে অসুস্থ, অস্থিরচিত্ত, বিষণ্ণ। মানুষের সামগ্রিক মানসিক সুস্বাস্থ্যের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
২০১৭ সালে ফেসবুকের একজন কর্মকর্তা চামাথ পালিয়াপিতিয়া ফেসবুক প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন,
আমরা এমন মাধ্যম তৈরি করেছি যা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বিকাশের গঠনকে ধ্বংস করে ফেলছে।
পালিয়াপিতিয়ার মতে, ফেসবুক হচ্ছে ‘ডোপামিন পরিবাহক একধরনের স্বল্পমেয়াদী ফিডব্যাক লুপ’। ফেসবুকে লগ-ইন করার পরই আমরা এক অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে যাই। নিউজফিড স্ক্রল করার সময় আমাদের সামনে হরেক রকমের পোস্ট ভেসে আসে। এসব পোস্ট দেখে আমরা হাসি, কাঁদি আবার কখনো বিরক্ত হই। এই ভিন্নধর্মী আবেগগুলো আমাদের মনের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলে। সোজা কথায়, ফেসবুক আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কীভাবে ফেসবুক আমাদের মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হলো।
অন্যের সাথে তুলনা
ফেসবুকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন। বিশেষত পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার একটি ভার্চুয়াল উপায় হিসেবে ফেসবুকের আবির্ভাব ঘটে (কিন্তু গন্ডগোলটা এখানেই, কারণ আমরা এখন এক ঘর থেকে অন্য ঘরেও ফেসবুক বা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করি)। ফেসবুকের কল্যাণে আমরা এখন আমাদের বন্ধু বা চারপাশের মানুষজনের হাঁড়ির খবর জানতে পারছি। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখন যখন আমরা তার সাথে নিজেদের হাঁড়ির তুলনা শুরু করি। আর যখনই আমাদের হিসেব মেলে না তখনই যত ঝুটঝামেলা উঁকি দেয়। অন্যের সাথে তুলনা করতে গিয়ে আমাদের অবস্থা হয়, ‘সবার অংক মেলে, আমার অংক মেলে না’। কারণ আপনি যখন অন্যের সাথে নিজের তুলনা করেন তখন সবসময় নিজের অবস্থাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেন। আপনার বন্ধুর ট্যুরে যাওয়ার ছবি দেখে আপনার মনে হয়, ট্যুরে কেন আমি যেতে পারছি না। তখন আপনি নিজের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে বন্ধুর সাথে নিজেকে তুলনা করা শুরু করেন। আর তখনই ঘটে যত বিপত্তি। দেখা গেলো আপনি হয়তো টাকা জোগাড় করতে না পেরে বা পারিবারিক সমস্যার কারণে ট্যুরে যেতে পারেননি। ব্যাস, মুহূর্তের মধ্যে মনটা হয়ে যায় বিষন্ন। হয়তো সেদিন পুরোটাই একরাশ বিষন্নতায় ডুবে থাকেন আপনি।
উপায়
আচ্ছা ভাবুন তো, ফেসবুক না থাকলে কি এত কিছু ঘটতো? মোটেই না। কারণ হয়তো আপনি জানতেন আপনার বন্ধু বেড়াতে যাচ্ছে কিন্তু তাদের বেড়ানোর ছবিগুলো তো আর দেখতে পেতেন না। ফলে আপনি আর বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? ফেসবুক থাকুক বা না থাকুক, আপনার বন্ধুটি বেড়াতে যাবেই আর আপনার ঝামেলায় পড়ে বেড়ানো হবে না। মানে আপনার জীবন আপনার মতোই চলবে আর আপনার বন্ধুর জীবন তার মতো। আপনার এখানে কিছুই করার নেই। তাই এখানে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব করে দুঃখ পাওয়ার মতো বোকামি না করাই উচিত।
আরেকটা ব্যাপার হলো ফেসবুকের কর্মকাণ্ড দেখে আপনি কারও ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখের হিসেব করতে পারবেন না। হয়তো আপনার বন্ধুর পারিবারিক জীবনে যথেষ্ট অশান্তি চলছে বলে সে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য এই ট্যুরটি বেছে নিয়েছে।
তো এই সোজা কথাটা মাথায় রেখে নিজের ভালোটা বুঝুন। এমন কোনো কাজ করুন যাতে আপনার লাভ হবে। আপনার সময়টুকু ভালো কাজে লাগান, কোনো উৎপাদনশীল কাজে। যেমন, আমি যদি এই লেখাটা সেদিন না লিখে ফেসবুকে বসে থেকে মিম দেখে বেড়াতাম তাহলে কি আজকে আপনি এটা পড়তে পারতেন? এখন প্রকাশিত লেখাটা পাঠক পড়ছে দেখে আমার নিজের কাছেই তৃপ্তি হচ্ছে। সুতরাং ফেসবুকে বাড়তি সময় না দিয়ে এমন কোনো কাজ করুন যাতে আপনার নিজের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতার প্রকাশ ঘটে ও মানসিক সন্তুষ্টি লাভ হয়। তখন আর ফেসবুকে অন্যের আনন্দঘন ছবি দেখে আপনার ভ্রুক্ষেপও হবে না।
নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হওয়া
এই তো সেদিন বন্ধুদের আলোচনায় কথা হলো পরের সপ্তাহের ছুটিতে চাঁদপুর গিয়ে ইলিশ খেয়ে আসা যাবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ফেসবুকে দেখলেন বন্ধুরা আপনাকে না জানিয়েই বেড়াতে চলে গেছে। গেলো আপনার মন খারাপ হয়ে। আচ্ছা, মন খারাপ হওয়াটা না হয় কিছুটা স্বাভাবিক, কিন্তু আপনি আরেকটু আগ বাড়িয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র, অপাংক্তেয়, অবাঞ্ছিত ভাবতে শুরু করলেন। হয়তো এই ঘটনায় বন্ধুতা সম্পর্কে আপনার বিচিত্র ধারণাও জন্মাতে পারে। আবারও সেই একই প্রশ্ন, ফেসবুক না থাকলে কি আপনার ভাবনার জগতে এত ঝড় বইতো?
আবার ধরুন, আপনি আপনার কোনো বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলেন। বেশ আনন্দ, ফূর্তি, খাওয়াদাওয়ার পর বাসায় এসে ঘুমানোর আগে ফেসবুক খুলে বসে দেখলেন আপনার বার্থডে বয় বন্ধুটি ফেসবুকে যেসব ছবি আপলোড করেছে সেগুলোর একটাতেও আপনি নেই, থাকলেও একেবারে পেছনে। এরকম দেখে আপনি নিশ্চয় আপনাকে ঐ অনুষ্ঠানে অনাহূত ভাববেন। ফেসবুকটা না থাকলে এই ট্র্যাজেডিটা একদমই হতো না।
উপায়
এসব ক্ষেত্রে আপনি আসল কারণটা জানার চেষ্টা করুন। আপনি ফোন করে বন্ধুদের কাছে জানতে চাইতে পারেন কেন তারা আপনাকে সঙ্গে নেয়নি। হয়তো দেখা গেল তারা একেবারে বিনা পরিকল্পনায় অকস্মাৎ বেড়াতে চলে গিয়েছে। হয়তো তারা আপনাকে নিতে চেয়েছে কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। হয়তো বা আপনাকে ফেলে রেখে যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না। আর যদি উল্টোটা হয় তাহলে তো শাপে বর। আপনার মনে হয় নতুন বন্ধু খোঁজার সময় হয়েছে।
আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। কারণ অন্যজন তার ফেসবুকে কী আপলোড করবে সেটা একান্তই তার ব্যাপার। আর ফেসবুক দিয়ে যদি সম্পর্কের মান বিচার করেন তাহলে আপনার শ্রেণীচ্যুতই থাকা উচিত।
সময় হয়ে যায় আপেক্ষিক
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কৌতুক করে বলেছিলেন,
আপনার হাত গরম উনুনের ওপর এক মিনিট রাখুন, দেখবেন এক ঘন্টা মনে হবে। সুন্দরী একটা মেয়ের পাশে এক ঘন্টা ধরে বসে থাকুন, মনে হবে মাত্র এক মিনিট বসেছেন।
ফেসবুকে বসলে আমাদের আর সময়জ্ঞান থাকে না, এ এক অমোঘ সত্য। আমরা অল্প কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুকে থাকব মনে করলেও নিজেদের অজান্তেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ফেসবুকে ব্যয় করি। কখনো নিউজফিডে অলস স্ক্রলিং আবার কখনো অপরিচিত ব্যক্তির প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা (Stalking)- এসব কাজেই আমাদের মূল্যবান সময় অপচয় হয়। এছাড়া রয়েছে চ্যাটিংয়ের ব্যবস্থা। অপরিচিত ব্যক্তির সাথে পরিচয় হতে বাস্তবে অনেকেই অপছন্দ করলেও ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তাতে মোটামুটি সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কারণ এখানে দায়বদ্ধতার বালাই নেই। সোজা কথায়, ফেসবুক আমাদের সময় ‘খেয়ে নেয়’।
উপায়
ফেসবুক যেন আপনার জীবনের বেশিরভাগ সময় না নিয়ে নেয় তার জন্য আপনাকেই সচেতন হতে হবে। এর জন্য চাই প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি। ফেসবুকে প্রবেশ করে আপনি নোটিফিকেশন, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট চেক করতে পারেন, মেসেজের উত্তর দিতে পারেন। তারপর না হয় একটু নিউজফিড ঘুরে দেখতে পারেন। এটুকু সময় ফেসবুকে ব্যয় করলে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু এরপর আর ফেসবুকে না থাকাই উচিত। কারণ দরকারি কাজ সারার পর বাকিসময় ফেসবুকে থাকা মানেই তা সময়ের অপচয় মাত্র। এছাড়া আরেকটি কাজ করতে পারেন। সপ্তাহে মাত্র দুই বা তিনদিন ফেসবুকে লগ-ইন করতে পারেন। বাকি দিনগুলোতে ফেসবুক থেকে দূরে থাকলে আপনার দৈনন্দিন কাজগুলো সারার জন্য হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে।
যদি মনে করেন, আপনার পক্ষে সপ্তাহে চারদিন ফেসবুক ছাড়া থাকা সম্ভব নয় তাহলে শেষ একটি উপায় বাতলে দিতে পারি। এখানেও আপনার ইচ্ছাশক্তিটাই মূল অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। আপনাকে ঠিক করতে হবে যে দিনের মাত্র এক ঘন্টা আপনি ফেসবুক ব্যবহার করবেন। আবার এমন শপথও করতে পারেন যে রাত দশটার আগে ফেসবুকে প্রবেশ করবেন না এবং এগারটার মধ্যেই ঘুমিয়ে যাবেন। আর কত ফেসবুককে আপনার ঘুমের বারোটা বাজাতে দেবেন, বলুন তো!
প্রাক্তন ও ফেসবুক কথন
আজকালকার দুনিয়ায় প্রেম করার সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হচ্ছে ফেসবুক। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রেমের সূচনাও হয় ফেসবুকে। ফেসবুকে ছবি দেখে প্রেম, তারপর বাস্তবের রূপ দেখে থ বনে যাওয়া-এ নিয়ে তো কত গল্প, কৌতুক প্রচলিত আছে। কিন্তু আসল কথা হলো, ফেসবুক প্রেমের আমেজ দিতে যতটুকু না সাহায্য করছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে ব্রেকআপের পর। অধিকাংশ ব্যর্থ প্রেমিক/প্রেমিকাই প্রেম ভেঙে যাওয়ার পরে প্রাক্তনের প্রোফাইল নিয়মিত ঘুরে বেড়ান। এতে যে দুঃখ বাড়ে তা হয়তো শতভাগ জোর দিয়ে বলা যায় না, কিন্তু সুখের মাত্রাটা যে ইতিবাচক রেখার দিকে বৃদ্ধি পায় না তা হলফ করে বলা যায়। ফলাফল আবারও বিষন্নতায় ডুবে যাওয়া। প্রাক্তন যদি নতুন প্রেমে পড়ে আর তার অভিসারের কর্মকাণ্ড ফেসবুকে প্রকাশ করে তাহলে তো একেবারে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। না পাওয়ার বেদনা করুণ কিন্তু যদি দেখা যায় সেই ঈপ্সিত বস্তু অন্য কেউ খুব সহজে অধিকার করে নিয়েছে তাহলে সেই কষ্ট অপার্থিব।
উপায়
তাকে ব্লক করুন। বিশ্বাস করুন, এছাড়া আর কোনো উপায় আদতে নেই। দয়া করে ‘ভালো বন্ধু হয়ে থাকা’র প্রলোভনে ভুলবেন না।
লাইক ও কমেন্টের সংগ্রাম
মনে পড়ে প্রথম যেবার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রোফাইলে ছবি টাঙিয়েছিলেন, সেবার কত ‘লাইক’ পেয়েছিলেন? আচ্ছা, যা-ই পান না কেন, তখন কি কোনো আক্ষেপ হয়েছিল লাইক-কমেন্টের সংখ্যা নিয়ে? আর এখন কি হয়?
বেশিরভাগ মানুষই এই প্রশ্নের উত্তরে না-বোধক জবাব দিলেও মনে মনে কিন্তু সবাই এর উল্টোটাই লালন করেন। সবারই মনে একটা সুপ্ত বাসনা থাকে বেশি বেশি লাইক, কমেন্ট বা শেয়ারের জন্য। এই বাসনা অমূলক নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু যখন আপনি লাইক-কমেন্টের সংখ্যা নিয়ে বেশি সিরিয়াস হয়ে যান, তখনই সমস্যা শুরু হয়ে যায়। এসবের সংখ্যা বেশি হওয়ার সাথে সাথে সুখানুভূতির মাত্রাটাও বাড়তে থাকে। আবার লাইক-কমেন্ট না জুটলে মন খারাপ হয়, নিজেকে ব্যর্থও মনে হতে থাকে। আমাদের ফেসবুক ব্যবহারের একটা বড় অংশই জুড়ে রয়েছে এই লাইক-কমেন্টের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আক্ষেপ।
উপায়
শুধু লাইক বা কমেন্ট পাওয়ার আশায় ফেসবুকে শেয়ার করা বন্ধ করুন। ফেসবুক এমন একটা প্লাটফর্ম যেখানে সবাই সবার অনুভূতি, ধারণা শেয়ার করে। এখানে মেকি কিছু প্রকাশ না করাই উচিত, যদিও এমনটাই হচ্ছে আজকাল। আপনি যেটা অর্থবহ, নিজের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন সেটাই শেয়ার করুন। যদি আপনার মনে হয় কোনো কনটেন্ট শেয়ার করলে অন্যরা লাভবান হবে তাহলে সেটাই শেয়ার করুন। অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য সস্তা কার্যকলাপ করার কি-ই-বা প্রয়োজন আছে!
একটা সময় আসবে যখন আপনি ফেসবুকে অন্যের কর্মকাণ্ড দেখে বিরক্তবোধ করবেন। প্রতিটি পোস্টই আপনার কাছে অনর্থক মনে হবে। অন্যদের ফেসবুক অ্যাক্টিভিটি দেখে আপনার কাছে সেগুলো খুবই তুচ্ছ বলে মনে হবে। এমনও হতে পারে, হতাশার চরম অবস্থায় পৌঁছে আপনি হয়তো আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি চিরতরে মুছে ফেলতে চাইবেন। এমন অবস্থা হলে আপনার কর্তব্য হবে ফেসবুক থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নেয়া। তবে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিলিট না করাই শ্রেয়। কারণ ফেসবুক অনেক ক্ষেত্রেই কাজের। বিশেষত আপনি যদি একজন শিক্ষার্থী হন তাহলে ফেসবুক ছাড়া আপনার চলতে কিছুটা অসুবিধা হবে। আজকাল অনেক কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ বা ক্লাসের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ফেসবুক গ্রুপ আছে যেখানে ক্লাস শিডিউল থেকে শুরু করে পরীক্ষার রুটিন ইত্যাদি যাবতীয় দাপ্তরিক তথ্যাবলী শেয়ার করা হয়। সুতরাং ফেসবুক থেকে আমাদের একেবারে মুক্তির উপায় নেই। তাই আপনি কিছুদিনের জন্য সোশাল মিডিয়া থেকে ব্রেক নিতে পারেন। ঐ সময়টুকু পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে কাটানোর চেষ্টা করুন। ফেসবুক মেসেঞ্জারে লুডু না খেলে পরিবারের সদস্যদের সাথে কাগজের লুডু খেলুন। পরিবারের কাজে সহায়তা করুন, পাড়াপড়শির খোঁজখবর নিন। ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশটা একটু বেড়িয়ে আসুন। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে সেলফি তোলার চিন্তা থেকে দূরে থেকে নির্ভার হয়ে অংশগ্রহণ করুন। জীবন তো একটাই। তাই জীবনটাকে শুধু শুধু একটা মেকি জগতে বন্দী করে রেখে সুখ খোঁজার মর্ম কোথায়!
২০১৬ সালের শেষের দিকে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুক মানুষকে অসুখী, ঈর্ষাপরায়ণ করে তোলে যা ধীরে ধীরে বিষন্নতায় পরিণত হয়। গবেষণায় এটাকে ফেসবুক এনভি (Facebook Envy) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যেসব ব্যবহারকারী সোশাল মিডিয়া থেকে সপ্তাহখানেকর মতো বিরতি নিয়েছেন তারা তাদের জীবন নিয়ে অধিকতর সন্তুষ্ট। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণায় ১০৯৫ জন অংশগ্রহণ করে যাদের অর্ধেক সংখ্যক মানুষকে বলা হয়েছিল নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করতে আর বাকি অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার থেকে পুরোপুরি বিরত ছিলেন।
গবেষক মর্টান ট্রমহোল্ট বলেন,
আমরা বর্তমানে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অবশ্যই একে অপরের সাথে বেশি করে যুক্ত থাকতে পারছি। কিন্ত এই সংযুক্তি কি আমাদের ভালো থাকার ব্যাপারে কোনো সাহায্য করছে? বর্তমান গবেষণা বলছে, আদতে না। বস্তুত ফেসবুক আমাদের সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার পথে নানামাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
একই বছরের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯-৩২ বছর বয়সীরা যত বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের বিষন্নতায় ভোগার হারও তত বেশি। তারা ‘বিষন্নতার অসীমচক্রে বন্দী‘। সাইবারবুলিয়িং, নেতিবাচক তুলনা ইত্যাদির কারণে বিষন্নতা ও চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিতে পারে। ফেসবুকে অতিরিক্ত আসক্তির কারণে স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কিত জটিলতা, মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা এমনকি সামাজিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত আসক্তির কারণে মানুষ ফেসবুকে এত বেশি সময় ব্যয় করে যে ঘুমানোর প্রয়োজনীয় সময়টুকুও পায় না। ঘুম কম হলে নানারকম শারীরিক অসুবিধা তো হয়ই, পাশাপাশি অপরিমিত ঘুম আচরণগত পরিবর্তনও ডেকে আনতে পারে।
ফেসবুক যোগাযোগের একটি মাধ্যম হলেও যোগাযোগের সবটুকু আনন্দ এতে পাওয়া যায় না। কারণ বাস্তব যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমরা যেসব অবাচনিক যোগাযোগ রূপগুলো (Nonverbal gestures) দেখি ও অনুধাবন করি, ফেসবুকে তা করার কোনো উপায় নেই। এমনকি যোগাযোগের ক্ষেত্রে শারীরিক নড়াচড়ার (Bodily movement) যে ভূমিকা, তা-ও ফেসবুক বা সোশাল মিডিয়ায় অনুপস্থিত। সুতরাং ফেসবুক যোগাযোগের যন্ত্র হলেও তা বাস্তব যোগাযোগ ব্যবস্থার সবগুলো প্রয়োজনীয় উপাদানকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।
তবে সব কথার শেষ কথা হলো, ফেসবুক আপনাকে কতটা মানসিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিতে পারে তা নির্ভর করছে আপনি কীভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন তার ওপর। ব্যবহারকারীই ঠিক করবেন ফেসবুককে তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন নাকি ফেসবুক তার ওপর নিয়ন্ত্রণ ফলিয়ে তার মানসিক অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তুলবে।