কালোজিরা, বোটানিক্যাল নাম ‘নাইজিলা সাটিভা’ (Nigella sativa)। শতাব্দী ধরে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং আফ্রিকার লাখো মানুষ এই কালোজিরাকে তাদের সুস্বাস্থ্য ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করে আসছে। দারুণ সুগন্ধিযুক্ত কালোজিরার ছোট্ট দানা ও এর তেল তারা তাদের নানা স্বাস্থ্য সমস্যা ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং শক্তি পুনরুদ্ধারকারী হিসেবে অন্যতম প্রাকৃতিক উপাদান বলে মেনে আসছেন। ঐতিহ্যগতভাবে এই কালোজিরা শক্তিবর্ধক, হজমে সাহায্যকারী, শ্বাসতন্ত্র, কিডনি, লিভার ও শারীরিক ব্যথা উপশমকারী হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া ভারতীয়, পাকিস্তানী, মধ্যপ্রাচ্য ও ফার্সি রান্নার অন্যতম মশলা হিসেবে কালোজিরার ব্যবহার হয়।
কালোজিরার অন্যান্য নাম সমূহ
কালোজিরাকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন: মিশরে ব্ল্যাক কিউমিন (Black Cumin), তুরস্কে ব্ল্যাক কারাওয়ে (Black Caraway), ভারত ও পাকিস্তানে কালনজি (Kalonji), মধ্যপ্রাচ্যে হাব্বাতুল বারাকা (Habbatul Baraka) বলা হয় কালোজিরাকে। ১৯৮০ সালের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রবর্তনের সময় থেকে কালোজিরা ‘ব্ল্যাক সিড বা ব্ল্যাক কিউমিন’ নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকে।
কালোজিরার পুষ্টি উপাদান
কালোজিরা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এতে রয়েছে অ্যামিনো অ্যাসিড, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, এসেনশিয়াল ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন এ, বি১, বি২, সি এবং নায়াসিন সহ মিনারেলস, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম এবং জিঙ্ক। এসব পুষ্টি উপাদান আমাদের দেহের জন্য অপরিহার্য।
কালোজিরার স্বাস্থ্য উপকারিতা
কালোজিরা অনেক ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ একটি বীজ। এসব ঔষধি গুণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে:
- অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল।
- অ্যান্টি-ফাংগাল।
- অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি।
- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট।
- অ্যান্টিসপাসমোডিক।
- অ্যান্টি-ভাইরাল।
- অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ।
- হাইপোটেন্সিভ।
- ইনসুলিন সেন্সটাইজিং।
- বেদনানুভূতিনাশক।
আসুন এবার এই নানা পুষ্টিমানে গুণান্বিত এই কালোজিরার স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে জানা যাক।
ক্যান্সার ঝুঁকি কমায়
একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করে কালোজিরায় বেশ কয়েক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর মতো উপাদান রয়েছে। যেমন: কোলন ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, মস্তিষ্কের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, ওরাল ও সার্ভিকাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর ক্ষমতা কালোজিরায় বিদ্যমান।
২০১২ সালে বায়োকেমিক্যাল ফার্মাকোলজি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানানো হয় কালোজিরায় উপস্থিত থাইমোকুইনন ইনফ্ল্যামাটোরি ও ক্যান্সার নিরাময়ের সমূহ সম্ভাবনা বহন করে। এই উপাদানটি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুপার অক্সাইড হিসেবে কাজ করে।
লিভার ভালো রাখে
লিভার আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রায় প্রতিদিন আমাদের শরীরে নানা ধরনের টক্সিন প্রবেশ করে এবং লিভারের মাধ্যমে সেসব টক্সিন প্রক্রিয়াজাত হয়। লিভারের পিত্ত ফ্যাট হজম করতে সাহায্য করে শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখে। মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অ্যালকোহল গ্রহণ বা অন্য কোনো রোগে ভোগা ইত্যাদি কারণে লিভারের কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে, কিন্তু কালোজিরার তেল লিভারের কাজের গতি বাড়াতে সক্ষম। সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন, লিভার ফাংশন এবং লিভারের সুস্থতা নিশ্চিত করতে কালোজিরার তেলের জুড়ি নেই।
হৃদযন্ত্র ভালো রাখে
একটি অসুস্থ হৃদযন্ত্র মানেই নানা রোগশোকের কারণ। হার্টকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি না দিলে সেটি অচল হয়ে পড়বে, এটিই স্বাভাবিক। ওমেগা ৬ ও ৯ অ্যাসিডে সমৃদ্ধ কালোজিরা রক্ত জমাট বাঁধা ও ধমনিতে অতিরিক্ত চাপ পড়া রোধ করে। এছাড়াও কালোজিরা কোলেস্টেরল এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে হার্ট ভালো রাখে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
ভারতীয় জার্নাল অব ফিজিওলজি অ্যান্ড ফার্মাকোলজিতে প্রকাশিত ২০১০ সালের গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন ২ গ্রাম করে কালোজিরা টাইপ ২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
নিয়মিত কালোজিরা গ্রহণ করার ফলে রক্তে শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রা কমানোর পাশাপাশি অগ্ন্যাশয়ে বায়ো-সেল ফাংশন বাড়ানো যায়, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খুবই জরুরী।
অ্যালার্জি ও অ্যাজমা উপশম
বেশ কিছু গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, কালোজিরায় অ্যান্টি-অ্যাজমাটিক উপাদান উপস্থিত এবং তা সনাতন ও প্রচলিত চিকিৎসার চেয়ে অনেকগুণ কার্যকরী। শুধু তা-ই নয়, অ্যালার্জি উপশমকারী হিসেবেও এই উপাদানের জুড়ি নেই।
গামলায় খানিকটা গরম পানি নিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা কালোজিরার তেল মিশিয়ে, একটি তোয়ালে দিয়ে চারপাশ ঢেকে পানির ভাপ নাক দিয়ে টানুন, দেখবেন ৫ মিনিটের মধ্যে অ্যাজমার কষ্ট থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। আবার একটা রুমালে দুই তিন ফোঁটা কালোজিরার তেল নিয়ে নাক দিয়ে টানলেও ভালো ফল পাবেন।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
কালোজিরা ওজন কমাতে সাহায্য করে মূলত রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াতে। কালোজিরা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের অন্যতম উৎস, যা আমাদের খাদ্য বিপাকে সাহায্য করে এবং অতিরিক্ত ক্ষুধাভাব কমায়। ওজন কমাতে এটি সবচেয়ে বেশি আপনাকে সাহায্য করবে, যখন আপনি পুনরায় ডায়েটের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে চাচ্ছেন।
হজম শক্তি বর্ধক
কালোজিরার আরও একটি অন্যতম গুণ হলো, এটি বায়ুনাশকারী, যার কারণে এটি আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। যেমন: পেটের গ্যাস, বায়ু সহ অন্ত্রের ব্যথা উপশম করে এবং এটি অন্ত্রের পরজীবী আক্রমণের প্রতিরোধক হিসেবেও অবদান রাখে। কালোজিরা অন্ত্রের পীড়া এবং অন্ত্রের পেশীস্থ ব্যথা নিরাময়ে দারুণ ভূমিকা পালন করে।
উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস
কালোজিরা উচ্চ রক্তচাপ হ্রাসে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগে থাকেন, তারা যদি দুই মাস নিয়মিত কালোজিরা গ্রহণ করেন, তবে উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করা সম্ভব বলে গবেষকরা দাবি করেন।
রোগ প্রতিরোধক
কালোজিরা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর এক অসাধারণ উপাদান হিসেবে ধরা হয়। কালোজিরার তেল শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন বি ও অ্যাসিড সমৃদ্ধ, যা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের জন্য ভীষণ কার্যকরী। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সাথে শরীরের সুস্থ টিস্যুর উপর কোনো ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। কালোজিরা এইচআইভি এর অল্টারনেটিভ প্রোটোকল হিসেবে বছরের পর বছর ব্যবহার করা হচ্ছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অটোইমিউন রোগের ফোরামে এই কালোজিরাকে সুপারিশ করা হয়।
ফাংগাল সংক্রমণ রোধ
ফাংগাল সংক্রমণ তখনই হয়, যখন আপনার ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটে, যার ফলাফল হলো ফুসকুড়ি ও চুলকানি। কালোজিরা এমন একটি শক্তিশালি ন্যাচারাল রেমিডি, যার সাথে ফাংগাল সংক্রমণ পেরে উঠতে পারে না। কালোজিরায় উপস্থিত অ্যান্টি-ফাংগাল ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ফাংগাল সংক্রমণের অন্যতম প্রধান প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
কেবলমাত্র ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য সমস্ত রোগ নিধন করে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্যই নয়, কালোজিরা আমাদের ত্বক ও চুলের জন্য ভীষণ উপকারী। কালোজিরা চুল পড়া বন্ধ করে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। মাথার ত্বক সুস্থ রেখে এটি চুলকে শক্তিশালী করে তোলে। মাথার ত্বকের ফাংগাল ইনফেকশন ও চুলে উকুনের সমস্যা সমাধানে কালোজিরা তেলের জুড়ি নেই। কালোজিরায় লিনোলেইক ও লিনোলেনিক নামের এসেনশিয়াল ফ্যাটি এসিড উপস্থিত থাকার কারণে এটি আমাদের ত্বককে সারাদিনের ক্লান্তি ও পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। একইসাথে এটি ত্বককে সুস্থ ও লাবণ্যময় রাখে এবং ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখে।