হোক সকালে বা সন্ধ্যায়, আপনার কাজের জায়গা, হোক সেটি অফিস, ব্যাংক, কোম্পানি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আপনার মাথায় কেবল একটিই চিন্তা, কিভাবে আগে পৌঁছাবেন, কিভাবে কাজটি শেষ করবেন উসাইন বোল্টের ন্যায় দ্রুত গতিতে অথবা কিভাবে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে পড়বেন। কিন্তু কখনো কি চিন্তা করে দেখেছেন দু’একটা ছোটখাটো বিষয়ে আরেকটু কষ্ট করে দৃষ্টি দিলেই হয়ত আরো সহজ, আরো পরিপাটি হতে পারত আপনার দৈনন্দিন জীবন। এমনকি আপনার কাজের স্পৃহাও বেড়ে যেতে পারত আরো অনেকগুণ।
বিশ্বাস করুন, আপনার একটি কর্মদিবসের শুরু এবং শেষের মুহূর্ত দুটিই নির্ধারণ করতে পারে আপনার কাজের জায়গাতে আপনার পরবর্তী দিন, এমনকি পরবর্তী সপ্তাহ কেমন যাবে। একজন উদ্যোক্তা, চাকুরীজীবী কিংবা ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি ঠিক তা-ই। একটি পরিপক্ক রুটিন করে নিজের কাজে মনযোগ দেয়া, রুটিন অনুযায়ী চলা, যদিও একটু দুরূহ কাজ বটে, তবে সেক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনাটাই আসল। অবশ্যই এর মাঝে গতানুগতিকতার ছাপ রাখতে হবে, নতুবা তাল মিলাতে পারবেন না। যেমন ধরুন, খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, সন্ধ্যার পরেও বাড়তি কাজ করা, নিজেকে একটু সময় দেয়া ইত্যাদি। এই কাজগুলো আপনার প্রতিদিনকার রুটিনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে এবং আপনি একসময় দেখবেন এর বাইরে আপনি কতটুকু সময় কাজ করলেন সেটা আপনার ক্যারিয়ারে তেমন প্রভাব রাখছে না। উপরন্তু আপনার কাজের দক্ষতা এবং কাজের পরিধি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
আপনি চাইলে আপনার দিন, সপ্তাহ অথবা মাস আরো কার্যকরী কিংবা আরো ফলপ্রসূ করতে নিচে উল্লেখ করা বিষয়গুলো চর্চা করতে পারেন।
আপনার কর্মদিবসের প্রথম ১০টি মিনিট যেভাবে কাটানো উচিত
পরিকল্পনা হোক সফলতার
সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্য প্রতিটি দিন শুরু করুন একটি সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে। কর্মস্থলে পৌঁছে আপনার আসন গ্রহণ করুন। সেটাকে মনে করুন আপনার নিজের ঘাঁটি হিসেবে, যেভাবে প্রধান রাঁধুনি অন্য কারিকরদের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আপনার হাতের কাজগুলো করে নেয়ার আগে কিছুক্ষণ সময় নিন কাজগুলো দেখে নেওয়ার জন্য। কাজ হাতে পাবার পরপরই তাড়াহুড়া করে শুরু করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে কাজগুলোর তালিকা লিখে রাখতে পারেন আপনার মুঠোফোনে, হোয়াইট বোর্ডে অথবা সাদা কাগজে। এতে করে সারাদিন আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আপনার সামনে থাকবে এবং আপনি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজগুলো করতে পারবেন।
নিজেই নিয়ে নিন বড় সিদ্ধান্তগুলো
দিনের শুরুতেই বড় সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে নিন, যদি আপনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন। আপনার সময় কাজে লাগান; সিদ্ধান্ত নিন উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে অথবা প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগের বিষয়ে। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মানসিক চাপে ভুগবেন না। দিনের শুরুতেই এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন, বাকি দিনটি ব্যবহার করুন উন্নতির লক্ষ্যে ।
‘ব্যাং’ দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে ফেলুন
আগেই বলে রাখি, এটা কিন্তু সেই ব্যাঙ না। এটি ব্যবসার জগতে খুবই পরিচিত একটি ধারণা। এই ব্যাং ধারণা জনপ্রিয় হয় ব্র্যায়ান ট্রেসি’র Eat That Frog! বইটির মাধ্যমে। এর মূলকথা হচ্ছে, সকালে যখন কাজে যাবেন, আপনার সবচেয়ে কঠিন কর্ম-পরিকল্পনায় হাত দেবেন সবার আগে। ট্রেসি এখানে আপনার কঠিন কাজটিকে উল্লেখ করেছেন ‘ব্যাং’ হিসাবে। একটি কর্ম-পরিকল্পনা পিছিয়ে পরের দিন বা তার পরের দিন নেয়া সহজ। যদি আপনি মনে করেন সময়ের অভাবে এই ধরনের কোনো কাজ আটকে রয়েছে বহুদিন ধরে, সিদ্ধান্ত নিন আগামীকাল কর্মস্থলে ঢুকেই এটি সম্পন্ন করে ফেলার।
ই-মেইল, এসএমএস, ফেসবুক/যেকোনো সোশ্যাল মিডিয়া চেক করার প্রয়োজন নেই
Never Check E-Mail in the Morning: And Other Unexpected Strategies for Making Your Work Life Work বইয়ের লেখক জুলি মরগেনস্টার্ন পরামর্শ দেন, আপনার নিজের বাসায় বা কর্মস্থলে প্রথমেই ই-মেইল চেক করতে বসে যাবেন না । বরং প্রথম কাজ হিসাবে এমন একটি নির্দিষ্ট কাজে আপনার মনোযোগ সীমাবদ্ধ রাখুন যেটি কিনা আপনি নিখুঁতভাবে করে ফেলতে পারেন। প্রশ্ন করতেই পারেন, কেন বিশেষভাবে ই-মেইল চেক করবেন না। এই প্রসঙ্গে সামাজিক মনস্তত্ববিদ রন ফ্রাইডম্যান Psychology Today-তে লিখেছেনঃ
“এই ধরনের কর্মকাণ্ড রীতিমতো আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয় এবং মানসিকভাবে আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল স্তরে নিয়ে যায়, যেখানে অন্য কোনো মানুষের গুরুত্বই হয়ে দাঁড়ায় চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। এটা অনেকটা রান্নাঘরে ঢুকে পানি জাতীয় কিছু ছলকে পড়েছে কিনা খোঁজা, পরিষ্কার করার জন্য অথবা পাত্র খোঁজা ধোয়া-মাজা করার জন্য।”
ব্যক্তিগতভাবে সকালে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত শেখার দিকে। সরাসরি কাজে ঝাঁপ দেওয়ার চেয়ে বরং TED Talk জাতীয় ভিডিও দেখা খুবই কাজের। অথবা কোনো দক্ষতা ঝালাই দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়া যেতে পারে, যাতে দিনের বাকি সময় কাজে সফলতা আসে।
মনে রাখবেন, উপরে আলোচিত প্রতিটি বিষয় একসাথে কখনোই করতে পারবেন না। বরং একটি একটি করে সমাধান করুন এবং সেই পথ ধরে সামনে এগোতে থাকুন।
আপনার কর্ম দিবসের শেষ ১০ মিনিট যেভাবে কাটানো উচিত
ছোট কর্মপরিকল্পনা সেরে ফেলুন আজই
দিনের শুরুতেই যদি আপনি আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং কঠিন সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেলেন, তাহলে এটা খুবই স্বাভাবিক যে দিনের শেষে আপনি পরিশ্রান্ত একজন মানুষ। এখন কী করবেন? আপনি এই সময়ে আপনি আপনার বাড়তি মেইলগুলো চেক করে নিতে পারেন, কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে পারেন। আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে (অথবা কর্মস্থলে) ছোটখাটো যে কাজগুলো বাকি ছিল সেগুলোও সেরে নিতে পারেন। তবে ঐসব কাজ নয় যেগুলোতে আপনার শারীরিক পরিশ্রম হবে। বলা যায়, এতে আপনার সময়েরই সদ্ব্যবহার হবে। শুধু তা-ই নয়, এতে আপনার চিন্তা হবে আরো সুসংহত, আপনি হয়ে উঠবেন আরো আত্মবিশ্বাসী। ফলাফলে হয়তো আপনার পরের দিনটিও হতে পারে আরো অনেক বেশি ফলপ্রসূ।
বিগত দিনটির হিসাব করুন
কর্মদিবসের শেষে ১০ মিনিট নিজেকে সময় দিন। নিজেই হিসাব করুন এই দিনটিতে কোন কোন কাজ আপনি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন এবং কোন কাজগুলো বাকি রয়েছে এবং আগামীকাল কোন কোন কাজগুলো করা প্রয়োজন। আপনি যখন জানবেন পরের দিনটির জন্য আপনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তখনই আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে বাকি সন্ধ্যাটুকু উপভোগ করতে পারবেন আপনার মতো করে।
কর্মস্থল ত্যাগ করবেন, কিন্তু …
আপনার কর্মী অথবা সহকর্মীদের সাথে সারাদিনের কাজের বিষয়ে আলাপকালে শুধু শুধু গড়িমসি না করাই শ্রেয়। Tame Your Terrible Office Tyrant: How to Manage Childish Boss Behavior and Thrive in Your Job বইটিতে লেখক লিন টেলরের মন্তব্যটি এখানে খুবই মানানসই- “কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া কর্মস্থলে থাকা নিশ্চিতভাবেই আপনার প্রাণশক্তি এবং উদ্যম কমিয়ে ফেলতে পারে, যা আপনার অবশ্যই প্রয়োজন হবে, হ্যাঁ, আগামীকালকে।” টেলরের মতে, কর্মস্থল ত্যাগ করার পরে আপনার উচিত আপনার ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে যাওয়া। কাজকে কাজের জায়গায় রাখাটা আপনার কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবনকে সঙ্গতিপূর্ণ রাখার প্রথম শর্ত।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে, এমনকি কাজের ক্ষেত্রে তো বটেই, যে কাজটি করা বাঞ্ছনীয় অথবা যে কাজটি আপনাকে নতুন কোনো কাজের জন্য ভাবিয়ে তুলবে না, সে কাজটিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সম্পন্ন করতে হবে। নতুবা আপনি পিছিয়ে থাকবেন আপনারই সময়ে অন্যদের থেকে সহস্র-কোটি আলোকবর্ষ দূরে।