লেখাটি যখন পড়ছেন, তখন হয়তো আপনি নিজেও জ্যামেই বসে আছেন। হয়তো ভাবছেন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি যানজট আবার বিশ্বের কোথাও আছে নাকি! হয়তো ধরেই নিয়েছেন সবার উপরে বাংলাদেশ তথা ঢাকা শহরের নামটাই দেখতে পাবেন। তারপরের নামগুলো কাদের, সেটা দেখতেই আপনার হয়তো আগ্রহ জন্মাবে।
কিন্তু ঘটনা উল্টো কথা বলছে। আপনাকে প্রচণ্ড হতাশ করে এটাও জানাতে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের কোনো শহরের নাম বিশ্বব্যাপী তীব্র যানজটের প্রথম দশের তালিকাতে একেবারেই নেই। প্রথম ১৫ শহরের মধ্যেও নেই। তাহলে একবার ভাবুন, সবচেয়ে বেশি যানজটের শহরের কেমন অবস্থা? পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি যানজট হয় এমন অনেক শহরে স্থানীয় জনগণের প্রায় পুরো কার্যঘণ্টা চলে যায় রাস্তার জ্যামে। কেবল সময় নয়, এসব যানজটের কারণে প্রত্যেকটি শহর ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আর্থিকভাবে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, কমছে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ।
তবে জ্যাম হওয়ার পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপরিকল্পিত সড়কব্যবস্থা, যত্রতত্র পার্কিং, দুর্নীতিগ্রস্থ ট্রাফিক সিস্টেম আর নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো দায়ী।
আপাতত নিশ্চিত হোন, বাংলাদেশের কোনো শহরের নাম নেই। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের সবচেয়ে বেশি যানজটের অন্তত ১০টি শহরের কথা।
বেইজিং (চীন)
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ট্রাফিক জ্যামের শহরের তালিকায় নাম রয়েছে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের। এই শহরকে বলা হয় ট্রাফিক জ্যামের ‘পোস্টার বয়’। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল চীনের এই রাজধানীতে জ্যামের হার ৪৬%। যদিও বেইজিংয়ের বায়ুদূষণও দুশ্চিন্তার কপালে ভাজ পড়ার অন্যতম কারণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যানজটের সমস্যা। তবে বায়ুদূষণের পেছনেও বিশেষ অবদান রয়েছে এখানকার ট্রাফিক জ্যামের। অপরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ির জ্বালানীর ধোঁয়া এখানকার বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।
তাইনান (তাইওয়ান)
প্রায় ১৮ লাখ জনসংখ্যার দ্বীপ তাইনান। এটি তাইওয়ানের সবচেয়ে দূষিত দ্বীপ না হলেও কেবল জ্যামের কারণে প্রতিনিয়ত দূষণের পথে এগোচ্ছে এই শহর। বেইজিংয়ের মতো এখানেও জ্যামের হার ৪৬%।
তবে ট্রাফিক জ্যামের করাল গ্রাস থেকে বেঁচে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছে তাইনানের প্রশাসন। দুই চাকার বিশেষ মোটরসাইকেল, নাম ‘মোপেড’; এর কারণে আরও জ্যাম বাড়ছে। তাই এর বিকল্প খুঁজে ফিরছে সরকার। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তাইনান শহরের মধ্যে দেশটির সরকার একটি রিং রোড স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।
রিও ডি জেনেইরো (ব্রাজিল)
ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরো বিশ্বের প্রধানতম যানজটের শহর। পুরো ব্রাজিলের মধ্যে এই শহর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল জায়গা। প্রতি বছর এখানে জ্যামের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে পুরো শহরজুড়ে নতুন রাস্তা তৈরি, নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার কারণে জ্যামের পরিমাণ আরও বাড়ছে। ২০১৬ অলিম্পিক আয়োজনের সময় এই বিপদ অনেক বেড়ে যায়। পরবর্তীতে সেগুলো সমাধানও হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, শহরের আয়তন অনেক বেশি হওয়ায় জ্যাম কমানোর অনেক সুযোগ রয়েছে।
তবে রিও ডি জেনেইরোর জ্যামের কোনো সময়জ্ঞান নেই। সারাদিন ধরেই চলে জ্যামের গ্রাস।
শেংদু (চীন)
চীনের শিচুয়ান প্রদেশের শহর শেংদু। শিচুয়ান প্রদেশ তার প্রাকৃতিক দৃশ্য, সুস্বাদু খাবারের জন্য বিখ্যাত। এই মুহূর্তে বিখ্যাত যানজটের জন্য। প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর শেংদুর জনগণ পুরো দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক, যার ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ট্রাফিক জ্যামের বিড়ম্বনা। এই অবস্থার উন্নতি হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং স্থানীয়দের ভাবনা, দ্রুত কোনো সমাধান বের করতে না পারলে অবস্থা আরও বেশি খারাপের দিকে যাবে।
ইস্তাম্বুল (তুর্কিস্তান)
তুর্কিস্তানের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যের ধারক ইস্তাম্বুল শহরের খ্যাতি জগদ্বিখ্যাত। আবার একইসঙ্গে শহরটি ট্রাফিজ জ্যামের জন্য কুখ্যাত। অনেকের মতে, পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে নাকি ইস্তাম্বুলের মতো ট্রাফিক জ্যাম আর কোথাও নেই। সরকারিভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে শহরের যানজট কমানোর। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তীব্র যানজটের কারণে প্রতিদিন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শহরের সাধারণ মানুষ। মালামাল পরিবহন, শিপমেন্ট হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
বুখারেস্ট (রোমানিয়া)
বুখারেস্ট রোমানিয়ার রাজধানী। কিন্তু এই শহর পুরো ইউরোপের মধ্যে অন্যতম যানজটের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করে। এই শহরে চালকদের জন্য পার্কিং ফ্রি। সে কারণে যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করে এখানকার বেশিরভাগ নাগরিক। ফলশ্রুতিতে বেড়ে যায় যানজট। তাছাড়া এখানকার গণপরিবহণের উন্নয়নে অনেক কিছু করার আছে। কখনও কখনও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা যানজট থাকে। মূলত ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহণের উদাসীনতার কারণেই এই শহরে যানজট বেড়ে চলেছে।
চোংকিং (চীন)
সবচেয়ে যানজটের শহরের তালিকায় চীনের নাম সবার আগে আসে। যদি বিশ্বব্যাপী যানজটের শহরের তালিকা করা হয়, অন্ততপক্ষে কেবল চীনেরই ২-৩টি শহরের নাম থাকবে। বেইজিং আর শেংদুর মতো চোংকিংও চীনের একটি যানজটপূর্ণ শহর। এর অবস্থান চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে।
চোংকিং পুরো চীনের মধ্যে অর্থনীতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগলিক অবস্থার কারণে এখানে বাণিজ্যিক ‘কারবার’ ভালো হয়, তাই ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবেও এখানকার বেশ সুখ্যাতি আছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের মতো চোংকিং একটি মেট্রোপলিটন শহর। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৩০ মিলিয়ন। কিন্তু তীব্র যানজট স্থানীয়দের বিশাল একটি সময়ের অপচয় ঘটায়। এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, চোংকিংয়ের অনেক মানুষ তাদের ৯৪% সময় জ্যামে নষ্ট করে ফেলেন। এর মূল কারণ চোংকিংয়ের গোলকধাঁধার মতো বিভ্রান্তিকর রাস্তাঘাট। যানজটের কারণে আপনি অন্য রাস্তা দিয়ে যাবেন, সেই উপায়ও নেহাত ভাগ্য ভালো না হলে মেলে না। কারণ এখানকার রাস্তাগুলোর ধরনই এমন যে, আপনি চাইলেই ব্রিজ-কালভার্ট এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
জাকার্তা (ইন্দোনেশিয়া)
এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া। তার রাজধানী জাকার্তা। অর্থনৈতিক, ভৌগলিকভাবে এই শহরটি ক্রমশ উন্নতি পথে এগোচ্ছে বটে, কিন্তু সেই এগিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যানজট। বলা হয়, গ্রেটার জাকার্তায় বাস করে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ, যাদের অনেকেই উপশহর ও শহরতলিতে বাস করে। সবমিলিয়েই জাকার্তায় প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় ভুগতে হয় চরম যানজটে। দিনে অন্ততপক্ষে চার ঘন্টা যানজটে আঁটকে থাকা জাকার্তায় খুব সাধারণ ব্যাপার।
এত কিছু সমস্যার সমাধানে সরকারও উঠেপড়ে লেগেছে। ২০১৯ সালেই জাকার্তায় মেট্রোরেল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংকক (থাইল্যান্ড)
ভ্রমনপিয়াসীদের জন্য ব্যাংকক জনপ্রিয় এক নাম। থাইল্যান্ডের রাজধানী, এই শহর ছবির মতো সুন্দর হলেও, সেই সৌন্দর্য ক্রমশ আবেদন হারাচ্ছে এখানকার যানজটের কারণে। বলা যায়, ব্যাংককের জন্য যানজট এক বিষফোঁড়া। জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এখানে প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে যানজট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোটা সময় যানজটের কবলে পড়তে হয় এখানকার জনসাধারণকে। এখানকার ট্রাফিক শৃঙ্খলার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। যে কারণে রাজপথের বিশাল একটি অংশ কেবল পার্কিংয়ের জন্য আঁটকে রাখা হয়।
মেক্সিকো সিটি (মেক্সিকো)
উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল শহর মেক্সিকো সিটি। যে কারণে এখানকার জ্যামের অবস্থাও বেগতিক। এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, অন্ততপক্ষে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯৬%-১০১% সময় সাধারণ মানুষকে যানজটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতি বছর এখানে অন্ততপক্ষে ২১৯ ঘন্টা সময় অপচয় হয় যানজটের কারণে। মেক্সিকো সিটির যানজট কেবল সময়ই নষ্ট করছে না, বাড়াচ্ছে দূষণও।