প্রথমেই বলে রাখি এই লেখাটা শুধুমাত্র তাদের জন্য, যারা ধরেই নিয়েছেন তাদের জীবন নিশ্চল, একটা গতিহীন জীবনবাহনের ন্যায় চালিত হচ্ছে প্রতিদিন। যা-ই হোক শুরু করার আগে একটু পেছনে ফিরে যাই, Homer এর মহাকাব্য Odyssey-এর নাম বোধহয় আমরা অনেকেই শুনেছি। এর প্রথম কয়েক অধ্যায় পড়লে এর নায়ক Odysseus-এর প্রতি আপনার রীতিমতো করুণা জন্মাবে, হ্যাঁ করুণা জন্মানোরই তো কথা, দুই না, তিন না, একেবারে টানা দীর্ঘ দশটি বছর পৃথিবীর আরেক প্রান্তে যুদ্ধ করে শেষমেশ তারা জয়ী হয়। দেবতা Zeus-এর রোষে পড়ে তার নিজের দেশে ফিরে আসতে আরও একটি যুগ লেগে যায়। জাহাজডুবি থেকে শুরু করে ভয়ংকর দানবদের হাতে বন্দী হওয়া এমন কোনো বিপদ নেই যার মুখোমুখি তাকে হতে হয়নি। এমনকি তার নিজের দেশেও তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-কে বিয়ে করে আর তার পুত্রকে হত্যা করে সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে একদল মানুষ। এ থেকে কী শিখলেন? এতো কষ্ট, এতো সংগ্রাম তো অর্থহীন। কী প্রয়োজন এগুলোর?
জীবনে উল্লেখযোগ্য, গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জন করা মোটেও সহজ কিছু নয়। আবার অনেকে বুঝে উঠতে পারেন না যে জীবনের পথে কী অপেক্ষা করে রয়েছে তাদের জন্য। ধরুন, আপনি চান জীবনটাকে চুটিয়ে উপভোগ করতে। কিন্তু আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে আপনাকে দৌড়াতেই হবে, জীবনের প্রয়োজনে। কিন্তু আপনি কি জীবনের পথ আগলে দাঁড়ানো বাধা-বিপত্তিগুলোর মুখোমুখি না হয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চান? যদি তাই চান তাহলে এখানে কয়েকটি নিশ্চিত এবং কার্যকরী পন্থা উল্লেখ করা হয়েছে; এবং সেটা আপনার জন্যই।
নতুন মানুষ? এড়িয়ে যান!
হয়তো নতুন পরিচিত মানুষেরা আপনাকে নতুন সব পরিকল্পনা আর পরামর্শ দেওয়া শুরু করল। এগুলো নিঃসন্দেহে আপনার চিন্তা এবং আপনার দৈনন্দিন রুটিনের সাথে একদম যাচ্ছে না! আপনার গতানুগতিক কাজের ধারা হয়তো আপনাকে কোন হোমরা-চোমরা ব্যাক্তিত্বে পরিণত করবে না; কিন্তু আপনি তো নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট। তাছাড়া আপনি যথেষ্ট ব্যস্ত; নতুন মানুষদের সময় দেওয়ার মতো সময় কোথায়? হয়তো আপনি সপ্তাহে দু’তিনদিন ‘কফি টাইমে’ তাদের সাথে সময় দিতে পারেন সর্বোচ্চ।
আপনি কি বুঝতে পারছেন, আমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা ? আসুন এবার ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে দেওয়া যাক কেমন?
জনপ্রিয় লেখক, Keith Ferrazzi তার ব্যবসা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বই Never Eat Alone এ উল্লেখ করেছেন, “মানুষ স্বভাবতই পরিচিত এবং পছন্দসই মানুষের সঙ্গেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।” তার মতে, অন্যদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। তাই অন্যদের সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করুন। নিজের কর্মপরিকল্পনা আর সমস্যাগুলো তুলে ধরুন; তাদের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানুন। হয়তো এই নতুন মানুষদের ভিতরেই কারো পরামর্শে আপনার সবচাইতে কঠিন সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতে পারেন আজই।
বই পড়ে সময় নষ্ট করার কী দরকার ?
যেভাবে আপনি এতদিন কাজ করে আসছেন, সেভাবেই করে যান। শুধু শুধু বাড়তি জ্ঞানকে আপনার মাথার উপরে বোঝা হতে দেবেন কেন? তাছাড়া, আপনার নিজের অভিজ্ঞতার উপরে আপনি অন্যের পরামর্শকে মূল্য দিতে যাবেন-ই বা কেন? এই একবিংশ শতাব্দীতে ব্যবসায়িক দুনিয়ায় ব্যর্থতা কোন ব্যাপার নয়; এতে ব্যবসাবুদ্ধির দুর্বলতাকে দায়ী করা যায় না। হ্যাঁ বাইরের বইপত্র পড়ার অভ্যাস আপনার মূল্যবান সময়ে ভাগ বসায়; খুবই সত্যি কথা। কিন্তু কে বলতে পারে, আপনার হাতের বইটিই আপনাকে হয়ত সন্ধান দেবে অর্থনৈতিক সাফল্যের কিংবা সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা?
আসুন এবার একটু লক্ষ্য করি, আমরা যাদের পথিকৃৎ কিংবা বড় মানি, তাদের অধিকাংশেরই কিন্তু বই পড়েই সময় কাটে। Jim Rohn এর মতে “গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে পৌঁছাতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।” এদিকে Warren Buffet দিনের শতকরা আশি ভাগ সময়ই বই পড়ে কাটান। Bill Gates এর মতে “সপ্তাহে অন্তত একটি বই পড়ুন।” লেখক Steve Siebold প্রায় ১২০০ শীর্ষ ধনীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি চমকপ্রদ এক তথ্য দেন। এই ধনীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অমিল থাকলেও একটি মিল রয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই তুখোড় পাঠক!
আরে মশাই টেলিভিশন দেখুন; একটা ঘণ্টাই তো!
দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার ‘নিজের’ বলতে সময় কতটুকু? ঘণ্টাখানেক সময় হয়তো পান কোনোমতে। তাহলে ভেবে দেখুন, ‘নিজের’ আর একটা ঘণ্টা সময় পেলে কত উপভোগ্য হতো আপনার জন্য! শরীরে ক্লান্তি ভর করলে আপনি কাজ করবেন কীভাবে? ব্যবসায়িক কাজের জন্য সময় তো আর পার হয়ে যাচ্ছে না।
আপনি কি জানেন, অসাধারণ মানুষেরা কী করে? অহসনীয় ক্লান্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দরকারি কাজে হাজিরা দিতে তাদের কখনোই ভুল হয় না। কীভাবে? তারা ভালো করেই জানেন, প্রাথমিক চাপটাই বড় বাধা। মূল কাজের চাপ কষ্টকর হলেও তারা সহ্য করতে পারবেন। লেখক Neil Fiore এর মতে “আপনি কেবল শুরুটা করুন; শেষটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। এটা আপনা আপনিই হয়ে যাবে।” তাই এবার অলসতাকে ঝেড়ে ফেলুন। সময়ের কাজ সময়ে করার অভ্যাস করুন। কষ্টকর পাঁচটা মিনিট কেবল সূচনা, আপনি পঞ্চাশ মিনিট কাজের তাড়না পেয়ে যাবেন অনায়াসে। কারণ কাজে হাত দিলে কর্মক্লান্তি আপনি নিজেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
শরীরচর্চার এত সময় কোথায়?
শরীরচর্চা করবেন ভালো কথা। কিন্তু একবেলা শরীরচর্চার কারণে তিনটি দিন শারীরিক ধকল সহ্য করতে হবে আপনার। এটি আপনার মাংসপেশীগুলোর জন্য অবশ্যই উপকারী। কিন্তু ক্ষতিকর দিকগুলোও তো ভাববেন মশাই। তাই নয় কি?
হ্যাঁ, আপনি যদি নাছোড়বান্দা কিংবা হাল ছেড়ে না দেওয়া প্রকৃতির মানুষ হন, তাহলে আপনি নিজের তাগিদেই নিজেকে তরতাজা করে তোলার জন্য এক কাপ কফির পরিবর্তে শারীরিক পরিশ্রমকেই বেছে নেবেন। বিশ্ববিখ্যাত ট্রেইনার Jon Joachim বলেন “শক্তি সরবরাহের পাশাপাশি আপনার শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমেও শরীরচর্চা ভূমিকা রাখে, যা আপনার অবসাদ দূর করে।” শুধু তাই নয়, শরীরচর্চায় আপনার শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে আপনি কর্মোদ্যম ফিরে পান।
নিজের পিঠ চাপড়ানো বন্ধ করুন!
অহংকার পতনের মূল। তাই অতি-আত্মবিশ্বাস আপনার জন্য ভালো কিছুই নিয়ে আসবে না। মনে রাখবেন, সফল মানুষদের আত্মতৃপ্তি দেখা মানুষের জন্য কোনো আনন্দদায়ক বিষয় নয়। এর সাথে মানিয়ে নিতে হলে নিজের স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানো আপনাকে থামাতে হবে। নিজেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো মানুষ বলে ভাববেন না, যে কিনা পৃথিবীতে নতুন কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
কিন্তু এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যা যা আমরা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছি নিজেদেরকে। আমরা ভেবে নিই যে আমাদের দিয়ে হবে না। আমি Tony Robbins এর চারদিন মেয়াদী সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম। দর্শকদের উদ্দেশ্যে তার প্রশ্ন ছিল “আপনাদের ভেতরে কারা বিশ্বাস করেন যে আপনাকে দিয়ে হবে না ?” ঐ কক্ষে দশ হাজারের মতো উদ্যোক্তা উপস্থিত ছিলেন। তাদের পঁচানব্বই শতাংশ হাত তুলেছিলেন; এমনকি তাঁদের দলে আমি নিজেও ছিলাম। ভালো কিছু করতে চাইলে নিজের প্রতি মনোযোগ দিন সবার আগে। Nice Girls Don’t Get the Corner Office এর লেখক Dr. Lois Frankel বলেন “নিজের প্রতি উঁচু দৃষ্টিভঙ্গি সাফল্য আর আত্মতৃপ্তি উভয়ের সাথেই সমানভাবে সম্পর্কিত।” ক্রমশ এটাই আমাদের আরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে নিজেদের যোগ্যতার ব্যাপারে। তাই আত্মপ্রেম খারাপ কিছু নয়; বরং প্রয়োজনীয়।
আবার Odyssey-র প্রসঙ্গে চলে যাই। এটি শুধুই একটি কাহিনী, কিন্তু এর কালোত্তীর্ণ শিক্ষা বা এর ঘরকুনো প্রকৃতি আপনাকে হয়তো নির্ঝঞ্ঝাট জীবন দেবে, কিন্তু কষ্ট সহ্য না করে কোনো মহৎ অর্জন সম্ভব নয়। আর এ জন্যই এই ৩০০০ বছরের প্রাচীন কাহিনী থেকে এখনও মানুষ অনুপ্রেরণা খুঁজে নেয়। কারণ মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা হচ্ছে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং বিজয়ের ইতিহাস। Odysseus-রা কষ্ট ভোগ করে ঠিকই, কিন্তু দিন শেষে তারাই বিজয়ী হয়। তাই বরণীয় জীবন চাইলে মুখোমুখি হোন বাধার।