সাধারণ মানুষ প্লেনে ইকোনমিক ক্লাস সিট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। যাদের আরো একটু আরাম আয়েশের দরকার হয়, তারা বিজনেস ক্লাস বা ফার্স্ট ক্লাস সিটের টিকেট কিনতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধাররা? তাদের জন্য থাকে সম্পূর্ণ পৃথক প্লেন এবং তাতে থাকে অত্যাধুনিক সব সুযোগ সুবিধা। এগুলোর মূল্যও হয় সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানের চেয়ে অনেক বেশি।
অবশ্য একে খুব একটা অপচয় হয়তো বলা যাবে না। কেননা, রাষ্ট্রের প্রধানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সেটা অনেক সময় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার উপরও হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই রাষ্ট্রের স্বার্থেই রাষ্ট্রপ্রধানরা অতিরিক্ত নিরাপত্তার খাতিরে বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখেন। চলুন তবে দেখে নিই, বিশ্বের ক্ষমতাবান কয়েকজন রাষ্ট্র প্রধানের ব্যবহৃত প্লেনগুলো, তাদের মূল্য এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমানের নাম এয়ার ফোর্স ওয়ান। এয়ার ফোর্স ওয়ানের অধীনে হুবহু একই রকম দুটি প্লেন আছে। এগুলো মূলত বোয়িং ৭৪৭- ২০০বি (Boeing 747-200B) প্লেনের পরিবর্তিত সংস্করণ, যদিও সামরিক পরিভাষায় এগুলো ভিসি-২৫এ (VC25A) নামে পরিচিত। এই প্লেনটির দৈর্ঘ্য ৭০ মিটার, অভ্যন্তরীন প্রস্থ বা ফিউজলেজ ৬.৫ মিটার এবং দুই ডানা পর্যন্ত প্রস্থ ৬৫ মিটার। কোনো এয়ারপোর্ট যদি বিশালাকার এই প্লেনকে ল্যান্ড করানোর জন্য উপযোগী না হয়, তখন প্রেসিডেন্ট অপেক্ষাকৃত ছোট একটি প্লেন বোয়িং সি-৩২ ব্যবহার করেন।
ভিসি-২৫এ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত অত্যাধুনিক একটি প্লেন। ডাবল ডেকার এই প্লেনটিতে আছে একটি যোগাযোগ কেন্দ্র, যেখানে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে কয়েকটি জরুরী ফোন লাইন সার্বক্ষণিকভাবে চালু থাকে। এতে অস্ত্রোপচারে সক্ষম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মেডিক্যাল ইউনিট আছে। প্রেসিডেন্টের থাকার জন্য আছে ৩৭০ বর্গ মিটারের একটি ভিআইপি কেবিন, যাতে বেডরুম এবং বাথরুম ছাড়াও একটি জিম এবং একটি অফিসরুম আছে। প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের জন্য এতে পৃথক পৃথক অফিস আছে। এছাড়াও ভ্রমণের সঙ্গী হওয়া সাংবাদিকদের জন্যও আছে পৃথক একটি কেবিন।
ভিসি-২৫এ প্লেনগুলো ঘন্টায় ১,০০০ কিলোমিটার বেগে টানা ১৪,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। এগুলো মাঝ আকাশে থাকা অবস্থাতেই জ্বালানি ভরতে সক্ষম। প্রথম ভিসি-২৫এ এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছিলেন সাবেক ফার্স্ট লেডি ন্যান্সি রিগ্যান। ন্যান্সি হোয়াইট হাউজের অনেকগুলো অংশকে নতুন করে সাজানোর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। গত কয়েক দশকে প্লেনটিতে অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং সুযোগ-সুবিধা যুক্ত হলেও মূল নকশা এখনও অনেকটাই অপরিবর্তিত আছে। এয়ার ফোর্স ওয়ানের প্রতিটি প্লেনের মূল্য আনুমানিক ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার।
ভ্লাদিমির পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে বহনকারী প্লেনটি হচ্ছে রাশিয়ার নির্মিত আইএল-৯৬-৩০০পিইউ (IL-96-300PU) মডেলের একটি বিশালাকৃতির প্লেন, যাকে প্রেসিডেন্টের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করে নেওয়া হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫ মিটার এবং এটি ২৭০ টন ভার বহনে সক্ষম। প্লেনটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৯০০ কিলোমিটার।
বাইরে থেকে দেখতে একই মডেলের যাত্রীবাহী বিমানগুলোর মতো হলেও প্রেসিডেন্টকে বহনকারী প্লেনের ভেতরে অত্যাধুনিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আছে। এর কেবিনগুলো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পর্দা এবং স্বর্ণের আচ্ছাদন দ্বারা আবৃত। একটি টেলিযোগাযোগ কেন্দ্র ছাড়াও এতে আছে প্রশস্ত একটি অফিস, বেডরুম এবং সব ধরনের ব্যবস্থা সহ অত্যাধুনিক একটি জিম।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে বহনকারী প্লেনটিতে রাডার জ্যাম করে দেওয়ার প্রযুক্তি এবং বিমান বিধ্বংসী মিসাইল বিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। অধিকতর নিরাপত্তার জন্য হুবহু একই রকমের চারটি প্লেনের ব্যবস্থা আছে। প্রেসিডেন্ট কোথাও যেতে চাইলে সবগুলো প্লেনকে একই সাথে প্রস্তুত করা হয়। শেষ মুহূর্ত ছাড়া কেউ জানতে পারে না, ঠিক কোন প্লেনটি যাত্রা করবে। এবং যাত্রা শুরুর পর প্লেনটির সাথে সাথে অন্তত একটি, এবং কখনো কখনো চারটি প্লেনই যাত্রা করে। প্লেনগুলোর প্রতিটির আনুমানিক মূল্য ধরা হয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
অ্যাঙ্গেলা মার্কেল
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের ব্যবহারের জন্য অনেকগুলো প্লেন আছে। কিন্তু তার সবচেয়ে পছন্দের এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লেনটি হলো একটি এয়ারবাস এ৩৪০-৩১৩এক্স (Airbus A340-313X) ভিআইপি প্লেন, যেটি জার্মানির যুদ্ধ পরবর্তী প্রথম চ্যান্সেলরের নামানুসারে ‘কনরাড অ্যাডেনয়্যার’ নামে পরিচিত। এটির হুবহু আরেকটি সংস্করণ আছে, যা জার্মানির প্রথম প্রেসিডেন্টের নামানুসারে ‘থিওডোর হয়েস’ নামে পরিচিত। ২০১১ সালে প্লেন দুটোকে চ্যান্সেলরের ব্যবহারের জন্য বিমান বাহিনীতে নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এগুলো লুফথানসা এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
কনরাড অ্যাডেনয়্যার প্লেনটিকে চ্যান্সেলের জন্য উপযোগী করে সংস্কার করা হয়েছে। এতে একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট, বেডরুম, অফিস ছাড়াও ভিডিও কনফারেন্সিং এর সুবিধা সম্বলিত একটি কনফারেন্স হল এবং জরুরী আলোচনার জন্য একটি শব্দ নিরোধক কক্ষ আছে। এতে মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। একনাগাড়ে ১৩,৫০০ কিলোমিটার চলতে সক্ষম প্লেনটিতে চড়ে কোনো বিরতি ছাড়াই বার্লিন থেকে ওয়াশিংটন, বেইজিং বা রিও ডি জেনিরোতে পৌঁছানো যায়। প্লেনটির আনুমানিক মূল্য ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ঝি জিনপিং
অন্যান্য বিশ্বনেতাদের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের নেতা, কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ঝি জিনপিংয়ের নিজস্ব কোনো বিশেষ প্লেন নেই। ভ্রমণের জন্য তিনি দুটি বোয়িং ৭৪৭-৪০০ (Boeing 747-400) প্লেন ব্যবহার করেন, যেগুলো মূলত এয়ার চীন এয়ারলাইন্সের সম্পত্তি। সাধারণ অবস্থায় প্লেনগুলো যাত্রীবাহী বিমান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জিনপিং যখন কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তখন রাষ্ট্রীয় বিশেষ নিরাপত্তাবাহিনী প্লেনগুলোকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে এবং এর আসনগুলো সরিয়ে সেসব স্থানে অস্থায়ী বেডরুম, অফিস এবং অন্যান্য কেবিন স্থাপন করে। ভ্রমণ শেষে প্লেন দুটোকে পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং এয়ারলাইন্সের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
চীনের নেতার ব্যবহৃত প্লেনগুলোর প্রতিটির মূল্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার। তবে প্লেনগুলোর ভেতরে কী ধরনের আসবাবপত্র বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকে, সে ব্যাপারে চীনের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয় না। রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে সাথে মিল রেখে চীনও তাদের নেতার জন্য একাধিক পৃথক প্লেন ক্রয় করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্যান অ্যান্টনিও এয়ারপোর্টের কাছে হস্তান্তর করেছিল সেগুলোকে মেরামত করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে চীনের নেতারা কখনোই সেগুলো ব্যবহার করেননি। ধারণা করা হয়, নিরাপত্তাই এর প্রধান কারণ।
ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো
ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ব্যবহার করতেন একটি এয়ারবাস এ৩১৯। কিন্তু একবার উড্ডয়নের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে প্লেনটির একটি ইঞ্জিন অকেজো হয়ে যাওয়ায় তার পরিবর্তে একটি এয়ারবাস এ৩৩০-২০০ (Airbus A330-200) কেনা হয়। সারকোজির পর এই প্লেনটি প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ ব্যবহার করেছিলেন, এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোও একই প্লেন ব্যবহার করছেন।
বিশাল আকারের বেডরুম, বাথরুম, ড্রেসিংরুম, কিচেন, একটি অফিস কক্ষ, শব্দনিরোধক আলোচনা কক্ষ ছাড়াও এতে আছে সেনাবাহিনী সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের উপযোগী একটি যোগাযোগ কক্ষ। এতে এমন সব অত্যাধুনিক যোগাযোগ যন্ত্রপাতি আছে, যা সাংকেতিক ভাষায় রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য প্রেরণ, গ্রহণ এবং সেগুলোর মর্ম উদ্ধার করতে পারে। প্লেনটির আনুমানিক মূল্য ২৭০ মিলিয়ন ডলার।
তামিম বিন হামাদ আল-থানি
ক্ষুদ্র উপসাগরীয় রাষ্ট্র কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলোর একটি। এর আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি বিশ্বের সেরা ধনীদের মধ্যে অন্যতম। স্বভাবতই তাকে এবং তার রাজপরিবারের সদস্যদেরকে বহনকারী প্লেনও হবে পুরো দুনিয়াকে তাক লাগানো। কাতারের আমির যখন বিদেশে যান, তখন প্রায় সময়ই তার সফরসঙ্গীর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এবং তাদের সাথে থাকা ব্যক্তিগত গাড়ি সহ অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মোট ওজন কয়েক টন ছাড়িয়ে যায়। ফলে মাত্র একটি প্লেনের পক্ষে তাদেরকে বহন করা সম্ভব হয় না। তিনি যখন জাপান সফরে গিয়েছিলেন, তখন তার সাথে গিয়েছিল ১০টি প্লেনের বিশাল বহর।
কাতারের রাজপরিবারের সদস্যদেরকে বহন করার জন্য “কাতার আমিরী ফ্লাইট” নামে পৃথক একটি ভিআইপি এয়ারলাইন আছে। ২০১৬ সালের আগস্টের এক হিসেব অনুযায়ী এতে মোট ১৪টি প্লেন আছে। পৃথক পৃথকভাবে এগুলোর প্রতিটির মূল্য গড়ে ১০০ মিলিয়ন ডলার হলেও একত্রে এগুলোর সর্বমোট মূল্য প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার।
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons