সময়ের অভাব, ধাঁরে কাছে জিম না থাকা কিংবা হিসেবের টাকা থেকে মাসিক নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন না দিতে পারার অক্ষমতার কারণে অনেকেরই জিমে গিয়ে ব্যায়াম করার সুযোগ হয় না। কিন্তু প্রয়োজনীয় খাবার সহ ফাস্টফুড, অধিক ফ্যাট এবং ক্যালরি সমৃদ্ধ বিভিন্ন জিনিস খাওয়া, দীর্ঘ সময় ধরে অফিস, স্কুল কিংবা কলেজে বসে থাকা, কায়িক পরিশ্রম না করায় দরুন আমাদের শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুর চর্বি জমতে থাকে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক সহ নানান ধরনের মারাত্মক রোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাছাড়াও ডায়াবেটিস, অধিক রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
জীবনে স্বাভাবিকভাবে চলার জন্য আমাদের শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। প্রত্যেকদিন সার্ভিস দেওয়া লিফটটাতে সমস্যা হওয়ার কারণে হয়তো আপনাকে পনেরো তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে, ছিনতাইকারী কিংবা আততায়ীর হাত থেকে বাঁচতে হয়তো আপনাকে দৌঁড়ানো লাগতে পারে, প্রয়োজনে একটি কঠিন কাজে আপনার হাতের শক্তির ব্যবহার লাগতে পারে, কিন্তু আপনি যদি শারীরিকভাবে দুর্বল হন, হাত এবং পায়ের মাসল, লোয়ার ব্যাক যদি শক্তিশালী না হয়, তাহলে আপনি তা কখনোই পারবেন না। চেষ্টা করতে গিয়ে হয়তো মারাত্মকভাবে ইনজুরির শিকার হবেন। আর এসব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অবশ্যই আপনাকে নিয়মিত স্বল্প পরিমাণে হলেও ব্যায়াম করতে হবে।
প্রতিনিয়ত লেগে থাকা রোগ প্রতিরোধেও নিয়মিত ব্যায়াম করা প্রয়োজন। ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনার বিশেষজ্ঞদের মতে প্রত্যেকদিন পরিমাণমতো ব্যায়ামের ফলে সাধারণ ঠাণ্ডা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা সহ ছোটখাট সব ধরনের রোগের পরিমাণ প্রায় বিশ শতাংশ কমে যায়।
এসব কথা চিন্তা করেই আজ বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে সহজ চারটি ব্যায়ামের কথা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
১) Running/দৌড়ানো
সুস্থ এবং শক্তিশালী থাকার জন্য ডাক্তারদের পরামর্শ থেকে শুরু করে জিমনেশিয়ামের ট্রেইনারের কাছ থেকে সবচাইতে বেশি বলা হয়ে থাকে দৌড়ানোর কথা। শরীরে জমা হওয়া অতিরিক্ত ক্যালরি এবং চর্বি পোড়ানোর জন্য এটি সবচাইতে সহজ এবং কার্যকরী ব্যায়াম। ২০০২ সালে নিউট্রিশন জার্নালের ‘রিলেশনশিপ বিটউইন ফিজিক্যাল এক্টিভিটি এন্ড ক্যান্সার রিস্ক’ নামের একটি সার্ভেতে বলা হয়েছে, প্রতিদিন অল্প-স্বল্প করে শরীরের ঘাম ঝরানোর কারণে ব্রেস্ট, কোলন, প্রস্টেট, ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি চল্লিশ থেকে সত্তর শতাংশ কমে যায়।
শুধু তা-ই নয়, ছত্রিশ বছর ধরে বিশ হাজার নারী এবং পুরুষের উপর পরীক্ষা করে ডেনিশ নামের একজন বিশেষজ্ঞ এবং তার দল জানিয়েছে, প্রত্যেকদিন পরিমাণ মতো দৌড়ানোর কারণে জীবনকাল পাঁচ থেকে ছয় বছরের মতো বৃদ্ধি পায়। ২০০২ সালে ‘হার্ভাড স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’এর আরেক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা দৌড়ানোর কারণে হৃদরোগ এবং ব্লাড প্রেশারের পরিমাণ প্রায় বিয়াল্লিশ শতাংশ কমে যায়। এছাড়াও ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির জন্য, হাড় ও মাসলকে শক্তিশালী করার জন্য এবং ইমিউন সিস্টেমের উন্নতি সাধনের জন্য দৌড়ের ভূমিকা অসাধারণ।
তবে দৌড়ানোর সময় কিছু ব্যাপার মাথায় রাখা উচিত। বিশেষ করে দৌড়ানোর জায়গা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের উচিত পার্ক কিংবা অতিরিক্ত যান চলাচল নেই এমন জায়গা বেছে নেওয়া। এতে করে বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া ডিহাইড্রেশন থেকে মুক্তির জন্য দৌড়ানোর সময় বোতলে করে পানি নিয়ে যাওয়া, গোড়ালির ইনজুরি এড়াতে ভালো এবং আরামদায়ক জুতা ব্যবহার করা জরুরী। বিরক্তি কাটানোর জন্য গান শোনা অথবা কথা বলার জন্য সঙ্গী খুঁজে নেওয়াও যেতে পারে।
২) Jump-rope workout/দড়ি লাফ
জিমে যেতে পারছেন না? দৌড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই? তাহলে খুব সহজে ঘরে কিংবা ছাদের ছোট জায়গাতে দড়ি লাফের মাধ্যমে আপনি মুক্তি পেতে পারেন অতিরিক্ত ক্যালরি এবং চর্বি থেকে। দড়ি লাফকে দৌড়ানোর পরিবর্তে সবচাইতে কার্যকরী ব্যায়াম হিসেবে ধরা হয়। তবে পা, বাহু, বাট, কাঁধ সহ পুরো শরীরের হাড় এবং মাসলকে শক্তিশালী করার জন্য এর জুড়ি নেই।
সাইড অ্যাবসের চর্বি কমাতে জিমনেশিয়ামগুলোতে সব সময়ই দড়ি লাফের কথা বলা হয়ে থাকে। প্রথম দিকে প্রতি এক মিনিটে পুরো দশ ক্যালোরির উপরে বার্ন করা যায় এই ওয়ার্কআউটটির মাধ্যমে। কাজটিতে দক্ষ হলে দশ মিনিটে ২০০ ক্যালোরির উপরে বার্ন করতে পারবেন খুব সহজেই। অল্প জায়গায় করা যায় বিধায় দিনের যেকোনো সময় আপনি এই ব্যায়ামটিতে সময় দিতে পারবেন।
দড়ি লাফে ব্যবহৃত দড়িটি খুব সহজেই ঘরে বানানো যায়। তবে সস্তা এবং ভালো করে ধরার জন্য গ্রিপের সুবিধা থাকায় বাজার থেকে কিনে আনাই ভালো। খালি পায়ে দড়ি লাফ করা গেলেও ছোটখাট ইনজুরি থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা হিসেবে রানিং কেডস পড়ে নিতে পারেন। প্রথম অবস্থায় তিন সেটে পাঁচ, তিন, দুই মিনিট করে দশ মিনিট কন্টিনিউ করে আস্তে আস্তে সেট সংখ্যা এবং সময় বাড়াতে পারেন।
৩) Push-up/পুশ-আপ
“If I could only do one exercise for the rest of my life, it would be the push-up.”
কথাটা বলেছিল সার্টিফাইড হেলথ এন্ড ফিটনেস ট্রেইনার সারাহ ক্লেইন। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক ফিটনেস এক্টিভিস্টরা একই কথা বলবে। কেননা পুশ-আপ হচ্ছে এমন একটি ব্যায়াম যা যেকোনো বয়সে, যেকোনো জায়গায়, যেকোনো পরিস্থিতি করা যায়। ‘শক্তি লাভের ব্যায়াম’ হিসেবে ফিটনেস ডিকশনারিতে যে কয়েকটি ওয়ার্কআউটের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে পুশ-আপ অন্যতম। মিলিটারি এক্সারসাইজ থেকে শুরু করে স্কুল/কলেজ স্পোর্টস, মার্শাল আর্ট, অ্যাথলেটিক ওয়ার্কআউটসহ প্রত্যেকটা জায়গায় এর জয়জয়কার।
বাইসেপ, ট্রাইসেপ, ফোর আর্মস, গ্রিপ, আপার বডি মাসল, ব্যাক সহ পুরো শরীরের উপরের দিকের মাসলস এবং হাড়কে শক্তিশালী করার জন্য পুশ-আপের ভূমিকা অসাধারণ। যদিও প্রাথমিকভাবে ট্র্যাডিশনাল পুশ-আপ শুধুমাত্র আর্ম, চেস্ট, শোল্ডারের ওয়ার্কআউট হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বিভিন্নভাবে মডিফাই করে নির্দিষ্ট অংশের জন্য পুশ-আপ ব্যবহার করা যায়। যেমন:
১) চেস্টের জন্য ওয়াইড-গ্রিপ, ক্লাপ এবং অ্যাটমিক পুশ-আপ।
২) ট্রাইসেপের জন্য হার্ট-শেপড এবং ন্যারো-গ্রিপ পুশ-আপ।
৩) আপার বডির কোর ওয়ার্কআউট হিসেবে সিঙ্গেল-লেগ এবং ফিট-এলিভেটেড পুশ-আপ।
৪) শোল্ডারের জন্য পাইক পুশ-আপ।
৫) পুরো শরীরের কোর ওয়ার্কআউট হিসেবে স্পাইডার ম্যান এবং টি পুশ-আপ।
এছাড়াও নানান ধরনের পুশআপ আছে। অনেক ফিটনেস ট্রেইনাররা ক্লায়েন্টের বডি শেপ কেমন হবে, তার উপর নির্ভর করেও পুশ-আপের ডিজাইন করে থাকে।
৪) Sit-up/সিট-আপ
ভুঁড়ি নিয়ে সমস্যা? ইচ্ছে হয় ঋত্বিক রৌশন, শাহরুখ খানের মতো সিক্স প্যাক, এইট প্যাক অ্যাবস করে খালি গায়ে ঘুরে বেড়াবেন? তাহলে আপনার জন্যই এই ওয়ার্কআউটটি। পেটের পেশীকে শক্তিশালী, মজবুত, মেদহীন করা সহ সুগঠিত আকার দেওয়ার জন্য এর ভূমিকা অসাধারণ।
পুশআপের মতো শুধু মাত্র ট্র্যাডিশনাল সিটআপ ‘স্ট্যান্ডার্ড কার্নেস’ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সিটআপ রয়েছে। যেমন- ওয়েটেড কার্নেস, রিভার্স কার্নেস, রাইজ লেগ কার্নেস, সুইচ বল কার্নেস ইত্যাদি।
সিটআপ উপকারী হলেও সঠিকভাবে এই ওয়ার্কআউটি না করলে লোয়ার ব্যাকের ইনজুরিতে পরার সম্ভাবনা থেকে যায়।
শুরুতেই যে কথা বলার ছিল
যেকোনো ব্যায়ামের পূর্বে আমাদের প্রত্যেকের উচিত পরিমাণ মতো ওয়ার্ম-আপ করে নেওয়া। একটি পারফেক্ট ওয়ার্ম-আপ কম্বিনেশনের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার এক্সারসাইজ, স্ট্রেচিং সহ এমন কিছু থাকে যা আমাদের শরীরের ব্লাড সার্কুলেশন বাড়িয়ে দেয়, শরীরের তাপমাত্রা এবং হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে। এগুলো পুরো শরীরের পেশী গ্রন্থিতে রক্ত পৌঁছে দেয়, দীর্ঘ সময় ব্যায়াম না করার কারণে শরীরে যে জড়তা তৈরি হয়, তা থেকে মুক্তি দেয়। এতে করে বিভিন্ন ধরনের ইনজুরি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাছাড়া শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে যে কাজটি করতে যাচ্ছেন, সেটিতে মনোযোগ দেওয়ার ব্যাপারেও ওয়ার্ম-আপ সহযোগিতা করে। আর ওয়ার্ম-আপের সময় নিয়মিত স্ট্রেচিং আপনার শরীরকে আরো বেশি ফ্লেক্সিবল করে তোলে।