ঘুম। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য এক বিষয়। মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময়ই প্রায় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। সারাদিনের কাজের শেষে ঘুমই আমাদেরকে নতুনভাবে কাজ করার শক্তি জোগায়। মোবাইল ফোনের যেমন সারাদিন চলার পর চার্জের প্রয়োজন হয় মানব জীবনেও ঘুম ঠিক সেই কাজটিই করে থাকে। ঘুমের প্রয়োজনীয়তা কি তা যে মানুষটির রাতের বেলা ঠিকমত ঘুম আসে না তাকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারা যায়। সবাই চায় দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে। তাই আজ আপনাদের সামনে নিয়ে আসা হল দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়ার বেশ কিছু দারুণ কৌশল নিয়ে। আশা করি কৌশলগুলো আপনার জীবনকে অনেকটাই সহজ করে দেবে।
জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করুন
কি শুনতে অবাক লাগছে? অবাক লাগলেও বিষয়টা সত্য। বিছানায় আরাম করে শুয়ে পড়ে জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করুন। দেখবেন আপনার মস্তিষ্ক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এ ঘটনাকে “স্লিপ প্যারাডক্স” বা, ঘুমের ধাঁধা বলে। সাইকোথেরাপিস্ট জুলি হৃস্ট বলেন, “আপনার চোখ বড় বড় করে খুলে রাখার চেষ্টা করুন। নিজেকে বলতে থাকুন যে, আমি ঘুমাব না, আমি ঘুমাব না। আমাদের মস্তিষ্ক এমন নেতিবাচক কথাগুলো ভালমত নেয় না। সুতরাং সে দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে এবং চোখের পেশিগুলো ক্লান্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে”। তবে এ সময় শুধু স্থির হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। নড়াচড়া করা বা, মোবাইল, টিভি নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এ পদ্ধতি মোটেও কাজ করবে না।
এ কথা শুধু কথার কথা নয়, বিভিন্ন গবেষণাও এমনটিই নির্দেশ করছে। ইউনিভার্সিটি অভ গ্লাসগো ইনসোমোনিয়ায় আক্রান্ত (ঘুম না আসা রোগী) রোগীদের দুটি গ্রুপে বিভক্ত করে একটি গবেষণা করেন। এক দলকে তারা বলেন তারা মোবাইল, টিভি সব চালাতে পারবে। ঘুম লাগলে ঘুমিয়ে যাবে। অপর দলের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করবে, কিন্তু টিভি দেখতে বা, নড়াচড়া করতে পারবে না। এবং ধারণা করুন তো কারা আগে ঘুমিয়ে গিয়েছিল? হ্যাঁ, যারা জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করেছিল তারাই আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ফুঁ দিয়ে বাবল তৈরির খেলা খেলুন
এটা শুনতে খুব হাস্যকর শোনানোর কথা, কিন্তু রাতের বেলা ফুঁ দিয়ে সাবানের বাবল বা, বুদ বুদ তৈরি করা আপনাকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করবে। হ্যাঁ, ছোট বেলায় ছোট প্লাস্টিকের কৌটায় যে শ্যাম্পু বা, সাবানের ফেনা দিয়ে আপনারা বুদ বুদ তৈরি করে খেলতেন সেই বাবলের কথাই বলছি। কথাগুলো বলেছেন রাচেল ম্যারি নামের একজন নিউরোলজির অধ্যাপক, যিনি বর্তমানে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন।
আসলে এ বাবল ফোলানোর বিষয়টি আর কিছুই নয়, এক ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ব্যায়াম যা খেলার ছলে আপনি করছেন। আর এই কাজটিও বেশ ছোট বাচ্চা এবং বোকাদের মত। তাই কাজটি আপনার মনকে সব চিন্তা থেকে সরিয়ে এক ধরণের প্রশান্তি এনে দেবে, যা আপনার দ্রুত এবং ভাল ঘুমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিজেই গুনে দেখুন
শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত এই ব্যায়ামটিও আপনাকে দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আরামদায়ক একটি জায়গা বেছে নিয়ে বসুন। এবার চোখ বন্ধ করুন। ৩-১৫ মিনিট ধরে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিজেই গোনার চেষ্টা করুন। আপনার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে ভুল করে বসবে। সেক্ষেত্রে আবার প্রথম থেকে গণনা শুরু করুন। নেপালের গবেষকরা খুঁজে বের করেছেন যে, এই ধ্যানটি দিনে কয়েক মিনিটের জন্য করলে তা আপনার রক্ত চাপ এবং হৃদ স্পন্দনের হার কমিয়ে দেবে। ফলে আপনার দুশ্চিন্তা কমে যাবে এবং ভাল ঘুম হবে।
খাদ্য এবং পানীয় পানের ক্ষেত্রে আরো স্মার্ট হন
সকালবেলার এক কাপ কফিও আপনার রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে। তাই কফি থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই উত্তম। বিশেষ করে ঘুমানোর ১০-১২ ঘন্টা আগে কফি পান করা যাবে না। একইভাবে ধূমপানও আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুমানোর আগে ধূমপান আরো ভয়াবহ। তাই ধূমপান এবং কফি পানের ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক হতে হবে। সন্ধ্যার পর আসলে চা এবং চকলেট খাওয়াও উচিত নয়।
রাতের ডিনারে ভরপেট খাওয়া যাবে না। তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুমানোর কমপক্ষে ২ ঘন্টা আগে ডিনার করতে হবে। ঘুমানোর কয়েক ঘন্টা আগে অ্যালকোহল গ্রহণও উচিত নয়। ঘুমানোর ঠিক আগে আগে অতিরিক্ত পানি পান করা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। তবে ঘুমের আগে হারবাল চা বা, গরম দুধ আপনার শরীরকে প্রশান্তি দেবে আর ঘুমাতে সাহায্য করবে। মধু মিশ্রিত গরম দুধে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
দৈনিক খাবার তালিকায় ট্রিপ্টোফ্যানযুক্ত খাবার রাখুন। মুরগি, মাখন, টুনা মাছ, সয়াবিনে ট্রিপ্টোফযান থাকে। তাই এ খাবারগুলো যাদের ঘুম কম হয় তাদের জন্য বেশ উপকারি।
ঘর ঠান্ডা রাখুন
ঠান্ডা ঘরে সাধারণত মানুষের ঘুম ভাল হয়। তাই ঘুমানোর সময় ঘরেরে তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করুন। দ্রুত ঘুম চলে আসবে। ৬৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট হল ঘুমানোর জন্য ঘরের আদর্শ তাপমাত্রা।
ঘুমানোর সময় সকল রকম ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করুন
ঘুমানোর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হল মেলাটোনিন। পাইনিয়াল গ্ল্যান্ডে উৎপন্ন এই হরমোন আমাদের ঘুম ঘুম ভাব আনতে সাহায্য করে। এ হরমোন আমাদের দেহে শুধু তখনই উৎপন্ন হয় যখন খুব কম আলো বা, ঘর অন্ধকার থাকে। তাই নিজের স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, টিভি এ ধরণের উজ্জ্বল ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্র থেকে ঘুমের কমপক্ষে ১ ঘন্টা আগে থেকেই দূরে থাকা উচিত। এসব ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রের আলো ঘুমের প্রচন্ড রকম ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে।