আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পানির মতোই অত্যন্ত দরকারি একটি উপাদান হলো আগুন। রান্না থেকে শুরু করে কলকারখানা- সব জায়গাতেই নানাভাবে ব্যবহৃত হয় আগুন। আধুনিক রসায়নের আগে মানুষ আগুনকে একটি মৌলিক উপাদান হিসেবেই বিবেচনা করত। অথচ এই দরকারি আগুনই কখনো কখনো হয়ে ওঠে জীবন হন্তারক। ধনী-গরিব, ছোট-বড়, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব কিছু এক নিমিষে শেষ করে দেয় এই আগুন। অথচ সামান্য সাবধানতা অবলম্বন করলে আর অর্থের লোভ ছাড়তে পারলেই আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পেতে পারে অনেক জীবন আর সম্পদ। ফায়ার সেফটি বা অগ্নি নির্বাপন সতর্কতা নিয়েই পাঠকদের সচেতন করার জন্য এই লেখাটি।
আগুন কী?
অগ্নি নির্বাপনের ব্যাপারে জানার আগে জরুরি হচ্ছে আগুন কী আর আগুন কীভাবে ছড়ায় সে ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা রাখা। আগুন মূলত দহন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো পদার্থের অতি দ্রুত জারন। দহন বিক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয় আর আগুনের তাপের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে অক্সিজেনের দুর্বল দ্বিবন্ধন ভেঙে কার্বন ডাই অক্সাইড ও বাষ্পের শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হওয়া। আগুন জ্বলবার জন্য তিনটি উপাদান অত্যাবশ্যক: অক্সিজেন, জ্বালানী ও তাপ। এই তিনটির যেকোনো একটি না থাকলে কিংবা উপাদান তিনটির মিশ্রণ একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে না থাকলে আগুন কোনোভাবেই জ্বলবে না।
একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, জ্বালানী মানে শুধু তেল, ডিজেল, পেট্রোল নয়। এক্ষেত্রে জ্বালানী হতে পারে এমন যেকোনো বস্তু যা পুড়তে পারে, অর্থাৎ তেল, পেট্রোল ছাড়াও তুলা, কাপড়, দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ, কাঠ, ইলেকট্রিক তার, দাহ্য প্লাস্টিক যেকোনো কিছুই। প্রতিটি পদার্থই আগুনে পুড়তে পারে, শুধু দরকার নির্দিষ্ট একটি তাপমাত্রায় পৌঁছানো। অক্সিজেন তো চারপাশের বাতাসে আছেই আর আগুন ধরলে তাপ এমনি উৎপাদন হচ্ছে। অক্সিজেন, তাপ আর জ্বালানীকে একত্রে বলা হয় ‘ফায়ার ট্রায়াংগেল’ বা ‘আগুনের ত্রিভুজ’। এই ত্রিভুজের যেকোনো একটিকে আলাদা করাই হলো আগুন নেভানো। তবে এ ব্যাপারে হতে হয় অত্যন্ত সাবধান। কারণ আগুনের উৎস বা জ্বালানীর উপর নির্ভর করছে কীভাবে আগুন নেভানো হবে। এক্ষেত্রে ভুল পদক্ষেপ নিলে আগুন তো নিভবেই না, উল্টো আগুন আরো বেশি ছড়িয়ে পড়বে।
আগুনের প্রকারভেদ ও অগ্নি নির্বাপন
আগুনের ইউরোপিয়ান, আমেরিকান বা অস্ট্রেলিয়ান বেশ কয়েকটি প্রকারভেদ আছে। নাম আর অল্প কিছু পার্থক্য ছাড়া মূল বিষয়গুলো সব জায়গাতেই একই। বোঝার সুবিধার্থে এই লেখায় মূলত আমেরিকান প্রকারভেদ ব্যবহার করা হবে। এই প্রকারভেদ মূলত আগুনের উৎসের উপর নির্ভর করে করা। সাধারণত আগুন নেভানোর জন্য সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত উপাদান হচ্ছে পানি। অথচ এই পানির ভুল ব্যবহার আগুন না নিভিয়ে আগুনের ক্ষয়ক্ষতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। সব ধরনের আগুন পানিতে নেভে না, বরং পানির উপস্থিতিতে আগুনের উৎস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়, ফলে আরো বেশি জায়গা আগুনের শিকার হয়। তাই আগুন নেভানোর আগে আগুনের উৎস জানা সব থেকে জরুরি। জেনে নেয়া যাক কোন ধরনের আগুনের জন্য কোন ধরনের অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা নিতে হয়।
ক্লাস এ আগুন
পাঁচ ধরনের আগুনের মধ্যে ক্লাস এ আগুনের শক্তি তুলনামূলক কম থাকে। এ ধরনের আগুনের উৎস বিভিন্ন দাহ্য কঠিন পদার্থ, যেমন- কাঠ, কাগজ, কাপড়। এ ধরনের আগুন খুব সহজেই পানির সাহায্যে নিভিয়ে ফেলা যায়। পানি ছাড়াও অগ্নি নির্বাপক ফোম, অগ্নি নির্বাপক শুকনো পাউডার কিংবা অগ্নি নির্বাপক ভেজা পাউডার। তবে এ ধরনের আগুনের ক্ষেত্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা যাবে না।
ক্লাস বি আগুন
ভয়াবহ অগ্নিকান্ডগুলোর বেশিরভাগগুলোই হয়ে থাকে ক্লাস বি আগুন অর্থাৎ দাহ্য তরল বা গ্যাস থেকে সৃষ্ট আগুন। দাহ্য তরল ও দাহ্য গ্যাস, যেমন- ইথানল, পেট্রোল, মিথেন (গ্যাস লাইনের গ্যাস), বিউটেন (সিলিন্ডারের গ্যাস) হতে পারে ক্লাস বি আগুনের উৎস। কোনো রাসায়নিক পদার্থের গুদামে বা রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার থেকে এই আগুন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে চারপাশে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে গ্যাস সহজেই ছড়িয়ে যায় আর বাতাসের অক্সিজেন তো আছেই সাহায্য করার জন্য। তাই এই ধরনের আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
এ ধরনের আগুনের ক্ষেত্রে পানি ব্যবহার করা একেবারেই নিষিদ্ধ। মনে রাখতে হবে, আগুন নেভানোর লক্ষ্যই হলো আগুনের ত্রিভুজের উপাদানগুলোকে আলাদা করা। কিন্তু বেশিরভাগ দাহ্য তরল পানির থেকে হালকা, ফলে পানি দিলে এই তরলগুলো পানির উপরে চলে গিয়ে পানির সাহায্যেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পানি উপাদানগুলোকে আলাদা তো করতেই পারে না, উল্টো আগুন ছড়িয়ে দিতেই সাহায্য করে। আর দাহ্য গ্যাস হলে পানির কিছুই করার থাকে না। পানি বাতাসের অক্সিজেনকেও আলাদা করতে পারে না। ফলে আগুন একেবারে কম না হলে নেভার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
এক্ষেত্রে অগ্নি নির্বাপক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ফোম, শুকনো পাউডার বা কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এ ধরনের অগ্নি নির্বাপকগুলো তরল বা গ্যাসকে বাতাস থেকে আলাদা করে দেয়, ফলে আগুন জ্বলার জন্য কোনো অক্সিজেনই থাকে না। হ্যালোন নামের একটি উপাদান এ ধরনের আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহৃত হলেও ওজোন স্তরের ক্ষতির কারণে হ্যালোনের ব্যবহার একেবারেই কমে গিয়েছে। শুধুমাত্র বিমানের আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে বর্তমানে হ্যালোন ব্যবহার করা হয়।
এ ধরণের আগুনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস মূলত পানি ব্যবহার করে সহজলভ্যতা আর দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আর পানি ব্যবহার করা হলেও সেই পানি অত্যন্ত উচ্চ গতিতে ছিটানো হয়, অনেকটা পানির ছোট ছোট ফোঁটা হিসেবে। এতে পানির সাহায্যে দাহ্য তরল ছড়িয়ে যায় না আবার এই ছোট ছোট পানির ফোঁটা উচ্চ তাপে বাষ্পে পরিণত হয়ে অক্সিজেন থেকে আগুনের উৎসকে আলাদা করে ফেলে। অনেক সময় পানির সাথে ফোম মিশিয়েও আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়।
ক্লাস সি আগুন
ক্লাস সি আগুন বা বৈদ্যুতিক কারণে সৃষ্ট আগুন নেভানোর ক্ষেত্রেও শুরুতেই পানি ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রথমেই বিদ্যুতের উৎস বন্ধ করে দিতে হবে। পানি ব্যবহারে আগুন নেভার সম্ভাবনা থাকলেও বিদ্যুতের লাইন বন্ধ না করে পানি ব্যবহারে আরো শর্ট সার্কিট কিংবা বৈদ্যুতিক শক লাগার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। একইসাথে পানির মতো অন্যান্য বিদ্যুৎ সুপরিবাহী কোনো পদার্থ আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে না। তবে বিদ্যুতের উৎস বন্ধ করে দিলে ক্লাস এ আগুনের মতোই সহজেই এই আগুন নিভিয়ে ফেলা সম্ভব। তবে সাবধানতার জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা শুকনো কেমিক্যাল ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু এই আগুন যদি অন্য কোনো জ্বালানীর সন্ধান পেয়ে যায় অর্থাৎ দাহ্য কোনো পদার্থের সংস্পর্শে চলে আসে তাহলে সেটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে চোখের পলকেই।
ক্লাস ডি আগুন
দাহ্য ধাতুর কারণে সৃষ্ট আগুন বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা, কারণ এ ধরনের আগুনগুলো মূলত সৃষ্টি হয় ভারী শিল্পকারখানায়। পদার্থ। লিথিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিরকোনিয়ামসহ বেশ কিছু ধাতুকে দাহ্য ধাতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ধাতু তাপ সুপরিবাহী হওয়াতে আগুনের তীব্রতা খুব বেশি হয় না। কিন্তু আগুন ধরা ধাতুর চারপাশে ধাতুর গুড়ো বা অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ থাকলে সেই আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। ধাতুর আগুনের ক্ষেত্রে পানি ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উচ্চ তাপমাত্রায় পানির সংস্পর্শে ধাতু অক্সিডাইজড হয়ে আরো বেশি তাপ ও আগুন উৎপন্ন করতে পারে। ক্লাস ডি আগুন নেভানোর একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোডিয়াম ক্লোরাইড বা গ্রাফাইটের শুকনো পাউডার।
ক্লাস কে বা কিচেন আগুন
রান্নায় ব্যবহৃত তেল থেকে সৃষ্ট আগুন। ক্লাস বি আগুন থেকে ক্লাস কে আগুনের পার্থক্য ব্যবহারে, কারণ ক্লাস বি এর দাহ্য তরলগুলো রান্নায় ব্যবহৃত হয় না। ক্লাস কে আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই সরাসরি পানি ব্যবহার করা যাবে না। গরম তেলে পানি দিলে কী অবস্থা হয় এটি পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন বলে আশা করা যায়। এ ধরনের আগুন নেভানোর সবচেয়ে উপযুক্ত অগ্নি নির্বাপক হচ্ছে অগ্নি নির্বাপক ভেজা কেমিক্যাল ব্যবহার করা। তবে আগুন যদি অল্প হয় তাহলে ফায়ার ব্ল্যাঙ্কেট ব্যবহার করা যেতে পারে। ফায়ার ব্ল্যাঙ্কেট আগুনকে বাতাস থেকে আলাদা করে দেয়, ফলে আগুন জ্বলার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না।
আগুন লাগার আগেই সতর্কতা অবলম্বন করুন
আমাদের সমাজে ফায়ার সেফটি বা অন্য যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অগ্রিম সাবধানতার ব্যাপারে খুবই প্রচলিত একটি কথা হচ্ছে, “এ ধরনের ঘটনা তো সব সময় হয় না, এর জন্য এত অর্থ খরচ করে কী লাভ!”। বাস্তবেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে খুবই কম, কিন্তু কখন, কীভাবে, কোথায় দুর্ঘটনা ঘটবে তা তো কারো জানা নেই! আর যেহেতু জানা নেই, সেহেতু কিছু অর্থের জন্য নিজের, পরিবারের, প্রতিবেশির জীবন, সারা জীবনের অর্জন আগুনে পুড়তে দেয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই আগুন লাগার আগেই আমাদের সাবধান হতে হবে।
- নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিসের ফোন নম্বর বাসার সকলের মোবাইলে সেভ করে রাখুন। কখন দরকার হবে আপনি নিজেও জানেন না, কিন্তু দরকার পড়লে নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দেবেন।
- বাসা বানানোর সময় সিড়িগুলো প্রশস্ত করুন যেন আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে সবাই তাড়াহুড়া করতে নামতে গিয়ে সিড়িতেই না মারা পড়ে।
- যদি সম্ভব হয় আলাদা ফায়ার এক্সিটের ব্যবস্থা করতে হবে, বিশেষ করে বড় শপিং মল আর অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে। এ ব্যাপারে নিজেদেরই সতর্ক হতে হবে, কারো অপেক্ষায় বসে থাকলে নিজেদেরই ক্ষতি।
- বড় শপিংমল বা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোতে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র আছে কি না খেয়াল করুন। না থাকলে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করুন। যদি তাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া না যায় তাহলে সবাই মিলে চাঁদা তুলে হলে কিনুন। আর যদি থেকে থাকে তাহলে তার মেয়াদ আছে কি না খেয়াল রাখুন। মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্র কিন্তু ভালোর থেকে খারাপ হতে পারে। সুতরাং টাকা বাঁচানোর থেকে জীবন বাঁচানোর দিকে নজর দিন।
- সকল সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত অফিস, স্কুল, কলেজসহ সব জায়গায় প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই বড় ভূমিকা রাখবে। সরকার চাইলে ফায়ার সেফটি ট্রেনিং বাধ্যতামূলকও করতে পারে।
- বাসার দরজার সামনে ভারি কিছু রাখবেন না, এতে দরকারের সময় বের হতে সমস্যা হবে।
- রান্নাঘরের জানালা একটু হলেও খোলা রাখবেন, যাতে গ্যাস লিক হলে জানালা দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। সামর্থ্য থাকলে এক্সহোস্ট ফ্যান ব্যবহার করুন। আগুন জ্বালানোর আগে কিছুক্ষণ ফ্যান ছেড়ে রাখুন।
- সামর্থ্য থাকলে বাসায়, অফিসে, অ্যাপার্টমেন্টে ফায়ার অ্যালার্ম লাগিয়ে রাখুন। প্রতি এক বা দুই মাস পর পর সেগুলো ঠিক আছে কি না চেক করুন।
- বৈদ্যুতিক সংযোগের তার অন্তত কয়েক মাস পর পর পরীক্ষা করান অভিজ্ঞ লোক দিয়ে। টাকা বাঁচাতে গিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড বা নকল সুইচ, সকেট, তার ব্যবহার করবেন না। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা ব্যবস্থা করে রাখবেন তাহলে।
- সিএনজি চালিত গাড়ি কিংবা সিএনজি থাকলে সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষা করান এবং মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে পরিবর্তন করুন। কয়েক হাজার টাকা বাঁচাতে গিয়ে লাখ টাকার গাড়ি আর নিজের জীবনের ঝুঁকি নেবার কোনো মানেই হয় না। সেই সাথে রাস্তায় আপনার গাড়ি বিস্ফোরণে অন্যদের বিপদে ফেলার সম্ভাবনাও তো বাদ যায় না।
- কোনো অবস্থাতেই রাসায়নিক দ্রব্যের দোকান বা গোডাউন আবাসিক এলাকায় করতে দেবেন না। বাসার মালিক আপনি না হতে পারেন, কিন্তু আগুন মালিক বা ভাড়াটিয়া চেনে না, এমনকি প্রতিবেশীও চেনে না। সুতরাং নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই টাকার লোভে আবাসিক এলাকায় এ ধরনের দোকান ভাড়া দেয়া বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আগুন লাগলে কী করবেন
সকল সতর্কতার পরেও যদি আপনার বাসভবনে বা পাশের কোনো ভবনে আগুন লাগলে তাহলে কোনোভাবেই আতঙ্কিত হবেন না। মাথা ঠান্ডা রেখে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি ভুল পদক্ষেপ আপনার কিংবা পুরো পরিবারসহ সকলের জীবনের বিপন্ন হতে পারে। টাকা-পয়সা, টিভি, মোবাইল, দলিলপত্র সবকিছুর কথা ভুলে যান এ সময়। প্রচুর মানুষ আগুন লাগার পর ‘দরকারি’ জিনিসপত্র বের করতে গিয়ে সবচেয়ে দরকারি জীবনটাই হারায়।
- যদি আপনার পাশের কোনো ভবনে আগুন লাগে তাহলে ছবি তোলা বা ভিডিও না করে তৎক্ষণাৎ ফায়ার বিগ্রেড বা ৯৯৯ এ কল করুন।
- চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করে দিন।
- আশেপাশের ভবনগুলো থেকে সবাইকে বের করে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন।
- বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিসে যোগাযোগ করে এলাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস বন্ধ করে দিতে বলুন।
- উদ্ধারকর্মীদের যথাসম্ভব সাহায্য করুন।
আর আপনি নিজেই যদি আগুনে আটকা পড়েন তাহলেও আপনাকে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।
- আপনার ভবনের ঠিক কোথায় আগুন লেগেছে সেটি বোঝার চেষ্টা করুন। ফায়ার বিগ্রেড, ৯৯৯ এ ফোন করুন যত দ্রুত সম্ভব।
- প্রশিক্ষণ না থাকলে আগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাবেন না।
- ঘরের জানালা, দরজা দ্রুত বন্ধ করে ফেলুন। ঘরে বাতাস ঢোকার সকল পথ বন্ধ করে দিন। বেশিরভাগ মানুষ আগুন লাগলে জানাল খুলে রাখে যেটি একটি বিশাল ভুল। আপনি জানালা খুলে দিলেন মানে আগুনকে দাওয়াত দিচ্ছেন অক্সিজেন দিয়ে আপনাকে পুড়িয়ে মারার। জানালা খোলা মানে আরো অক্সিজেন, আগুন যতক্ষণ অক্সিজেন পাবে জ্বলতেই থাকবে।
- যদি পালানোর মতো অবস্থা থাকে তাহলে দ্রুত বেরিয়ে যান সম্পদের লোভ বাদ দিয়ে। পালাতে গিয়ে উঁচু ভবন থেকে লাফ দিবেন না। যেটুকু বাঁচার সম্ভাবনা ছিল সেটাও আপনি নষ্ট করছেন। বের হবার আগে প্রতিটি দরজা খোলার আগে হাত দিয়ে তাপ অনুভব করুন। আগুন কাছাকাছি থাকলে দরজা গরম থাকবে, সেক্ষেত্রে বের হওয়া মানে আগুনে ঝাঁপ দেয়া। যদি ঠান্ডা থাকে তবুও দরজা ধীরে ধীরে খুলুন। চোখ, কান খোলা রেখে বের হন। বের হবার পর প্রতিটি দরজা লাগিয়ে রাখুন।
- উঁচু ভবন থেকে বের হবার ক্ষেত্রে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। ভুল করেও লিফটে উঠবেন না।
- যদি বের হবার বা পালানোর সুযোগ একেবারেই না থাকে তাহলে যতভাবে সম্ভব আগুনকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন। দরজা-জানালা হয়তো বেশিক্ষণ আগুনকে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু যতক্ষণ দরজা-জানালা লাগানো থাকবে আগুন আপনার কাছ থেকে দূরে থাকবে, বাতাস পেলেই আগুন আপনার কাছে চলে আসবে।
- দাহ্য পদার্থ থেকে দূরে থাকুন। কাঠ, কাপড়, তুলা থেকে যতটা দূরে সম্ভব অবস্থান করুন।
- যদি ধোঁয়া দেখেন তাহলে শুয়ে পড়ুন। যতটা সম্ভব নিচু হয়ে থাকা সম্ভব থাকুন।
- যদি কোনোভাবে গায়ে আগুন লেগে যায় তাহলে ভুল করেও দৌড় দিবেন না। দৌড় দেয়া মানেই আপনি আগুনকে অক্সিজেনের সাপ্লাই দিচ্ছেন। শুয়ে পড়ুন, গড়াগড়ি দিতে থাকুন। অক্সিজেনের অভাবে আগুন নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে।
- কারো গায়ে আগুন ধরা দেখলে তাকে ফায়ার ব্লাঙ্কেট বা ভারি কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে গড়াগড়ি দিতে বলুন।
প্রতিটি বড় দুর্ঘটনা একটি শিক্ষা দিয়ে যায়, সেই সাথে আমাদের ভুলগুলোকেও দেখিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেবার বদলে আমরা ব্যস্ত থাকি সরকার, বাড়ি মালিক, দোকান মালিক, ফায়ার সার্ভিস কিংবা আমজনতাকে দোষারোপ করতেই। আর সোশ্যাল মিডিয়া তো রয়েছেই এসবের জন্য। অথচ সবচেয়ে দরকারি কাজটিই কেউ করে না! কেউ সাবধান হয় না, কেউ ভুল থেকে শিক্ষা নেয় না। সবাই ভেবে বসে থাকে, আমার এখানে তো হবে না! টাকা বাঁচানোর জন্য আমরা ফায়ার স্কেপ বানাই না, সিঁড়ির প্রস্থ ছোট করি, ফায়ার অ্যালার্মের ব্যবস্থা করি না, অগ্নি নির্বাপনের কোনো ব্যবস্থাই করি না! বাসার নিচে রাসায়নিক দ্রব্যের দোকান দিতে দেই, গোডাউন করতে দেই। অথচ একবারও ভাবি না- এই অর্থ কতদিন? আগুন লাগলে এই অর্থ, এই সম্পদ কি কোনো কাজে আসবে?
আপনি যদি ধর্মে বিশ্বাসী হন, সেটা যে ধর্মেই হোক, মনে রাখবেন, আপনার গাফিলতি কিংবা লোভের কারণে লাগা আগুনে প্রতিটি মৃত্যুর হিসেব আপনাকে দিতে হবে একদিন। আর ধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী যা-ই হন না কেন, নিজের বিবেকের কাছেই প্রশ্ন করুন, আপনি কি ঠিক করছেন? আপনি কি প্রস্তুত আপনার গাফিলতি, টাকা বাঁচানো কিংবা লোভের ফলে মারা যাওয়া মানুষগুলোর মৃত্যুর দায়ভার নিতে? তাদের পরিবারের বাতাস ভারি করা কান্নার দায় নিতে কি প্রস্তুত আপনি? কিংবা আপনার নিজের আর আপনার পরিবারের মৃত্যুর দায়ভার নিতে? নিজেরা ঠিক না হলে সরকার হাজার চেষ্টা করেও আমাদের শোধরাতে পারবে না। মনে রাখবেন, পরবর্তী নিমতলা বা চকবাজার হতে পারে আপনার এলাকা, আপনার নিজের বাসা। এখনও সুযোগ আছে আমাদের শোধরানোর, কোনোভাবেই উচিৎ হবে না সেই সুযোগ হেলায় নষ্ট করার।