বেশ বড় একটা সমস্যায় পড়েছে সাজিদ (ছদ্মনাম)। সমস্যাটি তার প্রেমিকাকে নিয়ে। মেয়েদের সৌন্দর্যের মানদন্ড কী কী, সে ব্যাপারে খুব ভালো ধারণা নেই তার। শুধু সে জানে, তার প্রেমিকা অনেক সুন্দরী। এবং প্রেমিকার কাছে নিয়মিতই সে তার সৌন্দর্যের প্রশংসাও করে। কিন্তু কেন যেন, তার প্রশংসাকে একদমই গুরুত্ব দেয় না তার প্রেমিকা। যখনই সে প্রেমিকার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে, প্রেমিকা নিজে থেকেই নিজের বিভিন্ন খুঁত বের করতে থাকে, এবং নিজেকে অসুন্দরী বা কুৎসিত দাবি করতে থাকে।
এ থেকে মাঝে মধ্যেই সাজিদের মনে হয়, মেয়েদের সৌন্দর্য সম্পর্কে সে বুঝি একেবারেই আনাড়ি। তাই না বুঝেই প্রেমিকাকে বারবার সুন্দরী বলে তাকে পরোক্ষভাবে অপমানিত করে ফেলছে সে। তাই বারবারই সে ভাবে, এরপর থেকে আর কখনো সে প্রেমিকার সৌন্দর্যের ব্যাপারে কথা বলবে না।
কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা সাজিদের পক্ষে রাখা সম্ভব হয় না। কারণ, যখনই কোনো সুন্দরী মেয়েকে সামনে থেকে হেঁটে যেতে দেখে, তার প্রেমিকা বলে ওঠে, “ইস! মেয়েটা কত সুন্দর। আমি যদি ওর মতো হতে পারতাম।” সাজিদ তখন ভালোভাবে চেয়ে দেখে, যে মেয়েটার কথা বলা হচ্ছে, সেই মেয়েটা সুন্দরীই বটে, কিন্তু তার প্রেমিকার মতো সুন্দরী নয় অবশ্যই। তাই ফের তাকে নিজের প্রতিজ্ঞা ভেঙে, প্রেমিকাকে বলতে হয়, “তুমি অবশ্যই ওর থেকে বেশি সুন্দর।”
তবে তাতেও কাজ হয় না খুব একটা। সাজিদের মুখে প্রশংসা শোনামাত্রই প্রেমিকা ভাঙা রেকর্ডের মতো আবারো নিজের একটার পর একটা খুঁত বের করতে থাকে। আর অসহায়ভাবে সাজিদকে সেগুলো শুনে যেতে হয়। কেননা প্রেমিকার কথার সাথে সে একমত নয় বটে, কিন্তু তার কাছে পর্যাপ্ত যুক্তিও নেই যার মাধ্যমে সে প্রেমিকার যুক্তিগুলোকে খন্ডন করে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করবে। আবার সে যদি অধৈর্য হয়ে বলেও বসে, “আচ্ছা ঠিক আছে, ওই মেয়েটা তোমার থেকে বেশি সুন্দর,” তাহলেও বিপদ। প্রেমিকা তখন মনে কষ্ট পাবে। এমনকি এটাও বলে বসতে পারে, “তাহলে দেখলে তো, তুমিও ঠিকই মনে করো, অন্য মেয়েরা আমার চেয়ে বেশি সুন্দর!”
সব মিলিয়ে সাজিদের এখন জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা। সে বেশ ভালোই বুঝতে পারে যে, তার প্রেমিকার মধ্যে নিজের সৌন্দর্যের ব্যাপারে একধরনের নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ‘বিউটি ইনসিকিউরিটি’। কিন্তু সে জানে না, এমতাবস্থায় তার আসলে কী করণীয়।
যা-ই হোক, সাজিদ বা সাজিদের মতো এমন সমস্যার ভুক্তভোগী যারা, তারা একটি তথ্য জেনে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারেন যে, আপনাদের প্রেমিকা বা কাছের মানুষটিই (নারী) একা নয়, যে নিজের সৌন্দর্যের ব্যাপারে এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আদতে, পৃথিবীর প্রায় সকল নারীর মধ্যেই নিজের সৌন্দর্যের ব্যাপারে এমন নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে।
২০১০ সালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা করেছিল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নারী প্রসাধনী প্রস্তুতকারক ব্র্যান্ড, ডাভ। তাদের গবেষণার ধরনটি ছিল বেশ অদ্ভূত। তাদের এই গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এফবিআইয়ের স্কেচ আর্টিস্টরা, যারা কোনো ব্যক্তির চেহারার বর্ণনা শুনে হুবহু তা এঁকে ফেলতে পারেন। ১৮-৬৪ বছর বয়সী ৬,৪০০ জন নারী এই গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন।
একটি ঘরে স্কেচ আর্টিস্টরা অপেক্ষা করছিলেন। এবং সেখানে একে একে অংশগ্রহণকারী নারীরা আসছিলেন। কিন্তু স্কেচ আর্টিস্ট ও আগত নারী একে অপরকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। প্রত্যেক নারী স্কেচ আর্টিস্টের কাছে নিজেদের চেহারার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, এবং সে অনুযায়ী স্কেচ আর্টিস্ট ওই নারীর মুখের স্কেচ আঁকছিলেন। এরপর আবার অন্য কোনো অপরিচিত ব্যক্তি এসে আগের নারীটিরই বর্ণনা দিচ্ছিলেন, এবং সে অনুযায়ী স্কেচ আর্টিস্ট আবারো তার স্কেচ আঁকছিলেন।
শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, কোনো নারীর নিজের বর্ণনা থেকে অঙ্কিত স্কেচ, আর অন্য কারো বর্ণনা থেকে অঙ্কিত স্কেচের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। অধিকাংশ নারীই স্কেচ আর্টিস্টের কাছে নিজের বর্ণনা খুব বাজেভাবে দিয়েছেন, নিজের অসংখ্য খুঁতের কথা বলেছেন, যার ফলে সেই বর্ণনা থেকে অঙ্কিত স্কেচগুলো দেখতেও বেশ বাজে হয়েছে। অথচ ভিন্ন কোনো ব্যক্তি যখন ওই একই নারীর বর্ণনা দিয়েছেন, তখন তারা অহেতুক বিভিন্ন খুঁতের বিবরণ না দিয়ে, যথাসম্ভব প্রকৃত রূপের বর্ণনা দিয়েছেন, যে কারণে সে বর্ণনা অনুযায়ী অঙ্কিত স্কেচটির সাথে ওই নারীর প্রকৃত চেহারার বেশি মিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত এ গবেষণা থেকে যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছে, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। মাত্র ৪ শতাংশ নারী নিজেকে সুন্দরী বলে মনে করেন। অর্থাৎ বাকিরা যদি আসলেও সুন্দর হয়ে থাকেন, তবু তারা সেই সৌন্দর্য স্বীকার করেন না, বরং অন্যের কাছে নিজেদেরকে অসুন্দর দাবি করে থাকেন। আর ৫৪ শতাংশ নারীই পরবর্তীতে এ-ও স্বীকার করেন যে, সৌন্দর্যের প্রশ্নে অন্য কেউ নয়, তারা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় সমালোচক। অর্থাৎ, লোকে কী বলবে তা নিয়ে তারা যতটা না ভাবিত, তারচেয়ে বেশি ভাবিত নিজের মনগড়া নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে।
এ গবেষণা থেকে আরো জানা যায় যে, ৫৯ শতাংশ নারীই স্বীকার করেন তারা সুন্দরী হওয়ার জন্য একধরনের চাপ অনুভব করেন। ৩২ শতাংশ নারী আবার স্বীকার করেন যে, সুন্দরী হওয়ার জন্য তারা যে চাপ অনুভব করেন, তা তাদের উপর অন্য কেউ চাপিয়ে দেয়নি, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সেই চাপ অনুভব করতে শুরু করেছেন।
এ গবেষণা আমাদের আরো একটি ভুল ধারণাও ভেঙে দেয় যে, কোনো নারীর সুন্দরী হওয়ার জন্য অনুভূত চাপের জন্য সমাজ কিংবা গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই কম। মাত্র ১২ শতাংশ নারীকে সুন্দরী হওয়ার জন্য সমাজ চাপ দেয়, ৬ শতাংশ নারীকে গণমাধ্যম চাপ দেয়, আর সমান ৬ শতাংশ নারীকে চাপ দেয় তাদের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যরা।
এখানেই শেষ নয়। নারীরা নিজেদের সৌন্দর্যের ব্যাপারে চাপ অনুভব করেন এবং নিজেদেরকে সুন্দরী বলে মানতে চান না তো কী হয়েছে, অন্য নারীদের বেলায় কিন্তু সেই তারাই সৌন্দর্যের কোনো না কোনো উপাদান ঠিকই খুঁজে পান, যে কারণে সেসব নারীকে তারা নিজেদের চেয়ে বেশি সুন্দরী বলে মনে করেন। গবেষণার ফলাফল বলছে, ৮০ শতাংশ নারীই অন্য নারীর মাঝে যে সৌন্দর্য খুঁজে পান, সে সৌন্দর্য তারা তাদের নিজেদের মাঝে খুঁজে পান না।
এখন অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন নারী অন্য নারীর মাঝে ঠিক কোন সৌন্দর্য দেখতে পান, যা তারা নিজের মাঝে দেখতে পান না? সত্যি বলতে, সবকিছুই। ধরা যাক, একজন নারী প্রথম দেখাতেই অন্য কোনো নারীর চোখের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কিন্তু আপনি যদি তাকে বলতে চান যে তার চোখও তো সুন্দর, তখন তিনি সেটি মানবেন না। তিনি বলবেন, তার চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, তার চোখের কাজল লেপটে গেছে, কিংবা অন্য যেকোনো কিছু। আবার ওই নারী হয়তো নির্দ্বিধায় অন্য কোনো নারীর চুলের প্রশংসা করবেন, অথচ নিজের চুলের ব্যাপারে তিনি বলবেন, তার চুলে জট লেগেছে, চুল পড়ে যাচ্ছে, চুল উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে ইত্যাদি।
অথচ মজার ব্যাপার কী জানেন, দুজন নারীকে যদি পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে গভীরভাবে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে দুজনের মাঝেই কম-বেশি খুঁত রয়েছে বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দুজনেই সমান সৌন্দর্যের অধিকারী। কিন্তু একজন নারী বলার সময় কেবল নিজের খুঁতগুলোকেই প্রাধান্য দেবেন, কিন্তু অন্য নারীর খুঁতগুলোকে এড়িয়ে যাবেন। এর কারণ কী? কারণ হলো আত্মনিমগ্নতা। একজন নারী নিজের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন, এবং তিনি চান যেন তার সবকিছুই যথাযথ থাকে, আতশকাঁচ দিয়ে খুঁজেও তার কোনো খুঁত বের করা না যায়। এবং এ কারণেই নিজের সৌন্দর্যের ব্যাপারে তিনি কখনো সন্তুষ্ট হন না। কিন্তু অন্য নারীর ক্ষেত্রে তিনি এত বেশি গুরুত্ব কখনোই দেন না। একপলক দেখেই তিনি রায় দিয়ে দিতে পারেন যে, সেই নারীটিকে ভালো দেখাচ্ছে।
তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, নারীদের সৌন্দর্য নিয়ে যত দুশ্চিন্তা, তার অধিকাংশই তাদের নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা ও আত্মনিমগ্নতার ফসল। এই দুই ঘাতকের হাত থেকে যদি রক্ষা পাওয়া যায়, তাহলে সকল নারীই নিজের সৌন্দর্যের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। কেননা, আদতে কোনো নারীই তো অসুন্দরী নন। সকলেই তার নিজের মতো করে সুন্দরী। স্রেফ নিজের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস না থাকার ফলেই, তাদেরকে সব সময় সৌন্দর্য নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়।
তাই সকল নারীর প্রতি অনুরোধ থাকবে, নিজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে স্বীকার করুন, সেটিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিন। স্রষ্টা যেভাবে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, সেভাবেই আপনি সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। হ্যাঁ, নিজের মনের সন্তুষ্টির জন্য আপনি অবশ্যই রূপচর্চা করতে পারেন, নিজের পরিচর্যা করতে পারেন, কিন্তু সেগুলো যেন কখনো এত বেশি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে না যায় যে, আপনার নিজের কাছেই পরবর্তীতে মনে হয় কৃত্রিমতাই আপনার সৌন্দর্যের মূল উৎস, বাস্তবিক আপনি অত বেশি সুন্দরী নন।
পাশাপাশি নিজের মা, বোন, প্রেমিকা, স্ত্রী কিংবা অন্য নারী আপনজনদের মাঝে সৌন্দর্য বিষয়ক আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দেয়ার ক্ষেত্রে পুরুষরাও পালন করতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাদের সৌন্দর্য বিষয়ক নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ঠাট্টা না করে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে তাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করুন, কী কারণে তারা এক ও অদ্বিতীয়, সেটি তাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিন। সর্বোপরি, তাদেরকে অনুভব করান যে তারা আসলেই সুন্দরী, সুতরাং সৌন্দর্য নিয়ে তাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই।
মানুষের মনের সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বিকশিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায়, আমরা যেন কোনোভাবেই নিজেদের আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যকে গলা টিপে মেরে না ফেলি।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/