আমাদের সাধারণ জনগণের এ কথা মনেই থাকে না যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুঁদে রাজনৈতিকরা ক্ষমতায় আরোহণের পূর্বে অন্য সব সাধারণ মানুষের মতোই ছিল তাদের জীবনযাত্রা। এ কথা সত্যি যে, তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলে আস্ত একেকটা দেশ। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির এসব নামজাদা রাষ্ট্রনেতার শখের কথা শুনলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। কোনো রাজনীতিবিদের যেমন সঙ্গীত প্রিয়, কেউ আবার কমিক্স বইয়ের পোকা, কেউ বা সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিতদের সঙ্গে ক্যারাটের তালিম নেন নিয়মিত, কেউ আবার থাকেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের নেশায় মেতে। তেমনই কিছু বর্তমান ও অতীতের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের আজব যত শখের কোলাজ দিয়ে সাজানো আজকের লেখা।
বারাক ওবামা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বাস্কেটবল এবং স্কিট শ্যুটিং যে প্রিয় শখ, তা অনেকেরই জানা। কিন্তু তার কমিক্স প্রেমের কথা সম্ভবত কারও জানা নয়! ২০০৯ সালে বিষয়টি সকলের সম্মুখে আসে যখন তিনি আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করেন।
কমিক্স চরিত্র স্পাইডারম্যানের অনেক বড় ফ্যান তিনি। স্পাইডারম্যানের সব ক’টি সংখ্যাই রয়েছে ওবামার ব্যক্তিগত সংগ্রহে। তবে ‘স্পাইডারম্যান’ ফ্র্যাঞ্চাইজির সিনেমার প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই তার। কমিক্সেই তিনি স্বচ্ছন্দ। তার স্পাইডারম্যান প্রেমের কথা মার্কিন মিডিয়ার অজানা ছিল না। সেই কারণেই মার্কিন সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় ওবামা এবং স্পাইডারম্যানকে নিয়ে রসিক ছবি প্রকাশ করার ঘটনা হয়ে উঠেছিল নিত্যদিনের সাধারণ ব্যাপার।
জুনিকিরো কুইজমি (জাপান)
জাপানের এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তার নানা অদ্ভুত স্বভাবের জন্য কম বেশি সকলের কাছে পরিচিত। তার মাথার ধূসর চুল অনেকের কাছেই আকর্ষণীয়। এসব কিছুকে ছাপিয়ে তার আরেকটি শখের কথা অনেককেই বিমোহিত করেছে। তিনি গায়ক এলভিস প্রিসলির একজন একনিষ্ঠ ফ্যান। এক কথায় বলতে গেলে প্রিসলির অন্ধ ভক্ত কুইজমি। এলভিস প্রিসলির নতুন গানের সিডি রিলিজ পাওয়ার সাথে সাথেই তা সংগ্রহ করে রাখতেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই দুইজনে জন্ম তারিখও একই, ৮ জানুয়ারি।
জোসেফ স্তালিন (পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন)
জোসেফ স্তালিন, সেই সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা। কিন্তু তার ছিল এক অদ্ভুত শখ। সেটা হলো, নগ্ন পুরুষের শরীরের প্রতিকৃতি আঁকা। তার ক্ষমতায় থাকার সময়ে তো বটেই, তারপরেও একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত স্তালিনের এমন শিল্পীসত্ত্বার কথা জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়নি। এমনকি, স্তালিনের নগ্ন ছবি আঁকার অভ্যেসের কথা জানাজানি হওয়ার পরও তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের তরফ থেকে সে কথা স্বীকার করা হয়নি। তবে ছবিগুলো যে স্তালিনেরই আঁকা, বিশ্বের সকল শিল্পবোদ্ধারা একসাথে আওয়াজ তোলার পর সেই সময়ের সরকার প্রধান তা মেনে নিতে বাধ্য হন। শোনা যায়, ক্রেমলিনের অনেক কর্মীকেই নাকি স্তালিনের নির্দেশে তার নগ্ন মডেল হতে হয়েছিল। স্তালিনের এহেন ‘ন্যুড আর্ট’ প্রীতির কারণটা যে কী, তা অবশ্য জানা যায় নি।
সিলভিও বার্লুসকোনি (ইতালি)
ইতালির প্রাক্তন এই প্রধানমন্ত্রীর নারী প্রীতি নিয়ে যত আলোচনা বা সমালোচনা হয়, তার অন্যরকম শখ নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। তিনি পুরোদস্তুর একজন সঙ্গীত প্রিয় মানুষ। তিনি যেমন ভালো গান করতে পারেন, তেমনি পিয়ানো থেকে শুরু নানা ধরনের গিটার বাজাতেও সমান পারদর্শী। কলেজে অধ্যয়নকালীন তিনি রীতিমতো কুজে স্টেজ পারফরম্যান্স করতেন তার আর্থিক ব্যয় মেটানোর জন্য। কলেজে কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে তার লেখা ও সুরে ভালোবাসার গান সমগ্র নিয়ে একটি সিডি প্রকাশেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কে বলতে পারে! ইতালির রাজনীতিতে প্রবেশ না করলে হয়তো গানই তার জীবনের প্রধান অবলম্বন হত।
ভ্লাদিমির পুতিন (রাশিয়া)
তার দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে এমনিতে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না। তবে শোনা যায়, অবসর সময়ে বন্যপ্রাণী শিকারই নাকি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একান্ত বিনোদন। সে কারণে মাঝে মধ্যেই কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে সাইবেরিয়ার গহীন জঙ্গলে মন্ত্রী-সামন্ত নিয়ে পাড়ি দেন পুতিন। যতক্ষণ অবধি তিনি কোনও প্রাণী শিকার করতে না পারছেন, ততক্ষণ নাকি ফেরার কথা মুখেও আনেন না। এ তো গেল তার শিকারের শখ। এই শখের পাশাপাশি কারাতের প্রতিও পুতিনের দুর্বলতা রয়েছে বলে জানা যায়। ১১ বছর বয়স থেকে তিনি কারাতের প্রশিক্ষণ নিতেন, পেয়েছেন কারাতের ব্ল্যাক বেল্ট। এমনকি রামিয়ার মার্শাল আর্টে তিনি স্যাম্বো চ্যাম্পিয়ন। তাই কখনও কখনও অবসরে কারাতে অভ্যাস করেন। নিয়মিতভাবে রুশ সেনাদের সঙ্গে কারাতের তালিমও নেন।
জ্যাক শিরাক (ফ্রান্স)
ফ্রান্সের এই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সুমো কুস্তির একজন দুরন্ত ফ্যান। তিনি এক ম্যাগাজিনে এ কথা স্বীকার করেন যে, তিনি যদি রাজনীতিবিদ না হতেন, তবে সুমো কুস্তিতে নিজের নাম লেখাতেন। এখন তার নেশা এই কুস্তির বিভিন্ন শো দেখা। এমনকি তিনি জাপান থেকে এই খেলার সিডি সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। আর মেক্সিকোর বিয়ার হাতে সোফায় বসে এই প্রাচীন খেলার সিডি চালিয়ে তার আনন্দে ডুবে থাকেন শিরাক।
কিম জং-ইল (উত্তর কোরিয়া)
উত্তর কোরিয়ার এই স্বৈরাচারী শাসকের শৈশবে স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে একজন নামীদামী বাস্কেটবল খেলোয়াড় হবেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন কখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাতে কী! কিমের বাস্কেটবল প্রীতি এমন পর্যায়ে ছিল যে, দেশের হোক বা বিদেশের, যে কোনো দেশের বাস্কেটবল ম্যাচ তিনি কখনো মিস করতেন না। কখনো যদি প্রশাসনিক কাজের চাপে লাইভ খেলা দেখার সময় না পান, তার নির্দেশ থাকত সেই ম্যাচের ভিডিও রেকর্ড যেন যথাযথভাবে করা হয়। পরে অবসর সময়ে সেই ভিডিও দেখতেন কিম। এই বাস্কেটবল প্রেমের কারণে, কিম চেয়েছিলেন কিংবদন্তি বাস্কেটবল খেলোয়াড় মাইকেল জর্ডান একবার অন্তত উত্তর কোরিয়ায় আসুন। কিন্তু কিমের স্বৈরাচারের প্রতিবাদ জানিয়েই উত্তর কোরিয়ায় পা রাখেননি জর্ডান।
নিকোলাস সারকোজি (ফ্রান্স)
ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির শখ হলো বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহ করা। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর নানা দেশের জন্য আলাদা আলাদা অ্যালবামও রয়েছে সারকোজির ডাকটিকেটের এই সংগ্রহশালায়। এমন একটা সময় ছিল, যখন কোনো দেশের ডাকটিকিট তার দফতরে পৌছামাত্র সেটা সোজা পৌঁছে যেত সারকোজির কাছে। প্রেসিডেন্টের এমন শখের কথা ফ্রান্সের আমলা পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষ কারো কাছেই আর অজানা নয়। এ কারণে একটি রসিকতাও প্রচলিত আছে ফ্রান্সের আমলা মহলে- “নিকোলাস সারকোজির গুডবুকে নাম লেখাতে চান? বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিটের কোলাজ বানিয়ে প্রেসিডেন্টকে উপহার দিয়ে দিন। তাহলেই কাজ হয়ে যাবে!” প্রসঙ্গত, ব্রিটেনের রানীও নাকি একবার সারকোজিকে ব্রিটিশ ডাকটিকিটের একটা কোলাজ উপহার দিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়েছিল কিনা, সেই খবর অবশ্য আজও অজানা!