‘বিষে ভরা বিশ’ সাল শেষ হয়ে গেলেও কোভিড-১৯ এর প্রভাব কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বজুড়ে বেশ কয়টি ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করে গেলেও, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে এখনও বেশ লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে। ব্যবসাক্ষেত্র থেকে চাকরির বাজার সকল ক্ষেত্রেই ধ্বস নামিয়ে দিয়েছে এবারের মহামারি। তবে ২০২০ সালে এমন কিছু ব্যবসা ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে যা হয়তো এই মহামারি না আসলে আমরা চিন্তাও করে দেখতাম না। বরং বলা যায় মহামারি এই ব্যবসা ক্ষেত্রগুলোর জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে!
বাসা থেকে অফিসের কাজ করা, অনলাইন পণ্য ডেলিভারি সিস্টেম, ই-কমার্স এবং এফ-কমার্সের প্রসার, টেলিমেডিসিন সুবিধা, অনলাইন এডুকেশন প্লাটফর্মসহ এমন নানাবিধ নতুন মাধ্যমের দেখা আমরা পেয়েছি কোভিড-১৯ এর দোহাই দিয়ে।
২০২০ সালে এ সকল মাধ্যমের অধিকাংশই হয় নতুন করে শুরু হয়েছে কিংবা নিজেরা নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছে। আর ২০২১ সালে এসকল মাধ্যমের জন্য সুযোগ রয়েছে নিজেদের আবার মেলে ধরার। তাই এখানে এমন ৬টি ব্যবসা ক্ষেত্র নিয়ে কথা বলবো যেখানে কোভিড-১৯ এর প্রভাব একটি আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করতে পারে।
১. ওষুধ বাণিজ্যের প্রসার
কোভিড-১৯ এর সময় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে ওষুধ নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনাভাইরাস আসার পরপরই পুরো বিশ্বে টেস্টিং কিটের ব্যাপক চাহিদা দেখা দেয়। বিশ্বব্যাপী এই সংকট নিরসনে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানই টেস্টিং কিট প্রস্তুতের উপর নজর দেয়। পাশাপাশি প্রতিনিয়তই র্যাপিড টেস্টের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেদিক বিবেচনায় এখনও অনেক প্রতিষ্ঠান এই চাহিদা নিরসনে কাজ করছে।
তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রটি। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফাইজার এবং যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মডার্না mRNA ভিত্তিক টিকা বাজারে নিয়ে আসলেও সেটি এখনও ব্যাপক বিস্তারের মুখ দেখেনি। বরং অনেক দেশেই এই টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশের ওষুধ নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও চেষ্টা করছে নিজেদের প্রস্তুতকৃত টিকা বাজারে নিয়ে আসার। তাই নিশ্চিতভাবেই ওষুধ বাণিজ্যের জন্য ২০২১ সাল স্মরণীয় হয়ে থাকতে যাচ্ছে।
২. রিমোট ওয়ার্কিং বা ঘরে থেকে কাজ
২০২০ সালের অভিজ্ঞতার পর অনেক প্রতিষ্ঠানই ভাবতে শুরু করেছে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আদৌ কোনো নির্দিষ্ট অফিসের প্রয়োজন আছে কিনা। কারণ কোয়ারাইন্টাইনের জন্য ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের ব্যবহার ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মিত অফিস মিটিং থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান কর্মসূচী সবই এখন বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে করা সম্ভব হচ্ছে। আর এজন্য জুম, গুগল মিটের মতো ভিডিও কনফারেন্সিং প্লাটফর্মগুলো ব্যাপক আকারে ব্যবহার হচ্ছে।
আর অনলাইন কনফারেন্সিংয়ে সুবিধার জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলোও বিভিন্ন অফার দিচ্ছে। সবমিলিয়ে রিমোট ওয়ার্কিংয়ের প্রভাব সামনের দিনগুলোতে ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাবে। যদিও এটি সম্পূর্ণরূপে অফিসের কাজকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না, তবে যেসব ক্ষেত্রে অফিসে কর্মচারী না রাখলেও চলে, সে সব ক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠান এই রিমোট ওয়ার্কিং এর সুবিধা নিচ্ছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অফিস ভাড়া নিতে হচ্ছে না, অন্যদিকে সীমিত সংখ্যক কর্মচারী দিয়ে কাজ হয়ে যাওয়ায় খরচের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। তাই ২০২১ সালে উল্লেখ সংখ্যক প্রতিষ্ঠান রিমোর্ট ওয়ার্কিং বা বাসা থেকে কাজ করার দিকে ঝুঁকে পড়বে।
৩. কন্টাক্টলেস ডেলিভারি সার্ভিস
কোভিড-১৯ মহামারীর মাঝে অধিকাংশ কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও বেড়েছে বিভিন্ন ডেলিভারির কাজ। ওষুধপত্র থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিংবা প্রস্তুককৃত খাবার সবক্ষেত্রেই ক্রেতারা এখন হোম ডেলিভারির দিকে ঝুঁকছে। আর ডেলিভারি ম্যান এবং ক্রেতার মাঝে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হয়, এজন্য প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ‘কন্টাক্টলেস ডেলিভারি’ সুবিধা নিয়ে এসেছে। এর ফলে ক্রেতা সরাসরি ডেলিভারি ম্যানের নিকট থেকে পণ্য গ্রহণ না করে নিজের সুবিধা মতো সময়ে তার পণ্য গ্রহণ করতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে এমন সুবিধা আগে থেকেই প্রচলিত থাকলেও আমাদের দেশেও এই সুবিধা এখন পরিচিতি পেতে যাচ্ছে। তাই ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে এই সুবিধা আনতে পারে ক্রেতাদের মন জয় করার জন্য।
৪. টেলিহেলথ এবং টেলিমেডিসিন
সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য ২০২০ সালে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে সরাসরি চিকিৎসাসেবা বন্ধ ছিল। এজন্য অধিকাংশ রোগী ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা নিতে বাধ্য হয়েছিল। সরকারিভাবে অনেকক্ষেত্রে এই সুবিধা দেয়া হলেও বেসরকারিভাবে টেলিহেলথ সার্ভিস গড়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে ২০২১ সালে। পাশাপাশি ওষুধ সরবরাহের কাজেও অনলাইন মাধ্যম প্রাধান্য পেতে পারে এই বছর। তাই চিকিৎসা সেবায় সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ হতে পারে একটি ভালো সিদ্ধান্ত।
৫. অনলাইন শিক্ষা মাধ্যম
মহামারির প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলোর মাঝে অন্যতম হলো শিক্ষাক্ষেত্র। প্রায় ১ বছর হতে চললো সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অনলাইন মাধ্যমে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যথাযথ নেটওয়ার্কের অভাবে নিয়মিত পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে লাখো শিক্ষার্থী। সেই সাথে নিয়মিত শ্রেণি পাঠদান এবং অনলাইন পাঠদানের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এ সকল সমস্যার কথা মাথায় রেখে অনলাইন শিক্ষা মাধ্যমে আসতে পারে ব্যাপক বিস্তার। ভবিষ্যতে অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে নেয়া যেতে পারে বেশ কিছু পদক্ষেপ যা শিক্ষাক্ষেত্রের চিত্র পাল্টে দিতে পারে। ‘খান একাডেমি’ তারই একটি উদাহরণ। ইতোমধ্যে আমাদের দেশেই ‘টেন মিনিট স্কুলে’র মতো বেশকিছু অনলাইন শিক্ষা মাধ্যম রয়েছে। এছাড়া কোর্সেরা কিংবা উডেমির মতো বেশ কিছু অনলাইন শিক্ষা মাধ্যম গড়ে উঠছে বর্তমান সময়ে। গতানুগতিক পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি কিছু শেখার জন্য অনেক শিক্ষার্থীই এসকল মাধ্যম ব্যবহার করছে।
৬. মাইক্রোমোবিলিটির চাহিদা বৃদ্ধি
কোভিড-১৯ মহামারির মাঝে যানবাহনে চলাচলে এসেছে ব্যাপক সীমাবদ্ধতা। নিরাপত্তা এবং অর্থ সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে অনেকেই এখন ব্যাটারিচালিত কিংবা বহনযোগ্য যানবাহনের দিকে ছুটছে। পাশাপাশি হোম ডেলিভারি কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের কাজের প্রচার ও প্রসার বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই এখন এই পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন। ফলে স্বল্প খরচে একটি ভালো আয়ের মাধ্যম তৈরি করা এবং সহজেই যানজট এড়িয়ে চলাচলের সুবিধার কথা চিন্তা করে মাইক্রোমোবিল কিংবা ক্ষুদ্র যানবাহনের ব্যবহার এই বছর বেড়ে যেতে পারে। এজন্য এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হতে পারে ভালো একটি উপায়। দেশীয় উৎপাদন কিংবা বৈদেশিক রপ্তানি উভয়ক্ষেত্রেই এই চাহিদা পূরণে কাজ করতে পারে।
উপরের বিষয়গুলোর পাশাপাশি আরও অনেক ক্ষেত্র আছে যেসব জায়গায় ২০২১ সালে ব্যাপক প্রসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সময়ের চাহিদা বিবেবচায় উক্ত ক্ষেত্রগুলোতে আসতে পারে ব্যাপক বিপ্লব এবং প্রসার। তাই প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ২০২১ হতে পারে তথ্য ও প্রযুক্তির বিপ্লবের জন্য অনন্য একটি বছর।