ধনীদের জীবনযাপন কেমন হয়? তাদের চালচলন থেকে শুরু করে খাদ্যাভ্যাস অবধি সবকিছুই সাধারণ মানুষের কৌতূহলের বিষয়। কেউ জানতে চায় সাধারণ জানার আগ্রহ থেকে। কেউবা রীতিমত গবেষণা করে থাকে, কিছু শিক্ষামূলক দিক বের করে আনার লক্ষ্যে। বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদক টমাস সি. কার্লি এই গবেষণাটাই চালিয়েছেন ধনী লোকদের উপর, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে। ফলস্বরূপ সামনে এসেছে এমন কতগুলো বিষয়, যা এ সমস্ত ধনীদের মাঝে সাধারণ। সেসব থেকেই কয়েকটি নিয়ে এই প্রতিবেদন।
তারা সত্যিই অনেক ধনী! এই তালিকার ধনী ব্যক্তিদের রয়েছে অন্তত ৩২ লক্ষ ডলার। ১৬ শতাংশ ব্যক্তির আছে ৬০ লক্ষ ডলারের বেশি। বছরে অন্তত ১,৬০,০০০ ডলার পকেটে পুরছে তারা। অর্ধেক লোক প্রতি বছর মালিক হচ্ছে ৫,০০,০০০ ডলারের। অঙ্কগুলো লোভনীয়, তাই না?
ধনীরা কমবয়সী নয়। ৮০ শতাংশ ধনী মানুষেরই বয়স ৬০ বছর কিংবা আরো বেশি। দিন এখনো আছে ধনী হবার, মনে হচ্ছে না তেমনটা? ধনী হতে সময় লাগে। চোখের পলকে কিছুই হয় না! গড়ে ৩২ বছর সময় লেগেছে এই মানুষদের এত অর্থের মালিক হতে। কাজেই ধৈর্য রাখলে ক্ষতি নেই। তারা নিজেদের কাজ পছন্দ করে। কাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে কেউ অর্থ উপার্জন করছে না। ৮৬ শতাংশ মানুষই নিজেদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমকে পছন্দ করেন। বেজার মনে কাজ করে সাফল্যের মুখ খুব বেশি দূর দেখা কি আসলেও সম্ভব?
তাদের রয়েছে কোনো পথপ্রদর্শক, সাফল্যের দিক নির্দেশনা দেয়ার মতো কেউ। কী করা উচিৎ, কী উচিৎ নয়- এই শিক্ষাগুলো তারা নিয়ে থাকেন অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে। এবং ভালো দিক হচ্ছে, অন্যকে সফলতার দিকনির্দেশনা দেয়ার মনোভাবও তারা রাখেন।
তারা জ্ঞান অর্জনে অনাগ্রহী নন। প্রতিদিনই শিক্ষা গ্রহণের জন্য কিছু না কিছু পড়েন তারা। ৮৮ শতাংশ ধনী কাজের ক্ষেত্রে জ্ঞান বৃদ্ধি করতে প্রতিদিন পড়াশোনা করেন। ৮৫ শতাংশ মাসে অন্তত দু’টো বই পড়ে থাকেন। ৬৩ শতাংশ অন্যান্য কাজের ফাঁকে অডিও বই শোনেন। আর সাধারণত তারা নিছক আনন্দ লাভের জন্য পড়েন না। ঐ ব্যাপারটা তাদের কাছে কেবলই সময় অপচয়ের কাজ!
তাদের বিপুল সম্পদ নিজেদেরই তৈরি, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। ৩১ শতাংশই দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। ৪৫ শতাংশের বেড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত ঘরে। তাদের মধ্যে কেবল ২৪ শতাংশ পরিবার থেকে সম্পত্তি পেয়েছেন।
তারা ভালো সব অভ্যাস তৈরি এবং চর্চা করেন। খারাপ যা কিছু, তা পরিহার করার মাধ্যমেই উন্নতি অব্যাহত রাখেন হয়তো। তাই বলে সবটাই ভালো নয়। কিছু বাজে অভ্যাসও তাদের আছে বৈকি! ৭৩ শতাংশ নিজেদের সাফল্যের অভ্যাস লাভ করেছেন তাদের পিতামাতার কাছ থেকে। তারা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব রাখেন। সুস্থ প্রতিযোগিতা যেকোনো কাজের সফলতা এনে দেয় দারুণভাবে। ৬৩ শতাংশই হাই স্কুলে খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন।
তারা স্বাস্থ্যবান। অর্থাৎ শরীরের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল। প্রায় প্রতিদিন তারা ব্যায়াম করে থাকেন। ৭৬ শতাংশ সপ্তাহে অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়ামের পিছনে ব্যয় করেন। তারা নিজেদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে অনেক সচেতন। জাঙ্ক ফুড পরিহার করে চলেন যতটা সম্ভব। চকোলেট, মাদক ও ধূমপান থেকে দূরত্ব বজায়ে চলে ধনীরা। রাতে অন্তত ৭ ঘণ্টা ঘুমের ভালো অভ্যাস আছে তাদের।
স্বেচ্ছাশ্রমে আগ্রহ আছে ধনীদের। ৭২ শতাংশই মাসে ৫ ঘণ্টা সময় অলাভজনক কাজে শ্রম দিয়ে ব্যয় করেন এবং সেসব চ্যারিটিতে দানও করে থাকেন তারা। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রয়েছে তাদের। অবশ্য হতেই পারে, এত অর্থ থাকলে তা সামলানোর উপদেষ্টাও লাগে বটে! তারা জীবনে সুখী। দুঃখবিলাস করে কাটানোর সময় তারা নেন না। সমৃদ্ধির পাশাপাশি সুখের উপস্থিতিও আছে তাদের জীবনে।
৬৪ শতাংশ ধনী লোকের বাস করা বাড়ি অন্তত ২০ বছর যাবত তাদের মালিকানাধীন। তাদের চালানো গাড়িও নতুন নয়। অর্থাৎ পুরনো বাড়ি-গাড়ি নিয়েই দিব্যি আনন্দে আছেন তারা। তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার খুবই কম।
গোটা দিনের পরিকল্পনা সাজানো থাকে তাদের। সকাল থেকে রাত অবধি কখন কোথায় কী কাজে তারা থাকবেন, গুছিয়ে রাখেন তারা আগেভাগেই। ৮১ শতাংশই টু-ডু-লিস্ট রাখেন। এলোমেলো দিন কাটানোর স্বভাব তাদের নেই বললেই চলে।
তারা ভোটদানের ব্যাপারে খুব সচেতন। ৪৩ শতাংশ ধনী ব্যক্তি প্রতি নির্বাচনে ভোটদান করে থাকে।
তারাও অবকাশযাপন করেন, তাই বলে অঢেল টাকা উড়িয়ে নয়! ৯৬ শতাংশ বছরে অবকাশযাপন করতে ৬,০০০ ডলারের কম পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। আর ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে এই পরিমাণটা হলো ৩,০০০ ডলারের কম।
ধনী ব্যক্তিরা বেলা করে বিছানা ছাড়ার চর্চা করেন না। তারা ভোরের পাখি, দিন জলদি শুরু করা দলের মানুষ। ৪৪ শতাংশ তাদের কর্মদিবস শুরু হবার সময়ের অন্তত ৩ ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠেন। ৯১ শতাংশই নিজেদের কর্মক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। অর্থাৎ তারা কাজের জগতে নিজেরাই বস।
ধনীরা মিতব্যয়ীও বটে। বেহিসাবি খরুচে হলে তারা এত সম্পদশালী হতেও পারতেন না, সহজ হিসাব এটি। অর্থ উপার্জনের মর্ম তারা জানেন বলেই খরচ করেন ভেবেচিন্তে।
লেখাপড়ায় অশ্বডিম্ব গোছের মানুষ কমই আছে এই তালিকায়! এই ধনীদের ৬৮ শতাংশই কলেজে গেছেন। ২৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি অবধি পৌঁছেছেন জীবনে।
তারা ব্যাপক কর্মঠ। তাদের ভেতর ৭৩ শতাংশই গড়ে ৫৮ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন প্রতি সপ্তাহে। আলসেমিকে প্রশ্রয় দেওয়া তাদের স্বভাবে নেই। ঝুঁকি নিয়ে ভয় করেন না তারা। ৬৩ শতাংশ ধনী ব্যক্তিই ঝুঁকি নিয়ে তবে সম্পদশালী হয়েছেন। ২৭ শতাংশ অন্তত একবার ব্যবসায় অসফল হয়েছেন।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন তারা। রেগে গিয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা নিজেদের ক্ষতি করার আশঙ্কা তাদের মাঝে তাই কম। নেতিবাচক মনোভাবের মানুষদের সঙ্গ তারা পছন্দ করেন না। সারাক্ষণ অভিযোগ করতে থাকা মানুষেরা তাদের প্রিয় হবার তালিকায় নেই। ধনীরা নিজেদের মতো মানুষদের সাথেই চলাফেরা করে থাকেন।
জুয়ার নেশায় মন দেওয়া ধনী ব্যক্তি কমই আছে এই তালিকায়। জুয়ার কবলে কখনো না পড়া মানুষ ৮৪ শতাংশ। অর্থ কেবল উপার্জন নয়, রক্ষাও করেন তারা! তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কখনো কোনো অভিযোগে গ্রেফতার হননি তাদের মাঝে ৯১ শতাংশ ব্যক্তি।
টাকা-পয়সা জমানোর হাত তাদের আছে। ৯৪ শতাংশই নিজেদের আয়ের ২০ শতাংশ পরিমাণ অর্থ জমিয়ে আসছেন কর্মজীবনের শুরু থেকেই। আর তাদের আছে একের অধিক আয়ের উৎস। ৬৫ শতাংশ ধনী ব্যক্তির আছে ৩টি আয়ের উৎস। ৪৫ শতাংশের আছে ৪টি আর ২৯ শতাংশের আছে ৫টি করে আয়ের উৎস। এই ধনী ব্যক্তিরা টিভিতে আসক্ত নন। ৬৭ শতাংশ দিনে ১ ঘণ্টার কম সময় টিভি দেখে কাটান।
খুব জরুরি আরেকটি বিষয় দিয়ে লেখাটি শেষ করা যাক। সম্পদশালী এই মানুষগুলো শিক্ষাজীবনে চৌকশ ছিলেন না মোটেও। সেই জীবন পার করে তারা নিজেদের সামনের দিনের জন্য তৈরি করেছেন এবং প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু করে যাচ্ছেন। কাজেই বোঝা গেছে তো, সময় এখনই ফুরিয়ে যায়নি? শুরুটা হতে পারে যেকোনো সময়ই! বিপুল না হোক, খানিকটা অর্থবিত্ত তো হতেই পারে জীবনে, তাই না?
ফিচার ইমেজ: Vox