ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র এক উৎসবের নাম হানুকা। উৎসবটি তাদের কাছে জয়ের উৎসব, আলোর উৎসব হিসেবেও পরিচিত। ‘হানুকা’ শব্দটি হিব্রু শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ নিজেকে উৎসর্গ করা। ইহুদি ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অলৌকিক ঘটনাগুলির একটিকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। হিব্রু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের কোনো একসময়ে আট দিনব্যাপী এই উৎসব পালিত হয়। এবছর এ উৎসবটি ডিসেম্বরের ২২ তারিখ থেকে ৩০ ডিসেম্বর এই আটদিন পালিত হবে।
হানুকার ইতিহাস
হানুকা উৎসবের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এই উৎসবকে ঘিরে বেশ কিছু গল্পও প্রচলিত রয়েছে । ২০০০ বছর আগে ইহুদী জনগণ তাদের নিজেদের ধর্মীয় রীতিনীতি নির্বিঘ্নে পালন করার জন্য গ্রিকদের সাথে এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সেই যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হানুকা উৎসবের সূচনা হয়েছিল।
১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিরিয়াসহ বর্তমান পশ্চিম এশিয়ার এক বিশাল অংশ গ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তখন গ্রিকদের রাজা ছিলেন চতুর্থ অ্যান্টিওকাস। তিনি গ্রিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। রাজা তার সমস্ত রাজ্যে গ্রিক ধর্ম প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেরুজালেমসহ সিরিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে সে সময় ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের আবাসভূমি ছিল।
একবার এক যুদ্ধে হেরে গিয়ে রাজা অ্যান্টিওকাস কিছু সময়ের জন্য জেরুজালেম শহরে অবস্থান করেছিলেন। শহরটি তখন সিরিয়ার অন্তর্গত। যুদ্ধে হেরে গিয়ে এমনিতেই অ্যান্টিওকাস ক্রুদ্ধ ছিলেন। তারপর জেরুজালেমের মতো একটি সাজানো-গোছানো ইহুদীদের আবাসভূমি দেখে তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন। তিনি জেরুজালেম থেকে ইহুদী ধর্মের সবকিছু মুছে ফেলার জন্য তার সেনাদের আদেশ দিলেন। ইহুদীদের বাধ্যতামূলক গ্রিক ধর্ম পালনের জন্য আইন করলেন। ইহুদীরা সপ্তাহের রবিবার দিনটিকে বিশ্রামের দিন হিসেবে বিবেচনা করতো। দিনটি তাদের কাছে ‘স্যাবাথ’ হিসেব পরিচিত।
এ দিনটিকে তারা সপ্তাহের ছুটির দিন হিসেবে পালন করতো। রাজা অ্যান্টিওকাস স্যাবাথসহ ইহুদীদের সব ছুটির দিনগুলো বাতিল করলেন। দলে দলে ইহুদীদের জোর করে গ্রিক ধর্ম পালনে বাধ্য করা হতে লাগলো। যেসব ইহুদী এতে রাজি হলেন না, তাদেরকে মেরে ফেলা হতো, না হলে দাস করে রাখা হতো। ইহুদী ধর্মপালন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো। কেউ চুপিসারে এ ধর্ম পালন করতে চাইলে এবং তা কোনোভাবে রাজার কানে পৌঁছলে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হতো। জেরুজালেমসহ তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে গ্রিক জীবনযাত্রা, গ্রিক ভাষা ও জায়গার নাম পরিবর্তন করে গ্রিক নাম দেয়ার রীতি শুরু হলো। জেরুজালেমে ইহুদীদের প্রধান মন্দিরটিতে গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তি বসানো হল। মন্দিরটিকে অপবিত্র করে দেয়ার সব ব্যবস্থা করা হলো।
জেরুজালেমের কাছের একটি গ্রামে ম্যাটাথিয়াস নামে এক প্রাক্তন ইহুদী পুরোহিত বাস করতেন। ইহুদীদের প্রতি রাজার এই অন্যায়-অবিচার দেখে তিনি বেশ ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি ও তার পাঁচ ছেলে রাজা অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
ম্যাটাথিয়াস বৃদ্ধ ছিলেন। সংগ্রামের অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি মারা যান। ম্যাটাথিয়াসের মৃত্যুর পর তার পাঁচ ছেলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলেন। এ বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দিতে লাগলেন ম্যাটাথিয়াসের ছোট ছেলে ম্যাকাবি। তিন বছর ধরে তার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা মাঝেমধ্যেই রাজার সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
ইহুদীরা সংখ্যায় কম হলেও তাদের আত্মপ্রত্যয় ছিল অনেক বেশি। প্রতিদিনই কিছু কিছু ইহুদী তাদের দলে যোগ দিতে লাগলেন। ফলে দল ভারি হতে লাগলো। আন্দোলনও বেগবান হতে শুরু করলো। তিন বছর পর ইহুদীরা গ্রিকদের সাথে এক সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধে গ্রিকদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। যুদ্ধজয়ের পর ইহুদীরা তাদের প্রধান মন্দিরটি অধিকার করে নেয়। ইহুদী ধর্মানুসারে শুদ্ধ করা হয় মন্দির ও মন্দির প্রাঙ্গণ।
মন্দিরটি শুদ্ধ করে ইহুদী ধর্মমতে প্রতি রাতে একটি করে প্রদীপ জ্বালানোর সিদ্ধান্ত হয়। একমাত্র জলপাই তেলেই এই প্রদীপ জ্বালানোর নিয়ম ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর মন্দিরে অনেক খুঁজেও এক বোতলের বেশি তেল পাওয়া গেল না। এই তেল দিয়ে এক রাতের বেশি প্রদীপ জ্বালানোর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই তেলে আট দিন ধরে সবক’টি প্রদীপ জ্বলতে থাকে। এর মধ্যেই ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে তারা প্রয়োজনীয় তেল প্রস্তুত করে ফেললেন। এই আশ্চর্য ঘটনাকে স্মরণ করেই আট দিন ধরে হানুকা উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।
যেভাবে পালিত হয় এ উৎসব
হানুকা একটি পারিবারিক উৎসব। পরিবারের সবাইকে নিয়ে এই উৎসব পালিত হয়। হানুকা উৎসবের আট রাতের প্রতিটিতে এক বিশেষ ধরনের বাতি জ্বালানো হয়, যা ‘মেনোরা’ নামে পরিচিত। মেনোরা এই উৎসবের মূল প্রতীক। হানুকা উৎসবের জন্য তৈরি এই বিশেষ মেনোরার নাম হানুকিয়া, হিব্রু ভাষায় এর অর্থ আট দিন। উৎসব পালনের জন্য বেশিরভাগ ইহুদি পরিবারই ধর্মীয় রীতি মেনে এই বিশেষ মেনোরা প্রস্তুত করে থাকেন।
এই বাতিগুলো জ্বালানোর জন্য একটি করে অতিরিক্ত বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। এই বিশেষ বাতির নাম ‘শামাস’, হিব্রু ভাষায় যার অর্থ সাহায্যকারী বাতি। হানুকাকে স্মরণ করা প্রধান বাতিগুলোকে জ্বালানোর কাজে এ বাতি ব্যবহৃত হয়। শামাশকে মূল বাতিগুলোর কিছুটা উপরে না হয় কিছুটা নিচে আলাদা করে রাখা হয়। কারণ শুধুমাত্র প্রধান বাতিগুলোই হানুকাকে স্মরণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। বর্তমান সময়ে তেলের বাতির পরিবর্তে ইহুদীরা উৎসবের জন্য বিশেষভাবে তৈরি মোমবাতি জ্বালিয়ে থাকে। ইহুদী ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, প্রতি রাতে একটি মোমবাতি জ্বালানো হয়, দ্বিতীয় রাতে আগেরটিসহ আরও একটি মোমবাতি জ্বালানো হয়।
এভাবে উৎসবের শেষ রাত পর্যন্ত আগের মোমবাতিগুলোসহ মোট আটটি মোমবাতি জ্বালানো হয়ে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে মোমবাতিগুলো বাম থেকে ডানদিকে ক্রমান্বয়ে জ্বালানো হয়ে থাকে। প্রতিটি মোমবাতি জ্বালানোর আগে ও পরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয় এবং সব শেষে একটি বিশেষ ধর্মীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। সাধারণত রাস্তার দিকের জানালার কাছে এই বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয় যাতে পথচারীদের যাওয়া-আসায় এই বাতিগুলো চোখে পড়ে এবং তারা হানুকা উৎসবকে স্মরণ করতে পারেন।
হানুকার খাওয়াদাওয়া
সকল আনন্দ উৎসবের মতোই এ উৎসবেও দারুণ সব খাওয়া-দাওয়া ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকে। সুস্বাদু খাবার আয়োজনের জন্য এটি একটি অসাধারণ উপলক্ষ। উৎসব উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী বিশেষ কিছু পদের রান্না করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ খাবারই মেনোরার কথা স্মরণ করে ডুবন্ত তেলে ভাজা হয়ে থাকে।
ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের প্রধান খাদ্য ‘লটকে’ নামের এক বিশেষ প্যানকেক। এটি একরকম আলু ভাজা; তার সাথে আপেল, চেরি, গাজরের গার্নিশ করা সুস্বাদু প্যানকেক। এছাড়া উৎসব উপলক্ষে ‘সুফগানিয়া’ নামের একরকম কাস্টার্ডের তৈরি জেলি ডোনাট হানুকার বিশেষ মেন্যু হিসেবে সকলেরই খুব প্রিয়।
আত্মীয় পরিজনরা উৎসব উপলক্ষে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়, চলে উপহার বিনিময়। আটদিন ব্যাপী চলে এই উপহার বিনিময়। তবে এই উপহার বিনিময়ের মধ্যেও ধর্মীয় এক ঐতিহ্য মেনে চলা হয়।
আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে অনেক গরীব ইহুদী আত্মীয়ের পক্ষেই এই উৎসবে পরিবারের ছোটদের উপহার দেয়া, মেনোরা কিংবা উৎসব উপলক্ষে বিশেষ খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ থাকে না। ফলে তাদের পক্ষে উৎসবে যোগদান করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। গরীব আত্মীয়রা যাতে নির্বিঘ্নে উৎসব পালন করতে পারেন সেজন্য আর্থিক সামর্থ্যবান আত্মীয়রা উৎসব উপলক্ষে তাদেরকে উপহার দিয়ে থাকেন। উৎসব পালনে পারস্পরিক সহযোগিতার এই মানবিক রীতিনীতি ইহুদী ধর্মাবলম্বীরা বহুকাল আগে থেকেই মেনে চলে আসছেন।
হানুকার এক মজার খেলা ড্রেডেল
হানুকা উৎসবকে ঘিরে নানারকম খেলার প্রচলন থাকলেও সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটি হচ্ছে ড্রেডেল। সেভিভন বা ড্রেডেল নামের এই পারিবারিক খেলাটিতে একটি চৌকো ধরনের লাট্টু থাকে। এই লাট্টুর চারপাশে চারটি হিব্রু অক্ষর থাকে। এ চারটি অক্ষর এক হিব্রু বাক্যের চারটি শব্দের প্রথম অক্ষর। বাক্যটি হলো ‘নেস গাদোল হায়া শাম’। এর অর্থ ‘এই স্থানে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিলো’।
একটি পাত্রে একজন একটি পয়সা বা একটি বাদাম বা একটা চকলেট রাখবেন। তারপর তিনি লাট্টুটি ঘোরাবেন। লাট্টুটি প্রথম অক্ষরের কাছে এলে প্রতিযোগী কিছুই পাবেন না। যদি লাট্টুটি দ্বিতীয় অক্ষরের কাছে আসে তবে পাত্রে রাখা সবকিছু তিনি পাবেন। লাট্টুটি যদি তৃতীয় অক্ষরের কাছে আসে তাহলে পাত্রের মধ্যে যা রাখা আছে তার অর্ধেক তিনি পাবেন। আর লাট্টু চতুর্থ অক্ষরের কাছে আসলে তাকে আরেকটি কয়েন বা বাদাম বা চকলেট পাত্রে রাখতে হবে। এ মজার খেলা প্রচলনের পেছনে নানা গল্প থাকলেও মূলত গ্রিকদের সাথে ধর্মীয় যুদ্ধে আত্মদানকারী সেসব বীর ইহুদী যোদ্ধাদের স্মরণ করাই মূল উদ্দেশ্য।
হানুকা যদিও ইহুদীদের এক পবিত্র ধর্মীয় উৎসব, কিন্তু উৎসবকে ঘিরে যে আনন্দ আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয় তা পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের মতোই আজ সার্বজনীন রূপ নিয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকার অধিকাংশ জনগণই ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে বড় দিনের সাথে এই উৎসবটিও পালন করে থাকেন। আর সব উৎসবের প্রধান আকর্ষণই হলো শিশুরা। তাই শিশুদের বাদ দিয়ে এ উৎসবের চিন্তা কল্পনাই করা যায় না।