নিজের একটা প্রতিষ্ঠান তৈরির স্বপ্নটা দিনরাত হাতছানি দেয়। খেটেও চলেছেন অবিরাম এর পিছেই। চেষ্টার কমতি নেই নিজেকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবার। না আছে পরিশ্রমে অনীহা। তবুও হোঁচট খেয়ে থমকে যেতে হয় কোথাও কোথাও। ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকা নিজের প্রতিষ্ঠানটা ভেঙ্গে পড়ে চোখের সামনে। ভুলগুলো কোথায় হচ্ছে তবে?
উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর দিককার এমন কিছু ভুল থাকে, যা কম-বেশি সবার মাঝেই দেখা যেতে পারে। তরুণ উদ্যোক্তাদের সেই সাধারণ ভুলগুলোই তুলে ধরা হয়েছে বিজনেস ইনসাইডার ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে। ফেসবুক এবং ফোরস্কয়ারের প্রাক্তন দুুই কর্মকর্তার মতামত নিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রতিবেদনটি। ওশানস নামের একটা পরামর্শদান কার্যক্রম রয়েছে যেখানে উদ্যোক্তাদের দিকনির্দেশনা দেয়া হয় নিজেদের ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে। ওশানস তৈরি হয়েছে ফেসবুক, গুগল, অ্যাপল ও ফোরস্কয়ারে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থাকা তিনজন সাবেক নির্বাহীকে নিয়ে। বিজনেস ইনসাইডারের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ওশানসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জোস রান এবং স্টিভেন রোজেনব্ল্যাট কথা বলেছেন উদ্যোক্তাদের শুরুর দিককার সাধারণ ভুলগুলো নিয়ে। এবং সেগুলো কাটিয়ে ওঠারও পরামর্শ দিয়েছে ওশানস।
অর্থই সব নয়
উদ্যোক্তার লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজের প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান। অথচ তারা অর্থ বিষয়ক দিকগুলোতেই মনোযোগ আটকে বসে থাকে! জোস বলেন, তার দেখা বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা মেটানোর চেয়ে তহবিল সংগ্রহে বেশি আগ্রহী। এটা ভুল একটা আচরণ। কেবলমাত্র তহবিল আপনাকে সফল একটা ব্যবসা তৈরি করে দিতে পারবে না কখনোই, যদি না আপনি কাজ নিয়ে মনোযোগী হন।
সকল ক্ষেত্রে সেরা হবার চেষ্টা নয়
অন্যের অধীনে চাকরি করা আর নিজের একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, কোনটায় কাজের চাপ বেশি বলে মনে হয়? ভেবে দেখুন তো, এক ক্ষেত্রে আপনি আপনাকে দেয়া কিছু নির্ধারিত কাজ করছেন। সেটা কম কিংবা বেশি হতে পারে, একেক সময় একেক রকম। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে, যখন কিনা আপনি নিজের ব্যবসা কিংবা অফিসে আছেন, আপনার সতর্ক থাকা লাগছে সব ব্যাপারেই, মাথা ঘামাতে হচ্ছে প্রায় প্রতিটা কাজে আর সামলাতে হচ্ছে সবকিছু, চাপ তাহলে কোথায় বেশি হলো? উদ্যোক্তা হতে গেলে, বিশেষ করে প্রথম দিকে আপনাকে অবশ্যই একাধিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। কিন্তু তাই বলে সব কাজ আপনার কাজ নয়। জোসের মতে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কাজে মধ্যম মানের দক্ষতা অর্জন করার চেয়ে বরং কোনো একটা দিকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে এগোন। আপনার প্রতিষ্ঠানকে সাফল্য এনে দিতে এটা কার্যকরী বিষয়।
কর্মী বাছাইয়ে সতর্কতা প্রয়োজন
জোসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ আছে প্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মী বাছাই বিষয়ক। তার মতে, একজন উদ্যোক্তার কখনোই তার প্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মী নেয়ার বেলায় ভুল করলে চলবে না। উপযুক্ত প্রার্থীকে সঠিক পদে চাকরি দেয়া দিনের শেষে প্রতিষ্ঠানেরই মঙ্গল নিয়ে আসে। অদক্ষ মানুষদের কাজে নিলে একটা দারুণ সম্ভাবনাময় পণ্যের বাজারও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে যোগ্য ব্যক্তিদের চাকরি দেয়ার ফলে কোনো মধ্যম মানের কাজও দারুণ ফলাফল করে দেখাতে পারে।
ধৈর্যের অভাব বড় দোষ
উদ্যোক্তা জীবনে চাপ থাকবে আপনার কল্পনার চেয়েও বেশি। কাজের চাপ, প্রতিষ্ঠানকে ধীরে ধীরে কাঙ্খিত রূপ দেয়ার চাপ, তহবিল সংক্রান্ত চাপ, দশ রকমের চাপে পিষ্ট হবেন আপনি। কিন্তু তার ফলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে যাবেন, বড়সড় ভুল করে ফেলতে পারেন। জোস বলেন, প্রয়োজনে এক ধাপ পিছিয়ে আসুন, আবার যাচাই করে নিন চাহিদাগুলো। অনেক উদ্যোক্তাই প্রতিষ্ঠানের জন্য খুব জলদি কর্মী নেন অথবা নিজেদের সমস্যাগুলো এত দ্রুত মেটাতে চেষ্টা করেন, যেন তাদের মাথায় বন্দুক ধরা হয়েছে! এমনটাই জোসের মন্তব্য। আপনি কেবল এতটুকুই মাথায় রাখুন না, যে তাড়াহুড়োর কাজ কখনো ভালো কিছু হয় না। প্রশ্ন যখন নিজের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের, তখন এই বিষয়গুলো মাথায় গেঁথে নেয়া চাই আরো ভালোভাবে।
প্রতিষ্ঠানে আপনিই শ্রেষ্ঠ হবেন না
আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনিই সেরা, এমন আত্মতুষ্ট মনোভাব আপনাকে শান্তি দেবে বটে, কিন্তু আপনার সাধের প্রতিষ্ঠানকে পিছিয়ে দিতে পারে অনেক। সেটা কেন? প্রতিষ্ঠান বড় হবে, কাজ আসবে কয়েকগুণ, অথচ আপনার মতন যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ থাকবে না কাজ দেখার তবে সেই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি কীভাবে সম্ভব? নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মী বাছাই করার বেলা তাই মাথায় রাখা চাই, এমন কাউকেই কাজে নিন যে আপনার স্থান নেয়ার যোগ্যতা রাখে। কর্মজীবনে মন খারাপের জায়গা কম। তাই এসব নিয়ে মন খুঁতখুঁত করলেও তা পাত্তা দিয়ে কাজের ক্ষতি করা চলবে না। জোস এই ব্যাপারে নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছেন। তিনি যখন ফেসবুকে যোগদান করেন, এক নাম্বার নিয়মই এটা ছিলো যে, সবসময় এমন কাউকেই কাজে নিতে হবে যে প্রথম দিনেই তার জায়গা নিতে সক্ষম। তাই মনে দুঃখ কিংবা অস্বস্তি যা-ই হোক না কেন, নিজের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ভালোটা মাথায় রেখে মেনে চলুন এই নিয়ম। সুযোগ্য কর্মীরাই আপনার প্রতিষ্ঠানে ক্রমাগত সাফল্য আনবে। আপনিই সর্বেসর্বা হয়ে বসে থাকলে সাফল্য অধরা থেকে যাবে বহুদিকে। সেটা নিশ্চয়ই চাচ্ছেন না?
সমস্যা স্বীকারের সাহস থাকা চাই
স্টিভেনের মতে, আপনি যদি মানতে না পারেন যে আপনি একটা সমস্যার মধ্যে আছেন, তবে এই ব্যাপারটাই একটা বড় সমস্যা! ভুল হবে, হতেই পারে, আপনি সমস্যায় পড়তেই পারেন কিন্তু সেটা গোপন করে নিজের প্রতিষ্ঠানকেই সমস্যায় ফেলে দেয়াটা বোকামি। সমস্যা সকলেরই থাকে, একজন উদ্যোক্তার জীবনেও নানা রকম সমস্যা থাকবে কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সেসব অস্বীকার করে গেলে চলবে না। আপনাকে সততা দেখাতে হবে নিজের সমস্যার কথা মানতে। আর ভুল স্বীকার করা কখনোই খারাপ কিছু নয়।
অস্বচ্ছতা সাফল্যের পথে বড় কাঁটা
যত বেশি স্বচ্ছ হবেন কর্মজীবনে, ততই ভালো। লুকোচুরি খেলা কাজের জায়গায় মানানসই নয়। আর যখন অফিসটাই আপনার নিজের, তখন তো আরো বেশি নয়! আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য যারা কাজ করছে তারা অবশ্যই আপনার কাছে স্বচ্ছতা আশা করে। তাদের কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার মানসিকতা থাকা চাই। যদি আপনার কর্মীরা বোঝে যে আপনি তাদের কাছে অনেক কিছুই আড়াল করছেন, তারা আপনার জন্য উৎফুল্ল হয়ে আর কাজ করতে চাইবে না। আর একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মানুষগুলো সন্তুষ্ট নয় মানেই তারা তাদের সেরাটা এখানে দেবে না। সাফল্যের পথে ক্রমশ পিছিয়ে পড়বে আপনার প্রতিষ্ঠান।
সাহায্য চাইতে ভয় কেন?
জোসের মতে, বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই ভীত প্রকৃতির হন। হয়তো ব্যবসায় অস্থিতিশীল অবস্থা এখন, আপনি চাপে আছেন, অথচ সেটা কাটাতে সাহায্য চাওয়ার বেলা ইতস্তত করছেন বা ভয় পাচ্ছেন। এমন আচরণ কাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর। প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারীদের সাথে যতটা সম্ভব স্বচ্ছ সম্পর্ক রাখুন। কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তাদের সেটা অবশ্যই জানান, যদি তাদের মধ্যে কেউ কোনো দিকে বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন। সমস্যায় থাকলেও তা আড়াল করার প্রবণতা, সাহায্য না নেয়ার মনোভাব বা ভয় আপনার উদ্যোক্তা জীবনের পক্ষে ইতিবাচক নয় মোটেও।
ফিচার ইমেজ: YourStory