আমরা প্রায়ই ‘ম্যাচিউর’ কিংবা ‘পরিণত’ শব্দটি উচ্চারণ করে থাকি কারণে-অকারণে! কারণে-অকারণে বললে ভুল হবে, বলা উচিত বুঝে-না বুঝে। অনেকেই বড় হওয়াকে পরিণত হওয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলি। যদি বড় হওয়া আর পরিণত হওয়া এক না হয়, তবে পরিণত হওয়ার মানে কী? একটা মানে হতে পারে, আপনি যখন সঠিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় সঠিক ভাষা ব্যবহার করবেন, কিংবা আচরণের মাধ্যমে সেটা ফুটিয়ে তুলবেন, সেটাই হতে পারে আপনার পরিণত হওয়ার পরিচয়!
মানুষের জীবন অতিবাহিত হয় নির্দিষ্ট কিছু ধারাবাহিকতায়। ছোটবেলায় আমরা খেলাধুলা করি, অল্প-অল্প শিখি, তারপর বড় হয়ে কাজের সন্ধান করি, বিয়ে করি এবং বাচ্চা লালন-পালন করি। তারপর একদিন আপনি বুঝতে পারেন যে, আপনি অনেক বড় হয়ে গিয়েছেন। হয়তো জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। এই দীর্ঘ যাত্রায় আপনি কি কখনো নিজেকে যাচাই করে দেখেছেন যে, আপনি আসলে কতটুকু পরিণত হতে পেরেছেন?
স্বাভাবিকভাবে আমরা যখন বড় হই, সবার সাথে মিশতে গিয়ে আমাদের পরিণত হওয়ার শিক্ষাটা চলতে থাকে। পরিবার, সমাজ, আশপাশের মানু্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে গিয়ে আপনাকে মেনে চলতে হয় আলাদা সব ভদ্রতা। কেউ মানেন, আবার কেউ এসব ব্যাপার থোড়াই কেয়ার করেন। এতেই দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। আপনার আচরণ অনেকের মনে কষ্ট দেয়; কিংবা হয়ে থাকতে পারে, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী চারপাশের মানুষ আপনার থেকে আরও ভালো ব্যবহার কিংবা সিদ্ধান্ত আশা করেছিল।
বর্তমান আধুনিক যুগে এসে ‘পরিণত’ হবার ধারাবাহিকতাটা আরও বিঘ্ন হচ্ছে। আমরা যতটা না ভার্চুয়ালি সবার সাথে মিশছি, ততটাই ফাঁকা জায়গা তৈরি করছি সত্যিকার মানুষগুলোর সাথে। একটি শিশু যখন বড় হওয়ার সাথে সাথে চারপাশের মানুষগুলোর সাথে মিশতে পারে না, তখন প্রয়োজনের সময় স্বাভাবিকভাবেই সে সঠিক আচরণ নিজের মাঝে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। যার ফলাফল হিসেবে পারিবারিক কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ, আত্মহত্যার মতো ব্যাধিগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।
পরিণত হওয়ার রকমফের
শারীরিকভাবে পরিণত
এটা মানুষের পরিণত হওয়ার খুব স্বাভাবিক ধারা। একটা বয়সে পৌঁছানোর পর ছেলে-মেয়ে উভয়ের মাঝে নির্দিষ্ট এবং আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আর আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীটা নারী-পুরুষভেদে ভিন্নভাবে ধরা দেয়। তবে পরিবর্তনগুলো হঠাৎ করেই হয়ে যায় না। একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে ছেলে-মেয়েদের মাঝে ব্যাপারগুলো বদলে যেতে থাকে। তারা প্রথমদিকে শারীরিক পরিবর্তনগুলো আড়াল করে নিতে চাইলেও সময়ের সাথে তারা নতুন বদলে যাওয়া মানুষটাকেই সবার তুলে ধরে।
সামাজিকভাবে পরিণত
সামাজিকভাবে একটা মানুষ পরিপক্কতা লাভ করে সবার সাথে মিশতে গিয়ে। পরিবার থেকেই শেখার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়। একটা ছোট বাচ্চা যখন চকলেটের জন্য বায়না ধরে, সেটা সে চাইতে গিয়ে একরকম ব্যবহার করবে। বড় হয়ে সে আর আগের মতো করে চাইবে না। কিংবা ছোটবেলায় সে কোনো কিছু পাওয়ার পর ‘ধন্যবাদ’ জানাতে পারে। বড় হয়ে সে আর ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন মনে না-ও করতে পারে। কারণ একটা বয়সে গিয়ে ভদ্রতা দেখানো তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
মানসিকভাবে পরিণত
মানসিকভাবে পরিণত হওয়াটা একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু মানসিকভাবে পরিণত হওয়ার জন্য বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যেতে হয় একজন মানুষকে। তাই একজন মানুষ ছোটবেলাতেও মানসিক পরিপক্কতা লাভ করতে পারে, আবার অনেকেই সারাজীবন পার করার পরও সবার থেকে কেবল নিজের ব্যাপারে অভিযোগই শুনে যায়। মানসিকভাবে পরিণত হওয়া একজন মানুষ যেকোনো ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করে। একটা বাচ্চা যখন চকলেটের জন্য কান্না জুড়ে দিতে পারে, সেই একই বাচ্চাই যদি ভিন্ন কোনো কঠিন ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে যায়, সে বড় কিছু হারালেও নিজেকে সামলে নিতে সচেষ্ট হয়।
বুদ্ধিগতভাবে পরিণত
উপরের উদাহরণ টেনেই বলা যায়, একটা বাচ্চাকে আপনি চাইলেই যেকোনো কিছু শেখাতে পারেন। কিংবা কোনো কাজ করলে সেটা লাভ হবে না ক্ষতি হবে সেটা সে যাচাই করতে পারে না। কিন্তু পরিণত বয়সের একজনকে চাইলেই আপনি কোনো ক্ষতিকর কাজ করাতে পারবেন না। একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সে কী সিদ্ধান্ত নিবে সেটা নির্ভর করবে তার বুদ্ধিগত পরিপক্কতার উপর। বয়স বাড়লেই যে কেউ যদি সঠিক মাত্রায় পরিণত হতো, তাহলে মানু্ষ ভুল সিদ্ধান্ত নিত না। আমরা প্রতিদিনকার জীবনেই এমনসব মানুষের দেখা পাই!
পরিণত হওয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য
১. ধৈর্য্য
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে আমরা বর্তমানে এমন একধরনের জীবন-যাপন করছি, যেখানে চাওয়ার পরপরই যেকোনো কিছু পেয়ে যাচ্ছি আমরা। প্রয়োজনের কারণে আবিষ্কার হচ্ছে নতুন জিনিস, বদলে যাচ্ছে চাহিদা। সবই যেন আমরা কখন চাইব তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এটা সার্বজনীন কোনো চিত্র নয়। এখনো প্রচুর মানুষ আছেন, যারা চাইলেই যেকোনো কিছু ইচ্ছেমতো নিজের করে নিতে পারেন না। কিংবা একটা বয়সে পৌঁছানোর পর সবকিছু আর প্ল্যানমাফিক চলে না। তখন একটা জিনিসই করার থাকে, আর তা হলো ধৈর্য্যধারণ করা। আপনি যখন কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নীরবে কাজ করে যাবেন ধৈর্য্য সহকারে, তখনই বুঝে নিতে হবে, আপনি পরিণত হচ্ছেন আসলে। তখন ধৈর্য্যই পারবে আপনার চাহিদার মাত্রার লাগাম টানতে, অল্পতেই আপনাকে খুশি করতে।
২. ক্ষমা করার মানসিকতা
আমি এমন এক নির্জনতার ভেতর বাস করি যা তরুণ বয়সে বিরক্তের, আর পরিণত বয়সে মজার।
– আলবার্ট আইনস্টাইন
ছোট বয়সে আমাদের কাছে প্রতিটি ছোট ঘটনাই বড় হয়ে ধরা দেয়। কারণ এই বয়সে জীবনে খুব তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটে না সাধারণত। তাছাড়া ঘটনাপ্রবাহও ধীরেই আবর্তিত হতে থাকে একটা নির্দিষ্ট রুটিনমাফিক। তাই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো নিয়েও অল্পবয়সী একটা বাচ্চা মাথা ঘামায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সাথে ঘটা ব্যাপারগুলোরও মানে বদলায়। একটা সময় গিয়ে আপনি বুঝতে পারেন, আশপাশের মানুষের সাথে তর্ক করে সময় নষ্ট করার চেয়ে আপনার আসলে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হওয়া দরকার। সবাই আপনার মনমতো হবে এটা ভাবা বোকামি। সুন্দরভাবে জীবনটা পার করতে হলে জীবনে অনেক কিছুই আপনাকে এড়িয়ে যেতে হবে। আপনি চাইলেই সবগুলো সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। তাই ক্ষমা করাটাই সবজেয়ে ভালো উপায় হতে পারে। এরকম ছাড় দেয়ার মানসিকতাই আপনার পরিণত হওয়ার পরিচয় বহন করবে।
৩. শোনেন বেশি, বলেন কম
আমরা সবসময় বলতে ভালবাসি, নিজেকে নিজের মনের ভাবগুলোকে সবার আগে স্থান দিতে চাই। এটাই মানবপ্রকৃতি, সবসময় নিজেকে সবার মধ্যমণি ভাবা। আপনি পরিণত হয়ে গেলে নিজে থেকেই বলার মানসিকতা বদলে শুনবেন বেশি। হয়তো ব্যাপারটা আপনি কখনো খেয়াল করবেন না, স্বাভাবিত পরিবর্তনগুলোর মতোই অভ্যাসটা আপনার সাথে মিশে যাবে। যেখানে অল্প বয়সে সবার আগেই কথা বলতে চাইতেন, সেটা বদলে সবার পরে তথ্যনির্ভর আর যুক্তিভিত্তিক কথা বলার প্রতি আপনার মন থাকবে। আর এই ধরনের কথা বলার ভঙ্গি মানুষ মনোযোগ দিয়ে শুনতে চায়।
৪. মুখে হাসি ধরে রাখা
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, যখন বায়না ধরে কিছু চাওয়ার পর না পেলে কান্না জুড়ে দিতেন? বড় হওয়ার পর আমরা চাইলেও কান্না করি না। পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদেরকে এটাই শেখায়, এটাই বাস্তবসম্মত। যত অভিযোগ ভুলে আরেকটি কাজে মনোযোগ দেবেন, তত দেখবেন অপ্রাপ্তিগুলো আর আপনাকে পরাজিত করতে পারছে না। মুখের কোণে একচিলতে হাসি ধরে রাখাটা আপনার মনের বয়স অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে নিমেষেই।
৫. সবাইকে খুশি করতে চাইবেন না
অনেকেই আছেন যারা নিজেদের আশপাশের সব মানুষকেই খুশি করতে চেষ্টা করেন। এই কাজ করলে মানুষ কী ভাববে, এটা না করলে তিনি কী ভাববেন- এরকম ভাবনা নিয়ে অনেকেই জীবন পার করে দেয়। কিন্তু এগুলো করতে গিয়ে আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার খুশির জায়গাটা কোথায় হারিয়ে গেছে? একটা বয়সে গিয়ে কি চাইলেই সব মানুষকে কাছে পাবেন, যাদেরকে সারাজীবন খুশি করতেই ব্যস্ত ছিলেন? সবচেয়ে বড় কথা হলো, এত কিছুর পরও দেখবেন কেউ না কেউ এখনও অখুশি! জীবনের এই ফাঁদ যখন আপনি বুঝতে পারবেন, তখন থেকেই নিজেকে পরিণত ভাবতে পারবেন।
৬. বয়সে ছোটদের ভালবাসবেন
ছোট বাচ্চা কিংবা বয়সে একটু ছোটদের সাথে কখনো সময় কাটিয়ে দেখেছেন? কেমন যেন একটা প্রশান্তি বয়ে আনে তারা! তাদের দুষ্টুমি আর নির্ভেজাল কৌতূহল মেশানো কথাবার্তা আপনার মনকে প্রশান্ত করবে। প্রতিদিনকার ব্যস্ততা আর কাজের চাপে নিজের আত্মার চাহিদার কথা আমরা ভুলে যাই। তখন কোথায় প্রশান্তি পাব সেটা খু্ঁজতে গিয়ে জীবনের ভারসাম্য হারান অনেকে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আপনার আশপাশেরই কোনো এক ব্যক্তি বাচ্চাদের সময় দিচ্ছেন। বুঝে নেবেন, তিনি এখন পরিণত, নিজের প্রশান্তির জায়গাটা তিনি পেয়ে গিয়েছেন।
৭. পরিণত ব্যক্তি অপরের সিদ্ধান্ত, বিশ্বাসকে সম্মান করেন
পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে হয়তো সঙ্গীদের সাথে প্রচুর কথাকাটি হয় সবার। কারণ অনেক সময় আরেকজনের মতামত আমাদের পছন্দ হয় না। তখন হাতাহাতি থেকে শুরু করে মারামারি পর্যন্ত ঘটে যায়। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, যাদের সাথে মিশবেন তাদের সবার মতামত কিংবা সিদ্ধান্ত আপনার সাথে মিলবে না। তাই একজন পরিণত মানুষ সবসময় বিশ্বাসের অমিল হলেও সেটাকে সম্মান দেখানোর মাধ্যমে তর্ক থামিয়ে দেন। আর আপনিও যদি এমন করে থাকেন তাহলে বুঝে নেবেন, আপনি বড় হয়ে গেছেন।
৮. দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়া
একটা বয়স আসে যখন আপনার উপর অনেকগুলো দায়িত্ব চলে আসে। সেটা হতে পারে পরিবার সামলানো কিংবা আপনার চাকরি। এগুলো চাইলেও আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। তাই পরিণত মানুষরা ব্যাপারটা মেনে নেন এবং দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধায় ভোগেন না। আর আপনি যদি এরকম পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন, তাহলে দেরিতে হলেও আপনাকে ভুগতে হবে। তাই সময় থাকতেই ব্যাপারগুলো শিখে নেয়াই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।
৯. সব সিদ্ধান্তে আপনার মতামত প্রয়োজনীয় নয়
আমাদের ভেতর বয়সে বড়দের মাঝে একটা প্রবণতা থাকে যে, সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করা। ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, তারপরও তারা নতুন সংসারে সবকিছুতে মতামত দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা কখনোই বুঝতে পারেন না, ছোট ছেলে-মেয়েগুলো বড় হয়ে গিয়েছে। তারাও বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়ে আজকের বয়সে পৌঁছে গেছে। এভাবে তাদের সিদ্ধান্তের মাঝে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে কারোরই আর শান্তিটা ঠিক থাকে না। তাই কেবল বয়সের দিক থেকে বড় না হয়ে পরিবর্তনগুলোর সাথেও মানিয়ে চলা শিখতে হয়। তবেই একজন মানুষ পরিপক্বতা লাভ করে।
১০. যা বলেন, তা-ই বুঝিয়ে থাকেন
ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলায় অভ্যস্ত মানুষ চারপাশে একটু নজর দিলেই আপনার চোখে পড়বে। কিন্তু একজন পরিণত মানুষ কথা বলার সময় যা বলেন তা-ই সাধারণত বুঝিয়ে থাকেন। কারণ তিনি জানেন, এই অভ্যাস অন্যদেরকে তার অবস্থানের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা দেবে। অপরকে খুশি করতে গিয়ে যদি কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যে, আপনি না চাইলেও ‘হ্যাঁ’ বলতে হচ্ছে, তবে পরিণত হতে আরও সময় প্রয়োজন আপনার। কারণ আপনার মনের আর মুখের ভাষা এক নয়।