করোনাভাইরাস যে শুধু পৃথিবীর বুকে আর্থ-সামাজিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে, তা-ই নয়, একইসাথে মানসিক টানাপোড়েন এবং সেখান থেকে তৈরি হওয়া পারিবারিক অশান্তি, কলহ ও বিবাহবিচ্ছেদের পরিমাণকেও বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটা। চীনে প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পর্ক বিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যায়। তবে এবার, ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকেই সে বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে অনেক বেশি।
একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেও। দূরত্ব যদি মনে ভালোবাসা আর আবেগের জন্ম দিয়ে থাকে, সবসময় একসাথে থাকার ব্যাপারটি এর উল্টোটাও তৈরি করতে পারে। কিন্তু করোনাভাইরাসের মধ্যকার বাড়তে থাকা সাম্প্রতিক এই বিচ্ছেদের কারণ কী? শুধু কি একসাথে অনেকটা সময় কাটাতে হচ্ছে বলেই সম্পর্কে অনীহা কিংবা বিষাক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে? চলুন, কিছুটা ভেবে দেখা যাক।
বিয়ের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের শুরুটা যেহেতু শুরু হয় বিয়ের মাধ্যমে, তাই আলোচনাটাও সেখান থেকেই শুরু করা যাক। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭,৫০০টি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত কাজী অফিসে অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে বিয়ে হচ্ছে। মার্চের দিকে সংখ্যাটি প্রায় ৯৬ শতাংশে কমে আসলেও এখন কিছুটা হলেও সেটি বাড়ছে। হয়তো খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়, তবে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় অনেকেই বিয়ের কাজটা সেরে নিচ্ছেন এ সময়ে। তবে একদিকে যেমন বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি কোভিড-১৯ এর জন্য বাড়ছে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাও।
চীনের হুনান প্রদেশের সিটি রেজিস্ট্রেশন সেন্টারের মতে, অনেকের ক্ষেত্রে অনেকটা সময় কাজের জন্য বাড়ির বাইরে থাকা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব একটা যোগাযোগ না করাটা সম্পর্কে সমস্যা তৈরি করছে। অন্যদিকে, সাংহাইয়ের ডিভোর্স উকিল স্টিভ লি’র মতে, মার্চের শুরু থেকে যে ২৫ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে, তার পেছনে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কও অনেকটা দায়ী। পুরোটা সময় ঘরে থাকায় পরকীয়ার সাথে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন যারা, তাদের দাম্পত্যে প্রভাব পড়ছে। তবে পাশাপাশি পারিবারিক কলহের ভিন্ন আরেকটি দিকও তুলে ধরেন তিনি। বড় কোনো ছুটির সময় পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার সম্পর্কে অনেকসময় তিক্ততা সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন স্টিভ।
বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি হয়তো হিসেব করা সম্ভব হচ্ছে। তবে শুধু দম্পতিরা নন, পরিবারের বাকিরাও করোনাভাইরাসের কারণে এই লম্বা সময় পর্যন্ত একসাথে, কম দূরত্বের মধ্যে থাকার নেতিবাচক প্রভাব ভোগ করছেন বলে জানান তিনি।
ডিভোর্সের এই চিত্র শুধু পশ্চিমা বিশ্ব বা চীনেই নয়, প্রকট হয়ে উঠেছে সৌদি আরবেও। মহামারিকালে দেশটিতে বিচ্ছেদের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে বেশিরভাগ নারী ডিভোর্স চাওয়ার পেছনে কারণ দেখিয়েছেন পরকীয়াকে। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ প্রভাব ফেলেছে এবং এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়েছে নির্যাতনের মাধ্যমে। সম্প্রতি স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একটি সমীক্ষায় উঠে আসে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এসে দেশের ৬৪টি জেলার ২৭টিতে বর্তমানে মোট ৪,২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ জন শিশু গৃহ নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে, যাদের মধ্যে ১,৬৭২ জন নারী ও ৪২৪ জন শিশু প্রথমবারের মতো এই নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে। আর এই পুরো সমীক্ষাকেই প্রভাবিত করেছে করোনাভাইরাস।
এখন প্রশ্ন হলো, চীনের বিশেষজ্ঞ স্টিভের বক্তব্য অনুসারে পরকীয়া এবং ব্যক্তিগত দূরত্বের অভাব- এই দুটো কারণ ছাড়াও আর কোন কারণগুলো বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে?
এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমেই যে কারণগুলো উঠে আসে, সেগুলো হলো-
আর্থিক সমস্যা
বর্তমান সময়ে অনেকেই আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। অনেক অফিস কর্মী ছাঁটাই করেছে, স্থগিত আছে বা নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। আর এমতাবস্থায় প্রাত্যহিক নানাবিধ অশান্তি, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক কলহ এবং সেখান থেকে বিচ্ছেদের মতো অবস্থার জন্ম হচ্ছে।
দায়িত্ব
করোনাভাইরাস আমাদের সবাইকেই নতুন করে নিজেদের ঢেলে সাজানোর সুযোগ করে দিয়েছে। ঘরে অনেকটা সময় কাটানোয় সন্তান থেকে শুরু সব কাজের দায়িত্বকেই একসাথে মিলে ভাগ করে নিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু অনেক দম্পতির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কাজ করছে না। তৈরি হচ্ছে মানসিক সংঘর্ষ।
মানসিক সমস্যা
এতটা সময় আমরা অনেকেই হয়তো ঘরে বসে বা খুব ভয়ের সাথে চলাফেরা করে অভ্যস্ত নই। এই হুট করে তৈরি হওয়া অবস্থা আমাদেরকে যেমন মানসিক চাপ দিচ্ছে, তেমনি সবসময় চলতে থাকা উদ্বিগ্নতাও মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সবমিলিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রচণ্ড হতাশা, উদ্বিগ্নতা, অবসাদ এবং আরো অনেক মানসিক সমস্যা। একদিকে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত যেমন বেড়ে গিয়েছে, ঠিক একইভাবে বেড়েছে বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
মানুষ বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ নির্ভরশীলতা অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছিল। তবে বর্তমানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব জেনেই অন্তর্জালের দুনিয়ায় প্রবেশ করছে মানুষ একটু বেশি। একইসাথে এসব মাধ্যম তৈরি করছে হতাশা। সবমিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে অনেকের পক্ষে।
আর এই কারণগুলো বাদেও পূর্বোল্লিখিত কারণ এবং আগে থেকেই সম্পর্কে ঘটে আসা নানারকম সমস্যা তো রয়েছেই। অনেকেই হয়তো সম্পর্ক নিয়ে খুশি ছিলেন না। এই লকডাউন তাদেরকে আবার সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। একসাথে সময় কাটানোর বদলে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাকেই সমাধান মনে করছেন তারা।
করোনাভাইরাস পৃথিবীর কাছে পুরনো ঘটনা হয়ে গেলেও ভাইরাস-পরবর্তী পৃথিবীকে আরো অনেক বেশি সংখ্যক বিবাহবিচ্ছেদ দেখতে হবে কোভিড-১৯ এর কারণে, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।