”ফ্যাশন পরিবর্তনশীল, কিন্তু স্টাইল চিরন্তন”
– কোকো শ্যানেল্
এই একটি কথা ফ্যাশন জগতের মূলমন্ত্র। এই একটি কথার মতোই জীবনের প্রতিটি অংশ ও প্রতিটি মুহুর্ত দিয়ে ফ্যাশন জগৎকে এর আজকের পর্যায়ে আনার পেছনে প্রায় একক ভূমিকা পালন করেছেন কিংবদন্তী ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শ্যানেল্। আরও একটু সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে- নারীদের ফ্যাশনকে ফ্যাশন জগতের কেন্দ্রে পরিণত করেছেন তিনি।
শুধু ফ্যাশনের মাধ্যমেই নয়, একজন আত্মবিশ্বাসী ও প্রগতিশীল নারীর জন্য এই একবিংশ শতাব্দীতেও ম্যাদমোয়াজেল শ্যানেল্ একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শ। শুধু একজন ডিজাইনার হিসেবেই নয়, ম্যাদমোয়াজেল শ্যানেল্ সংগীত জগতেও সফলভাবেই পদচারণা করেছিলেন। কীভাবে তিনি একটি ট্যুইড জ্যাকেট ও ‘লিটল্ ব্ল্যাক ড্রেস’ থেকে শুরু করে পারফিউম পর্যন্ত একটি ফ্যাশন হাউজের প্রায় প্রতিটি পোশাককে ‘ক্ল্যাসিক’ এ রূপান্তরিত করেছিলেন? কীভাবে তিনি ফ্যাশনকে ‘বিলাসিতা’ থেকে ‘দৈনন্দিন’ এর পর্যায়ে এনেছিলেন? আজ আমরা জানবো চমৎকার এ বিষয়গুলো নিয়েই।
প্রাথমিক জীবন
গ্যাব্রিয়েল বনহুর শ্যানেল্ এর জন্ম ১৮৮৩ সালের ১৯ আগস্ট ফ্রান্সের সোমুর এ। দারিদ্র্যের মাঝে জন্মানো শ্যানেলের মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পরে তার বাবা তাকে একটি অনাথ আশ্রমে ছেড়ে চলে যান। ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি ফ্যাশনের সাথে জড়িত ছিলেন না। বরং বিভিন্ন ক্যাফেতে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর এভাবেই ‘কোকো’ নামটির উৎপত্তি। আটলান্টিক থেকে জানা যায়, ম্যাদমোয়াজেল নিজেই বলেছিলেন যে, ’কোকো’ নামটি এসেছে ‘কোকেট’ শব্দটি থেকে। ফরাসি কোকেট অর্থ ‘রক্ষিতা’। আর এভাবেই তিনি কোকো শ্যানেল্ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেন।
অনাথ আশ্রমে মিশনারী নানদের কাছে লালিত পালিত হওয়ার দিনগুলোতে কোকোর একটু মুক্তির অবকাশ মিলতো, যখন ছুটির দিনগুলোতে তিনি তার খালাদের বাড়ি বেড়াতে যেতেন। এই খালারাই তাকে পোশাক, হ্যাট ও বনেটসহ অন্যান্য অনুষঙ্গে পাড়, কুঁচি, ফিতা ও আরও বিভিন্ন এমবেলিশমেন্ট সেলাইয়ের মাধ্যমে জুড়ে দিতে শেখান। এভাবেই হাতেখড়ি হয় ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শ্যানেলের। মিশনারী আশ্রমে বড় হয়ে ওঠা শ্যানেল্ বরাবরই ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তিনি সমাজের উঁচু স্তরের নারীদের মতো সম্মানিত ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তো অনাথ আশ্রমের পাঠ চুকিয়ে তিনি ভর্তি হন নটর ডেম স্কুল অফ ফিনিশিং ফর গার্লসে। এখান থেকেই তিনি একটি ক্যারিয়ার ও নিজস্ব একটি ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনুপ্রাণিত হন।
ফ্যাশন জগতে পদার্পণ
”বিলাসিতা যদি আরামদায়ক না হয়, তাহলে সেটি বিলাসিতার পর্যায়েই পড়ে না”
– কোকো শ্যানেল্
১৯১০ সালে আর্থার (বয়) চ্যাপেল নামে সমাজের প্রভাবশালী একজন পুরুষের সাথে মিলে প্যারিসের রু ক্যাম্বনে তিনি প্রথম একটি টুপির দোকান চালু করেন। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে ফ্রান্সের ডভিলে আরও একটি দোকান চালু করা হয়। একইসাথে তিনি খুব সাধারণ কিছু স্পোর্টস্ওয়্যারও বিক্রি করতেন। পাঁচ বছরের মধ্যেই তার ডিজাইন করা এই ‘গরীব মেয়ে’র পোশাক হিসেবে তৈরি স্পোর্টস্ওয়্যার সমাজের প্রভাবশালী মহলে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। আর এভাবেই নারীর ফ্যাশনে আরামদায়ক পোশাকের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইতিহাসে কোকো শ্যানেল্ তথা ‘হাউজ অফ শ্যানেল্’ এর কিংবদন্তী পদযাত্রার শুরু। ১৯২০ সালের মধ্যেই শ্যানেল্ ইন্ডাস্ট্রিজের মূল্য কয়েক মিলিয়নে পৌঁছে যায়। একইসাথে শ্যানেলের কুতুর হাউজ, সুগন্ধি গবেষণাগার, বস্ত্র কারখানা এবং একটি জুয়েলারি ওয়ার্কশপ- সব মিলে প্রায় ২,০০০ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছিল।
শ্যানেল্ নং ৫
সুগন্ধি ফ্যাশনের সেই অদৃশ্য, চিরস্মরণীয় ও অনন্য অনুষঙ্গ… যা তোমার আগমনের ইঙ্গিত প্রদান করে আর তোমার প্রস্থানের পরেও তোমার উপস্থিতিকে বিদ্যমান রাখে
– কোকো শ্যানেল্
শ্যানেল্ নামক ফ্যাশন সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তির সবচেয়ে কার্যকরী পণ্য ছিল শ্যানেল্ নং ৫ নামক সুগন্ধি, যা আজও বিশ্বজুড়ে নারীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। ১৯২২ সালে ফ্রান্সের সবচেয়ে মেধাবী সুগন্ধি প্রস্তুতকারকদের মধ্যে অন্যতম, আর্ন বুও, এর সাহায্যে শ্যানেল্ বিশ্বের সবচেয়ে সফল এই সুগন্ধি তৈরি করেন। এটি বিশ্বের প্রথম সুগন্ধি, যার নামকরণ ডিজাইনারের নামের সাথে সম্পর্কিত। শ্যানেলের জন্য বুওর তৈরি বিভিন্ন সুগন্ধির সিরিজ থেকে তিনি পাঁচ নম্বর কম্বিনেশনটি সবচেয়ে পছন্দ করেন। এটি ছিল জুঁই ও অন্যান্য কয়েকটি ফুলের সৌরভের সমন্বয়ে তৈরি, যা সমসাময়িক একক সৌরভযুক্ত সুগন্ধির চেয়ে স্বভাবতই ভিন্ন ছিল।
এছাড়া এর প্যাকেজিংয়ে সাধারণ কিন্তু আকর্ষণীয় আকারের বোতলের প্রচলনও এর সাফল্যের পেছনে ভূমিকা পালন করে। এই সুগন্ধির বাজারজাতকরণ ও বিক্রির জন্য শ্যানেল্, গ্যালারী লেফায়েৎ নামক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্ণধার থিওফাইল ব্যাডার এবং বুর্জোয়া কসমেটিক্স কোম্পানির পিয়ের ওয়ার্থিমারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু এই চুক্তি অনুসারে শ্যানেল্ এই সুগন্ধি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের মাত্র ১০ শতাংশের অধিকারী ছিলেন। পরবর্তী কয়েক দশক যাবৎ তিনি কয়েকদফা মামলা করেও তিনি তাঁর এই স্বকীয় সুগন্ধির মালিকানা ফেরত নিতে ব্যর্থ হন।
লিটল্ ব্ল্যাক ড্রেস (এলবিডি)
অগোছালোভাবে পরিহিত পোশাকের ক্ষেত্রে পোশাকটিই মানুষের মনে জায়গা করে নেয়, আর গোছানো পোশাকে সজ্জিত মানুষটিকেই অন্যরা মনে রাখে
– কোকো শ্যানেল্
১৯১৯ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বয় চ্যাপেলের মৃত্যুতে শ্যানেল্ শুধু মানসিকভাবে ভেঙেই পড়েননি, বরং তিনি এই মৃত্যুর জন্য সমাজের ধনী ও অভিজাত শ্রেণীকে দায়ী করেন। তিনি ছিলেন ক্রুদ্ধ। আর এই ক্রোধই তাকে সমাজের প্রচলিত ফ্যাশনকে আমূল পরিবর্তনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। তিনি অভিজাত শ্রেণীর সাথে মিশে, তাদের মাঝে থেকে, তাদেরই একজন হয়ে উঠে ফ্যাশন জগতের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠার পরিকল্পনা করেন। আর এরই প্রয়াস হিসেবে ফ্যাশন জগতে আগমন ঘটে ’লিটল্ ব্ল্যাক ড্রেস’ এর। একসময় যে কাল রঙকে শোকের প্রতীক হিসেবে দূরে রাখা হত, তা-ই আজকের যুগে প্রতিটি ফ্যাশন সচেতন নারীর ক্লোজেটের একটি অত্যাবশ্যক অংশ।
স্যুট ও স্কার্ট
এলবিডি ছাড়াও তিনি মেয়েদের জন্য কলারবিহীন স্যুট ও স্কার্টের প্রচলন করেন- এই স্কার্টের দৈর্ঘ্য হাঁটুর সামান্য নিচ পর্যন্ত ছিল। পুরুষদের ফ্যাশন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তৈরি এ ধরনের পোশাক তৎকালীন সমাজে এমনিতেও যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। ১৯২০ এর দশকের শেষ পর্যায়ে মেয়েদের তৎকালীন ফ্যাশনের অনুষঙ্গ কোরসেট এর বিদায়ও ঘটে এরই সাথে। এই সময়ে শ্যানেল্ পোশাক ও সুগন্ধি ছাড়াও লাল রঙের লিপস্টিক, নেল পলিশ ও সানট্যান তেলের মাধ্যমে নারীর প্রসাধনেও পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তিনি বেল বটম প্যান্টেরও প্রবর্তন করেন। তিনিই “ফ্যাশন স্টেটমেন্ট” কথার প্রবর্তক। আর এভাবেই কোকো শ্যানেল্ নারীর ফ্যাশনের জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হন। “হাউজ অফ শ্যানেল্” ছিল তার তীর্থস্থান।
অভিযোগ ও স্বেচ্ছা নির্বাসন
সমাজের বিত্তশালী ও প্রভাবশালী পুরুষদের সাথে তার বন্ধুত্ব বিভিন্নভাবে তার জীবনকে তথা তার ব্যবসায়কে প্রভাবিত করেছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান সেনার সাথে তার বন্ধুত্বের কারণে যুদ্ধ পরবর্তী ফরাসি সমাজ গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ করে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। হাউজ অফ শ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়। কারও মতে, তিনি ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে মুক্তিলাভ করেন। আবার এমনও শোনা যায়, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলের সাথে শখ্যতা থাকায়, চার্চিল স্বয়ং এই ব্যাপারে জড়িত হয়ে তাকে মুক্ত করেন। শ্যানেল্ জানতেন, এই পরিণতির জন্য তিনি নিজেও বেশ খানিকটা দায়ী। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি বেশ ভেঙে পড়েন এবং ফ্রান্স ত্যাগ করে সুইজারল্যান্ডে কিছু সময়ের জন্য স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। তিনি রোকারব্রুনে তার গ্রামের বাড়িতেও কিছু সময় কাটান।
সম্রাজ্ঞীর প্রত্যাবর্তন
১৯৪৭ সালে আরেকজন ফরাসি ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান দিওর এক নতুন ধরনের পোশাকের প্রচলন করেন- এই পোশাকের কোমরের কাছে ছিল কুঞ্চিত, দৈর্ঘ্য ছিল বেশি, এটি ছিল একটি পূর্ণ স্কার্ট এবং এক্ষেত্রে কাপড়ের ব্যবহারও ছিল অনেক বেশি। এটি দৃঢ়, অলংকৃত ছিল এবং শ্যানেলের তৈরি সকল কিছুরই বিপরীত ছিল। এই সময়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীরা খুব শীঘ্রই আরও আধুনিক পোশাকের চাহিদা করবে। সুতরাং তাকে ফ্যাশন জগতে ফিরে আসতেই হবে। কিন্তু ফরাসি জাতি তার এই প্রত্যাবর্তনে খুশি হতে পারেনি।
বয়স ৭০ এর কোঠায় নিয়ে শ্যানেল্ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালেকশনের ডিজাইন করেন। এটি ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী ফ্রান্সে তার প্রথম কালেকশন। প্রতিটি মডেল যেন তার বশে ছিল। এই কালেকশনের ঝুঁকি ছিল অনেক বেশি- হয় তিনি তার রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সফল হবেন অথবা চিরতরে হারিয়ে যাবেন। ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আখ্যায়িত শ্যানেলের এই কালেকশনটি ফরাসি জাতির কাছে খুব একটা সমাদৃত হয়নি, বরং বেশ সমালোচনার শিকার হয়। তবে এটি তার পরাজয় ছিল না, ছিল ফ্যাশন সম্রাজ্ঞী হিসেবে চিরন্তন খ্যাতিলাভের আরম্ভ। এই কালেকশনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই আটলান্টিক এর অপর পাড় থেকে অভিনেত্রীরা দলবেঁধে তার দ্বারস্থ হন। আমেরিকানরা শ্যানেলের ডিজাইনের ভক্ত হয়ে যান। শ্যানেল্ আবারও তার হারানো রাজত্ব ফিরে পান, আর এবারের সাফল্য আগেরবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছিল। হাউজ অফ শ্যানেলের মূল্য আবারও মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। পুরুষ শাসিত ফ্যাশন জগতে এটি আবারও শীর্ষস্থান দখল করে নেয়।
চিরবিদায়
১৯৬৯ সালে কোকো শ্যানেলের জীবনগাঁথা ব্রডওয়ের বিখ্যাত নাটক ‘কোকো’র মাধ্যমে তুলে ধরা হয়, এতে মুখ্য ও নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন অভিনেত্রী ক্যাথারিন হেপবার্ন। ১৯৭০ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি প্যারিসের হোটেল রিটজ্ এ নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শত শত ভক্ত চার্চ অফ ম্যাডেলিনে শ্যানেল্ স্যুট পরেই এই কিংবদন্তী ডিজাইনারকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছিলেন। তার মৃত্যুতে হাউজ অফ শ্যানেলের খ্যাতি কখনোই কমে যায়নি। বরং এই হাউজটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড। কোকো শ্যানেলের মৃত্যুর ঠিক এক যুগ পরে ১৯৮৩ সালে জার্মানিতে জন্ম গ্রহণকারী ডিজাইনার কার্ল লগারফেল্ড হাউজ অফ শ্যানেলের প্রধান ডিজাইনার তথা আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ব্র্যান্ডটিকে আজকের জনপ্রিয় অবস্থানে নিয়ে আসেন।
ফ্যাশন সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি