
কথায় বলে মুক্তোর মতো লেখা, যা মূলত সুন্দর হাতের লেখার প্রশংসা করার জন্যেই ব্যবহার করা হয়। তবে ধরনভেদে হাতের লেখার তারতম্যও চোখে পড়ে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বর্তমানে হাতের লেখার প্রয়োজন দিনকে দিন অনেক কমে যাওয়ার কারণে হয়তো সুন্দর হাতের লেখার কদর আর আগের মতো পাওয়া যায় না।
সকলের হাতের লেখা একই রকম হয় না তা বলাই বাহুল্য। তবে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর জন্যে ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মনেই হাতের লেখা সুন্দর করার একটি নীরব বাসনা থাকে। কেউ বংশগতভাবে খুব সুন্দর লেখার অধিকারী হয়, আবার কারো লেখা বুঝতে পারা দায়। সুন্দর হাতের লেখার কদর স্কুলজীবন থেকে শুরু করে জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে। তবে আমাদের অনেকের ধারণা, লেখা যদি সুন্দর না হয়, তবে তা আর পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। নিয়মিত অনুশীলন ও কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে খুব সহজেই হাতের লেখা সুন্দর করে তোলা সম্ভব।

কীভাবে হাতের লেখা পরিবর্তন করা যায়? Source: youtube.com
নিজের ইচ্ছে বা আগ্রহ
হাতের লেখা সুন্দর করার জন্যে সবচাইতে যেটি বেশি প্রয়োজন তা হলো নিজের ইচ্ছাশক্তি। কথায় বলে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তাই কেউ যদি আসলেই নিজের হাতের লেখা সুন্দর করতে চান তাহলে কিছুটা কষ্ট, শ্রম ও সময় ব্যয় করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। উপযুক্ত চেষ্টার ফলেই হাতের লেখা সুন্দর করে তোলা সম্ভব।
বর্ণমালার পৃথক অনুশীলন
যেকোনো বাক্য তৈরিতে বর্ণমালা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর বর্ণমালা থেকেই মূলত লেখার শুরু। কয়েকটি বর্ণ যুক্ত হয়ে কোনো শব্দ তৈরি হয় আর কিছু শব্দ নিয়ে তৈরি হয় বাক্য। তাই প্রথমেই বর্ণ সুন্দর করে লেখার অভ্যাস করতে হবে। বর্ণ লেখার বিভিন্ন রকম পদ্ধতি বা উপায় রয়েছে। কেউ টানা হরফে, কেউ গোল গোল হরফে আবার কেউ সোজাসোজি হরফে লিখতে পছন্দ করেন।

পৃথক পৃথকভাবে বর্ণমালা লেখার অনুশীলন; Source: youtube.com
নিজের পছন্দমতো যেকোনো একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য কোনো বই বা ইন্টারনেট ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোটদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হলে বড় কারো কাছে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। তবে যেকোনো ভাষায় লেখার হাত সুন্দর করতে হলে প্রথমে অবশ্যই বর্ণের উপর জোর দিতে হবে।
উপযুক্ত উপাদান সংগ্রহ করা
কেউ যদি খুব পরিকল্পিতভাবে লেখা সুন্দর করার কথা চিন্তা করেন তবে অবশ্যই কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিজের কাছে সংগ্রহ করে রাখা উচিত এবং তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা উচিত। প্রথমে ঠিক করতে হবে পেন্সিল না কলম দিয়ে লেখা অনুশীলন করবেন। নিজে যেটিতে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেই উপাদানই বেছে নেয়া উচিত। এসব ক্ষেত্রে অন্য কাউকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের পছন্দ বা স্বাচ্ছন্দ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। হাতের লেখা সুন্দর করার জন্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কাগজ। সাদা কাগজ বা সমান্তরাল দাগ টানা খাতা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে লেখা সোজা রাখার জন্যে দাগ টানা খাতা ব্যবহার করা অনেক বেশি সুবিধাজনক।

পেন্সিল ও কলম সংগ্রহে রাখা; Source: globalcaremarket.com
সঠিকভাবে কলম ধরা
লেখা সুন্দর করার পেছনে সঠিকভাবে কলম বা পেন্সিল ধরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে কলম বা পেন্সিল ধরার তেমন কোনো লিখিত নিয়ম নেই। এসব ক্ষেত্রে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে অনেকের ধারণা কলমের মাথার একটু উপরে ধরলে লেখা অনেকটা ধীরে হয় এবং সোজা থাকে।

সঠিকভাবে কলম ধরার চেষ্টা করতে হবে; rd.com
শারীরিক অবস্থান
লেখার ক্ষেত্রে নিজের শরীরের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা একান্ত প্রয়োজনীয়। লেখার অনুশীলনীর জন্যে অবশ্যই চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করা উচিত। নিজের শরীরকে যতটা সম্ভব কাগজের কাছাকাছি এনে লেখার চেষ্টা করতে হবে। আর লেখার সময় যতটা সম্ভব শরীর এবং হাত নমনীয় রাখার চেষ্টা করতে হবে।

শরীরকে যতটা সম্ভব খাতার কাছাকাছি রাখতে হবে; Source: wikihow.com
ধীরে লেখার চেষ্টা
লেখার অনুশীলনীর জন্যে ধীরভাবে লেখার চেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কতটা দ্রুত লেখা শেষ করা যায় তার দিকে নজর না দিয়ে ভুল শব্দের মাত্রা কমিয়ে ধীরে ধীরে লেখার অনুশীলন করতে হবে। লেখা শেখা কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা নয়। তাই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে ধীরে ধীরে লেখা সুন্দর করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কিছু সময় পর লেখার গতি আপনা-আপনি বেড়ে যাবে। প্রথমদিকে লেখার স্বাভাবিক ধরন কিছুটা বড় বড় আকার ধারণ করতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। লেখার উপর যখন নিজের দখল তৈরি হবে তখন নিজে থেকেই লেখার আকার আপনার ইচ্ছের উপর পরিবর্তন হয়ে যাবে।
সোজা করে লেখার চেষ্টা
অনেকের লেখার একটি অন্যতম সমস্যা হলো লেখা কখনোই সোজা থাকে না। কারো লেখা উপরের দিকে উঠে যায় আবার কারো লেখা যায় নিচের দিকে। তাই কিছুটা লেখার পরেই পুরো লেখাটা দেখতে অনেকটা বিদঘুটে লাগে। তবে কিছুদিনের চেষ্টায় এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এই সমস্যা সমাধানে সমান্তরাল দাগ টানা খাতা ব্যবহার করা উচিত। প্রাথমিকভাবে এই দাগ টানা খাতাগুলো খুব সহজেই লেখা সোজা রাখতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি সাদা খাতার উপর লেখার সময় সমান্তরাল রেখা টানার কোনো দন্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।
নিয়মিত অনুশীলন
নিয়মিত লেখালেখির চর্চা করা লেখা সুন্দর করার এক এবং অদ্বিতীয় উপায়। একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে নিয়মিত হাতের লেখা চর্চা করে যেতে হবে। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে আমাদের লেখালেখির অভ্যাস অনেকটাই কমে গেছে বললেই চলে। তবে লেখা সুন্দর করার ইচ্ছে থাকলে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে ধৈর্য্যের সাথে অনুশীলন করতে হবে। তবেই একটি সময় এর ফলাফল আপনি পাবেন।

নিয়মিত লেখার অনুশীলন করে যেতে হবে; Source: youtube.com
লেখা সুন্দর করার ব্যাপারটি পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক এবং উপযুক্ত প্রচেষ্টার ফসল। তবে কেউ যদি নিজের লেখার প্রতি উদাসীন হোন বা তেমন যত্নবান না হোন তাহলে তার ক্ষেত্রে এসকল পদ্ধতি মোটেও প্রযোজ্য নয়। তবে আমাদের একটি ব্যাপার অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, সুন্দর লেখার কদর সবসময় রয়েছে। পাশাপাশি সুন্দর হাতের লেখা নিজের মনকেও এক ধরনের প্রশান্তি দেয়। সুন্দর হাতের লেখা অনেকটা ছবি আঁকার মতো। যাদের হাতের লেখা সুন্দর তারা জীবনে কখনো কারো কাছে প্রশংসিত হননি এমনটা কখনো দেখা যায় না। হাতের লেখা সুন্দর করার কোনো বয়স নেই। যেকোনো বয়সে হাতের লেখা পরিবর্তন করা যায়।

লেখা সুন্দর করার জন্যে নিজের ইচ্ছাশক্তিটাই আসল; Source: youtube.com
কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি যখন সত্যজিত রায়ের সাথে ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রের কাজ করছিলেন তখন রবীন্দ্রযুগের রাবিন্দ্রিক ছোঁয়া আনার জন্যে ছয় মাস ধরে সেই সময়কার পুঁথি, পুঁথির নকল, দিনলিপি, ছবি ইত্যাদি থেকে লেখা অনুশীলন করে নিজের লেখার ধরনই পাল্টে ফেলেছিলেন। তাই মানুষের চেষ্টার কাছে অসাধ্য বলে কিছু নেই। শুধু প্রয়োজন একাগ্রতা ও নিষ্ঠা।
ফিচার ইমেজ- rd.com