অনেক গবেষকই এই প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না। অনেকেই গ্রাফোলজি নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করে থাকেন। তবে, গ্রাফোলজিস্টদের তরফেও যুক্তি যে কম আছে তা কিন্তু নয়। তারা নানা তথ্য প্রমাণ দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন গ্রাফোলজির মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তির চরিত্রকে বিশ্লেষণ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব।
মানুষের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শব্দ তার নাম, সেহেতু সে তার সইটা করে অনেক যত্নে আর একেবারে নিজের পছন্দমতো। সকলেই চায় তার সইটা হবে সবার চেয়ে আলাদা। এটাই প্রত্যেকের সইয়ে একটা স্বকীয়তা দান করে, যার থেকে স্বাক্ষরকারীর স্বভাবটা অনেকটা চেনা যায়।
একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, বিভিন্ন সময়ে আবেগের ওপর নির্ভর করে একই মানুষের হাতের লেখা বিভিন্ন রকম হয়। উত্তেজনার সময় হাতের লেখা হয় অসংলগ্ন, তা নির্দিষ্ট লাইন মেনে চলে না এবং শব্দের মধ্যবর্তী অক্ষরগুলো প্রায় দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আবার য-ফলা বা রেফ এর মতো শব্দ থেকে বেরিয়ে থাকা চিহ্নগুলো খুব বড় বড় হয়ে যায়।
সেই একই মানুষই যখন আনন্দে থাকেন, তখন সই করার সময় একটু জোরে চাপ দিয়ে লেখেন এবং অক্ষরগুলো খুব স্পষ্ট হয়। আবার বিষণ্ন পরিস্থিতিতে হাতের লেখা হয়ে যায় খুব ছোট, অক্ষরগুলো হয় খুব গায়ে ঘেঁষা এবং বড় বড় টান প্রায় থাকে না বললেই চলে। এসব ক্ষেত্রে যেমন তাৎক্ষণিক মানসিক অবস্থার একটা পরিচয় হাতের লেখায় পাওয়া যায়, তেমনি মানুষের সামগ্রিক মানসিকতার একটা প্রতিফলন তার সই থেকেও পাওয়া যায়।
গ্রাফোলজিস্টরা দেখিয়েছেন, কীভাবে নর্তকীর সইয়ে পাওয়া যায় নৃত্যভঙ্গিমার ইঙ্গিত, বিজ্ঞানীর সইয়ে লক্ষ্য করা যায় সুষম শৃঙ্খলা। আবার জনপ্রিয় মানুষেরা সই করেন খুব বড় বড় অক্ষরে ও কলমে জোরে চাপ দিয়ে এবং তাদের টানগুলো হয় বিরাট, তা পাতার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে চলে যায়। বলা বাহুল্য, এই বিশ্লেষণগুলো শতকরা একশভাগই যে মিলে তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও ঘটে। তবে প্রায়ই এরকমটা দেখা গেছে।
নেপোলিয়নের সই প্রথম জীবনে ছিল অনেকটা ছড়ানো। ক্ষমতার শীর্ষে থাকার সময় তার সই হয়ে যায় কিছুটা ছোট, অক্ষরগুলো অনেক আঁটসাঁট, কিন্তু অক্ষরগুলো ভীষণ চাপ দিয়ে লেখা এবং স্ট্রোকগুলোও খুব শক্তিশালী। ১৭৯১ সালে তরুণ সাবলেফটেন্যান্ট নেপোলিয়নের সই এবং ১৮০৫ সালের ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়নের সই পাশাপাশি রেখে গ্রাফোলজিস্টরা এই পার্থক্য দেখিয়েছেন।যখন নেপোলিয়নের পরাজয়ের সময় শুরু হয়, তখন তার সইয়ে আগের সেই দৃঢ়তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে আর জীবনের শেষদিকে তার সই হয়ে যায় খুব ছোট এবং প্রায় দুর্বোধ্য ও হিজিবিজি।
হিটলারেরও উত্থান ও পতনের সময়কার সই অনেকটা আলাদা। হিটলারের জীবনের শেষ দিকে নেওয়া সই বেশ দুর্বোধ্য, পড়ে বোঝা প্রায় অসম্ভব। এই সই যেন একটু প্রতীকীভাবেই নীচের দিকে নেমে গেছে। অসম্ভব দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, কিন্তু কঠিন এক মানুষের সই। এখানে অক্ষরগুলো অনমনীয়।
সই নিয়ে এসব সিদ্ধান্ত অবশ্য বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু ব্যক্তি বহুদিন ধরে মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। আর কিছু না হোক ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীও বটে।
মার্কিন চিত্রাভিনেতা ফ্রেড অ্যাস্টায়ার তার নাচের জন্য খুব বিখ্যাত ছিলেন। তার সইটা এমন কিছু আহামরি নয়, কিন্তু ওপরের দিকের টানগুলোতে নাচের একটা ইঙ্গিত খুব সহজেই পাওয়া যায় এবং এটাই তার সইকে আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে। ফ্রেডের নাচের ভঙ্গির একটা আভাস তার অদ্ভুত `F’ লেখার মধ্যেই পাওয়া যায়।
‘গ্রাফোলজি’র দৌলতে সই থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দোষ-গুণ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়, যা বেশ চিত্তাকর্ষকও বটে। বিভিন্ন ব্যক্তির সই থেকে তাদের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা যাক।
অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়
এ ধরনের লোকদের সই সাধারণত ডান দিকে ঝুঁকে থাকে। অটোগ্রাফের আকার হয় বেশ বড়, অক্ষরের ওপরের ও নীচের দিক যথেষ্ট পরিমাণে লম্বা হয়।
কল্পনাপ্রবণ
এই ধরনের মানুষের সই বেশ বিশাল। এক অক্ষরের সাথে অন্য অক্ষরের কোনো সংযোগ থাকে না। অত্যন্ত আনমনে সই করেন এরা।
অমায়িক মনোভাব
সইয়ের আকার হবে মাঝামাঝি। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে কখনোই খুব বড় হবে না। এদের সই হয় অত্যন্ত কাব্যিক, অক্ষরে ঢেউ খেলানো অংশ এবং গোলাকার ভাব দেখা যায়।
গতানুগতিক মনোভাব
একেবারে কপিবুক অটোগ্রাফ। সইয়ের আকার মাঝারি অথবা ছোট। সোজা সোজা রেখাংশের সাহায্যে সামান্য ডানদিকে হেলানো সামঞ্জস্যপূর্ণ সই। এ ধরণের মনোভাব যাদের, তাদের নামের মাঝখানের অক্ষরগুলো অন্যটির সঙ্গে যুক্ত থাকে।
আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব
এ ধরনের মানুষদের বাঁ দিকে হেলানো ছোট সই হয়। অক্ষরের মাঝখানের অংশগুলো খুবই সঙ্কুচিত থাকে।
অন্যকে দমিয়ে রাখার মনোভাব
এদের সই সর্বদা বড় হয়, বিশেষত অক্ষরের ওপরের ও মাঝখানের অংশ। মোটামুটি চাপ দিয়ে লেখা সইগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অক্ষরের রেখাংশ ওপরের দিকে উঠে যায়।
ব্যবসায়ী
সইয়ের নীচের দিক অনেক বড় হয়। অক্ষরগুলো পরস্পরের সাথে জোড়া লেগে থাকে এবং ডানদিকে হেলে থাকে। সুতোর মতো সরু রেখাংশগুলোতে কৌণিকভাব বেশি দেখা যায়।
বিচার ক্ষমতা
পরিষ্কার, স্বচ্ছ, মাঝারি আকারের সই। অক্ষরগুলো একে অন্যের সাথে যুক্ত। ডানদিকে সামান্য হেলানো ও ওপরের অংশের তুলনায় বড়।
স্থিরতা
এই প্রকৃতির মানুষদের সই হয় বাঁদিকে সামান্য হেলানো এবং একটানে করা। সইয়ের অক্ষরগুলোতে গোলাকার ভাব বেশি চোখে পড়ে।
উদারতা
বড় অক্ষরের ঢেউ খেলানো সই। সাধারণত এরা ছোট হাতের ‘i’ এর মাথায় ফোঁটা বা `t’ –এর মাথাটা কেটে দিতে ভুলে যান।
বহুমুখী প্রতিভা
এদের সইয়ের কিছু অক্ষর বিচ্ছিন্ন থাকে, আবার কিছু অক্ষর যুক্ত। অত্যন্ত ছন্দবদ্ধ সই। প্রতিটি অক্ষরই প্রায় নতুন নতুন ছাঁচে লেখা। অটোগ্রাফ এদের প্রতিভার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।
শান্ত স্বভাব
বাঁদিকে হেলানো, ছোট, টান টান সই। অটোগ্রাফের মাঝখানে অক্ষরগুলো পরস্পরের কোণাকুণি থাকে।
উচ্ছ্বলতা
ডানদিকে বাঁকানো বড় অক্ষরের সই। অক্ষরের মধ্যে প্রায় কোনো ফাঁকই থাকে না। অক্ষরের মাঝখানের অংশ গায়ে গায়ে লেগে থাকে।
দক্ষতা
একটানে করা সই। প্রতিটি অক্ষরের সাথে প্রতিটি অক্ষরের জোর কৌণিকভাব থাকে। ইংরেজিতে করা সইয়ে অত্যন্ত যত্নের সাথে এই প্রকৃতির মানুষ ছোট হাতের ‘i’ এর মাথায় ফোঁটা বা `t’ এর মাথাটা কেটে দেন।
আত্মবিশ্বাস
সইয়ের আকার বেশ বড় হয়। সইয়ের ধরণ সুবিন্যস্ত এবং ইংরেজীতে বিরাট করে এরা ‘I’ লেখেন।
অন্যমনস্কতা
ছেঁড়া সুতোর মতো ছাড়া ছাড়া সই। সইয়ের অক্ষরগুলোও এবড়োখেবড়ো ও অসম্পূর্ণ।
অমিতব্যয়ী
বড় বড় অক্ষরের বিরাট সই। সইয়ের আকারও যেমন বড় হয়, তেমনি অক্ষরের মাঝপথের ফাঁকগুলোও বিরাট।
দ্বিধাগ্রস্ত
সুতোর মতোই পাকানো সই। সইয়ের কোনো ছিরিছাঁদ থাকে না। অক্ষরগুলো যে কোনটা কী তার মাথামুন্ডু কিছু বোঝা যায় না।
হীনমন্যতা
হালকাভাবে লেখা বাঁদিকে হেলানো ছোটখাটো সই। অক্ষরের অধিকাংশ রেখা সবসময় নিচের দিকে নেমে যায়।
নম্রতা
এদের লেখাও যেমন ছোট হয়, সইও তেমনই ছোট হয়। অক্ষরগুলোর ওপরের এবং মাঝখানের অংশ বেশ ছোট হয়।
আশাবাদী
ওপরের দিকে টান করা সুন্দর দেখতে হয় এদের সই। অক্ষরগুলোর মধ্যে গোলাকার ভাব বেশি দেখা যায়। অত্যন্ত স্পষ্ট ও পরিষ্কার দেখতে হয় এসব মানুষের অটোগ্রাফ।
নৈরাশ্যবাদী
এদের সইয়ের অক্ষরগুলো কৌণিকভাবে নিচের দিকে নেমে থাকে। অক্ষরগুলো দেখতেও হয় ভাঙাচোরা।
নিয়মনিষ্ঠা
খুবই সুন্দর দেখতে হয় এ ধরনের মানুষের অটোগ্রাফ। অক্ষরগুলোর বিন্যাস দেখবার মতো। ‘হ্য’ –এর ‘য’ ফলা ঠিকমতো দেওয়া হলো কি না, মাত্রা ঠিকঠাক আছে কি না- এদিকেও থাকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি।
গোপনীয়তা
অক্ষরগুলো একসাথে যুক্ত থাকে। ইংরেজি অক্ষরে ‘O’ অথবা বাংলা অক্ষর ‘ব’- এসব অক্ষরের রেখাংশে কখনোই কোনো ফাঁক থাকে না। কখনো কখনো এরা নিজেদের সইয়ের ওপর আবার কলম বুলিয়ে সইকে উজ্জ্বল করে তোলেন।
বাক্যবাগীশ
বড় ঢেউ খেলানো সই। অক্ষরগুলো একেবারে গায়ে গায়ে লেগে থাকে।
রাগ
খুব চাপ দিয়ে ডান দিকে খেলিয়ে সই করেন। কৌণিকভাবে বেশি দেখা যায় নামের অক্ষরগুলোতে। অত্যন্ত রূঢ়ভাবে এরা ‘t’ এর মাথা কিংবা ‘ষ’ এর পেট কেটে দেন।
যার গতিবিধি বোঝা যায় না
এসব মানুষের সই কখনো ডান দিকে বাঁকানো হয়, আবার কখনো বাঁদিকে। এদের সই হয় বিচ্ছিন্ন।
গ্রাফোলজিস্টদের করা এসব বিচার বিশ্লেষণ সবসময় যে সঠিক হয় তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারপরও কোনো ব্যক্তির সইয়ের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও খুঁজে পাওয়া যায় সেই মানুষটির চারিত্রিক নানা বৈশিষ্ট্য, বেশ অবাক করার মতোই।
ফিচার ইমেজ- tarotgyan.com