লেখার শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন! ভাবছেন, “চালের পানি, তার আবার কী গুণ?” প্রতিদিন তো কত চাল ধোয়া পানি ফেলেই দিচ্ছেন। কিন্তু কোনোদিন ভেবে দেখেছেন কি, আমাদের প্রধান খাবার ভাত রান্না করার আগে চালটা ধুয়ে এবং ভাত রান্না করার সময় যে অতিরিক্ত পানি (যেটাকে আমরা ভাতের মাড় বলে থাকি) ফেলে দেই আমরা, সে পানিতে আমাদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং সৌন্দর্য বর্ধনের কত উপাদান লুকিয়ে থাকতে পারে?
এই লেখায় সেসব কিছু নিয়েই বিস্তারিত জানবো আমরা। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এসব তথ্য জানার পর আপনি চাল ধোয়া পানি এবং ভাতের মাড় ফেলার আগে একবার অবশ্যই ভাববেন।
কীভাবে চালের পানি প্রস্তুত করবেন?
চালের পানি ব্যাবহারের জন্য মূলত দুই ধাপ অবলম্বন করা হয়।
প্রথম ধাপ
এক কাপ পরিমাণ চাল নিয়ে আগে পানি দিয়ে পরিস্কার করে ধুয়ে নিন। এবার একটি পাত্রে ঐ এক কাপ চালের মধ্যে পানি দিন। পানির পরিমান এমন হবে, যাতে করে চালগুলো সম্পূর্ণ পানিতে ডুবে যায়। এবার দশ থেকে পনের মিনিট অপেক্ষা করুন এবং দেখবেন পানি অনেকটাই ঘোলা হয়ে আসবে, এই সময়ের পর আপনার চালের পানি প্রস্তুত ব্যবহারের জন্য।
দ্বিতীয় ধাপ
চাল পরিস্কার করে ধুয়ে নিয়ে হাড়িতে পর্যাপ্ত পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিন। চাল ফুটতে আরম্ভ করলে জ্বাল কমিয়ে দিয়ে চালের ভেতরের পানি কিছুটা গাঢ় হয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এরপর পানিটুকু নিংড়ে অন্য একটি পাত্রে ঢেলে নিন। পানিটুকু সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই আপনি এবার এই পানি ব্যবহার করতে পারবেন।
সবচেয়ে দারুণ ব্যাপারটি হলো, এই চালের পানি প্রস্তুত করতে আপনাকে আলাদা করে কোনো কষ্ট করতে হবে না। প্রতিদিন তো আমাদের বাসায় ভাত রান্না হয়, এই রান্নার সময়ই আপনি দু’ভাবেই পানি সংগ্রহ করতে পারবেন। আর এই পানি আপনি চার থেকে পাঁচ দিন ফ্রিজে রেখেও সংরক্ষণ করে ব্যবহার করতে পারবেন। এক্ষেত্রে ব্যবহারের আগে পানি ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে ভুলবেন না।
ত্বকের যত্নে চালের পানি
চালের পানিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেলস ও অ্যামিনো অ্যাসিড; যা ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য উপাদান। শুধু তা-ই নয়, চালের পানিতে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান ত্বকের সকল প্রকার ব্যাকটেরিয়াজনিত সমস্যা দূর করতে সক্ষম।
ফেশিয়াল ক্লিনজার
একটি কটন বলের সাহায্যে চালের পানি নিয়ে আপনার ত্বকে খুব হালকাভাবে কয়েক মিনিট ধরে ম্যাসাজ করতে থাকুন। এবার এই পানি আপনার ত্বকে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার পর মুখ ধুয়ে ফেলুন।
এভাবে প্রতিদিন ব্যবহার করার ফলে আপনি আপনার ত্বকের পার্থক্য নিজেই বুঝতে পারবেন। চালের পানি আপনার ত্বককে মসৃণ, উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় করে তুলবে।
ফেশিয়াল টোনার
চালের পানি ত্বকের জন্য দারুণ টোনারের কাজ করে। সামান্য কিছু তুলা নিয়ে চালের পানিতে ভিজিয়ে আপনার ত্বকে আলতো হাতে লাগিয়ে নিন। এই পানি আপনার ত্বকের পোরস মিনিমাইজ করবে এবং ত্বক টান টান রাখবে। চালের পানির এই প্রাকৃতিক টোনার ভিটামিন বি কমপ্লেক্সে ভরপুর, যা আপনার ত্বকের কোষ বৃদ্ধি করবে, ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে এবং ত্বক নরম-কোমল করার পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াবে।
সানবার্ন দূর করে
চালের পানির আরও একটি অনন্য ব্যবহার হচ্ছে সানবার্ন দূর করতে। এই পানির বিশেষ কুলিং উপাদান রোদে পোড়া ত্বক দ্রুত স্বাভাবিক করে তোলে। এটি রোদে পোড়া দাগ দূর করার সাথে সাথে রোদে পোড়ার দরুন ত্বকের পরবর্তী ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে চাল ধোয়া ঠাণ্ডা পানি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।
ব্রণ দূর করে
যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্রণের সমস্যায় ভুগছেন, তারা এই চালের পানি ব্যবহার করে দেখতে পারেন। এটি একদম প্রাকৃতিক উপাদান, তাই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় নেই। আপনি ফেসওয়াসের মতো করে চালের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে পারেন অথবা তুলার সাহায্যে ত্বকে ম্যাসাজ করতেও পারেন। নিয়মিত এটি ব্যবহার করার ফলে ব্রণের সমস্যা কমতে থাকবে। অনেকের ত্বকে লাল ধরনের ছোট ছোট দানার মতো ওঠে, চালের পানির মাধ্যমে এই লালভাবও দূর করা সম্ভব।
ত্বকের বলিরেখা দূর করে
আপনার ত্বকের বলিরেখা, বিশেষ করে কপালের ও চোখের চারপাশের ভাঁজ হয়ে যাওয়া বা কুঁচকে যাওয়া চামড়া টান টান করতে চালের পানির তুলনা নেই। তবে এক্ষেত্রে চালের জ্বাল দেওয়া পানি লাগবে, মানে ভাতের মাড়। ভাতের মাড় নিয়ে আলতো হাতে মুখের পুরো ত্বকে ম্যাসাজ করে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কিছুদিন নিয়মিত এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে নিজেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন।
একজিমা প্রতিরোধ করে
ভাতের মাড়ের আরও একটি জাদুকরী গুণ হচ্ছে এটি একজিমা প্রতিরোধক। ভাত রান্না করার সময় মাড়টুকু ফেলে না দিয়ে একটি পরিস্কার পাত্রে সংরক্ষণ করুন। মাড় সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হয়ে আসলে একটি নরম ও পরিস্কার কাপড়ের সাহায্যে আপনার একজিমা আক্রান্ত স্থানে এই মাড় সুন্দর করে লাগিয়ে নিন। একদম পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করুন। এই ভাতের মাড় যদি একটানা কয়েক দিন এভাবে লাগাতে থাকেন, আপনার একজিমা সমস্যা অনেকটাই কমতে থাকবে।
চুলের যত্নে চালের পানি
চালের পানি ব্যবহার করার ফলে এটি চুলকে আরও উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান করে। শুধু এটাই নয়, চালের পানিতে থাকা পুষ্টিমান চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পুষ্টি সরবরাহ করে চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
শক্ত ও মজবুত চুলের জন্য
চালের পানি দিয়ে চুল ধোয়ার ফলে আপনার চুল হবে আরও ঝলমলে, মজবুত ও মসৃণ। শ্যাম্পু করার পর চুল চাল ধোয়া পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই পানি মাথায় দেয়ার পর আঙুলের সাহায্যে হালকা করে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করুন। প্রয়োজনে আর সাথে পছন্দ অনুযায়ী সামান্য কয়েক ফোঁটা এসেন্সিয়াল অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। কয়েক মিনিট এভাবে ম্যাসাজ করার পর পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দু’বার এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভালো ফল পাবেন।
প্রাকৃতিক হেয়ার কন্ডিশনার
চালের পানি প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবেও চোখ বুজে ব্যবহার করতে পারবেন। চালের পানি চুলে দিয়ে দশ মিনিট অপেক্ষা করুন। আপনি চালের পানির সাথে কয়েক ফোঁটা ল্যাভেন্ডার অথবা রোজমেরি অয়েল মিশিয়ে নিতে পারেন। দশ মিনিট পর হালকা গরম পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। একবার ব্যবহার করার পরই দেখবেন আপনার চুলে কেমন নরম আর ঝলমলে অনুভব হবে।
চুলের ড্যামেজ প্রতিরোধ করে
চালের পানিতে ‘Inositol’ নামক এক প্রকার কার্বোহাইট্রেড রয়েছে, যা কেবল চুল ড্যামেজ হওয়া থেকেই রক্ষা করে না, বরং পরবর্তীতে চুলের ড্যামেজজনিত অন্য কোনো ক্ষতি যাতে না হয় সেটাও নিশ্চিত করে। এই ‘Inositol’ চুল ধুয়ে ফেলার পরেও মাথার ত্বকে উপস্থিত থাকার ফলে চুলের ড্যামেজ গার্ড হিসেবে কাজ করে।
চুলের গোড়া শক্ত করে চুল পড়া কমায়
চালের পানিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। এই অ্যামিনো অ্যাসিড চুলের গোড়া শক্ত করে অতিরিক্ত চুল পড়া বন্ধ করে চুল আরও ঘন করে তোলে ও চুলের উজ্জ্বলতা ধরে রাখে।
এই লেখায় ছিল ত্বক ও চুলের যত্নে চালের পানির ব্যবহার নিয়ে। তবে চালের পানির জাদুকরী প্রভাব কেবলমাত্র চুল আর ত্বকের যত্নে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতেও এই পানির প্রভাব কম না।
পরবর্তী লেখায় থাকবে চালের পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
ফিচার ইমেজ- youtube.com