কিছুদিন আগে ইউটিউবে একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় কানাডার একটি জিমে (ব্যায়ামাগারে) এক কিশোর বেশ ভারি বারবেল নিয়ে ডেডলিফট (একধরনের ব্যায়াম, যাতে পিঠ ও পায়ের পেশি ব্যবহার হয়) করছিল; এবং যথেষ্ট শব্দ করছিল (যদিও জিমে আশেপাশের আওয়াজ এবং উচ্চ শব্দে মিউজিকের আওয়াজ ছাপিয়ে তার গোঙ্গানি খুব বেশি শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে জিমের ভিতরেই খানিক দূর থেকে এক লোক এগিয়ে আসে এবং ছেলেটির সামনে দাঁড়ায়। ছেলেটি তখন তার ব্যায়ামের মাঝামাঝি ছিল (এমন অবস্থায় বাধা দেয়া বেশ বিপজ্জনক হতে পারে); লোকটি কোনো কথা না বলে তার বারবেলে একটি পা দিয়ে জোর করে তার বারবেল নামিয়ে দেয়। ছেলেটি যে ব্যথা পেয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। এরপরে লোকটি আরও সীমা লঙ্ঘন করে, ছেলেটিকে ঘাড় ধরে জিম থেকে বের করে দেয়। এই ঘটনার পুরোটাই ঘটেছিল শুধুমাত্র ছেলেটি বেশি শব্দ করছিল বলে।
জিম গ্রান্টিং
আপনার জিমে যাওয়ার অভ্যাস থাকলে এদের দেখার সৌভাগ্য আপনার নিশ্চয়ই হয়েছে। আপনি নিজে একমনে ব্যায়াম করছেন, হঠাৎ আপনার মনোযোগ ভেঙে গেল প্রচণ্ড চিৎকার শুনে; তাকিয়ে দেখলেন, না ভয় নেই, কেউ হতাহত হয়নি, আপনার পাশের বিশালদেহী ব্যায়ামবীর প্রচণ্ড ভারি কিছু তুলতে গিয়ে সমানে চিৎকার করছেন। আপনি মুখ ফিরিয়ে আপনার ব্যায়ামে মনোনিবেশ করলেন আবার।
কিন্তু সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয় না। উপরে যে ভিডিওটা দেখানো হলো, সেরকম আচরণও অনেকেই করে। এরকম আচরণ কখনোই কাম্য নয়, আপনি যতই বিরক্তি অনুভব করুন না কেন।
এই ধরনের গোঙানি বা চিৎকারকে বলা হয় জিম গ্রান্টিং। এটি সাধারণ চিৎকারের মতো শোনায় না, অনেকটা ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ, ভেতর থেকে আসে, কানের কাছে বারবার শুনতে বেশ বিরক্তিকর হতে পারে। এই জিম গ্রান্টিং নিয়ে জিমগামী মানুষজনের মধ্যে তুমুল মতবিরোধ রয়েছে, অনেকে এটা সহ্যই করতে পারেন না, নিজের ব্যায়ামে মনোযোগ দিতে পারেন না বলে। আরেকপক্ষ এত কঠিন অবস্থান নেন না (অনেক সময় নিজেরাও করেন)। দুই পক্ষেরই মত-অমতের বিভিন্ন কারণ রয়েছে, এ নিয়ে অনেক গবেষণাও হয়েছে, যা নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।
জিম গ্রান্টিং কেন হয়?
ব্যায়াম করার সময় ভালো ফর্ম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যায়ামটি শেষ করতে পারার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি (আপনি একটি ৮ বারের সেটে যদি ভালো ফর্মে থেকে ৩ বারও করতে পারেন, সেটাও ভালো, ভুল ফর্মে পুরো সেটই করতে পারার থেকে)। আর ফর্মের একটি বড় অংশ হলো আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস। ঠিকভাবে শ্বাস নেয়া ও ছাড়ার মাধ্যমে অনেক কিছুই আসে-যায়। যা-ই হোক, অনেকেই এই ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব দেন না, বিশেষ করে ছাড়ার সময়ে (ব্যায়ামে শ্বাস নেয়ার চেয়ে শ্বাস ত্যাগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ)। ফলে ভারি কিছু নামাতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তারা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ার বদলে মুখ দিয়ে ছাড়েন এবং তা গোঙ্গানির মতো আওয়াজের সাথে বের হয়।
এতে খুব বেশি ক্ষতি হয় না, যিনি করছেন তার। বরং অনেকের মতে, এতে নাকি ব্যায়াম আরও ভালো হয়, মোটিভেশন বাড়ে, বেশি ব্যায়াম করা যায়। তবে বেশি জোরে করলে যারা আশেপাশে থাকেন, তাদের কান ঝালাপালা হতে বাধ্য।
সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার, অনেকেই গ্রান্ট করেন ইচ্ছা করে, জিমে ডমিনেন্স বা প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। অনেকের মতে, জিমেরও একটি সামাজিক কাঠামো রয়েছে, এবং ভারি ওজন নিয়ে গ্রান্ট করলে অন্যরা আপনাকে সম্মান দেখাবে।
তবে অনেকেই এটি আটকাতে পারেন না, এবং আসলেই খুব ভারি ওজন হাতে বা কাঁধে নিয়ে গ্রান্টিং আটকানোটা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। খুব বেশি এবং ইচ্ছাকৃত গ্রান্টিং নিয়ে অনেক গবেষক ও ব্যায়ামবিদ, যেমন- মার্কাস বন্ডি কথা বলেছেন। তার মতে, গ্রান্টিং আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বল্পতা প্রদর্শন করে, একইসাথে জিমের আবহাওয়াও নষ্ট করে। আবার গ্রান্টিংয়ের পক্ষেও কথা বলছেন অনেকেই। পরের অনুচ্ছেদগুলোতে এই বিতর্ক নিয়ে বিভিন্ন গুণীজনের মতামত ও বিভিন্ন বিখ্যাত জিমের পলিসি সম্পর্কে কথা বলবো আমরা।
গ্রান্টিং বনাম নো-গ্রান্টিং: গবেষণায় কী বলে?
২০১৩ সালে ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রফেশনাল অ্যাথলেটদের মধ্যে যারা গ্রান্ট করেন, তারা ব্যায়ামে প্রায় ১০% বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন। কারণটি অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। মস্তিষ্কে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় গ্রান্টিংয়ের সময়, যা আমাদের কিছু সময়ের জন্য বাড়তি শক্তি প্রয়োগ করতে সহায়তা করে।
তবে এ কথা শুনেই জিমে ছুটে গিয়ে গ্রান্ট করা শুরু করে দেয়াও বোধহয় ঠিক হবে না। আগের লাইনে ‘প্রফেশনাল’ কথাটি খেয়াল করুন। এই অ্যাথলেটেরা যে পরিমাণ ব্যায়াম করে এবং করতে পারে, তা আমার-আপনার স্বপ্নেরও বাইরে। এই গবেষণায় শুধুমাত্র ভারোত্তলন ও অন্যান্য অলিম্পিক স্পোর্টের কথা বলা হয়েছে, যেখানে কয়েকশ ও কয়েক হাজার পাউন্ডের বারবেল নিয়ে কাজ করেন অ্যাথলেটরা। তারা ব্যায়াম করেনও তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত জিমে। সেখানে খুব বেশি গ্রান্টেও কেউ কিছু বলতে আসবে না। এই গবেষণার বরাত দিয়ে পাড়ার জিমে গিয়ে ৫০ পাউন্ডের ডাম্বেল নিয়ে তারস্বরে চেঁচানোটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
কোচ জেসন সিমোসের মতে, যখন আপনি ব্যায়াম করছেন এবং একইসাথে শব্দ করছেন, এর অর্থ আপনি আপনার ব্যায়াম সিরিয়াসলি নিচ্ছেন, এবং সবটুকু চেষ্টা দিচ্ছেন।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায় ২২ জন মার্শাল আর্টের ছাত্র-ছাত্রীর উপর করা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাদের মধ্যে যারা লাথি দেয়ার সময় গ্রান্ট করে, তারা প্রায় ৯% বেশি শক্তিশালী লাথি দিতে পেরেছে। তবে এক্ষেত্রেও শুধুমাত্র মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক বের করতে পারেননি গবেষকেরা। এবং বলাই বাহুল্য, ২২ জনের নমুনা দিয়ে করা গবেষণা বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশ্ববিখ্যাত টেনিস তারকা মারিয়া শারাপোভার খেলার সময় গ্রান্টিংয়ের কথা কোন টেনিস ভক্ত না জানে? এটি ইন্টারনেট মিম হিসেবেও বেশ বিখ্যাত। মারিয়া শারাপোভা নিজেও জানিয়েছেন, গ্রান্টিং তাকে মনোযোগ দিতে সহায়তা করে।
তবে সবারই একটা কথা, গ্রান্টিং করলেও সেটা রাখতে হবে সীমার মধ্যে। এবং ঠিকভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে শেখা তো খুব বেশি ঝামেলা নয়, তা-ই না? আপনার গ্রান্টিং যদি জিমের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত শোনা যায়, তাহলে আপনি অতিরিক্ত করছেন।
গ্রান্টিং নিয়ে বিভিন্ন জিমের পলিসি
প্রফেশনাল জিম আর কমার্শিয়াল জিমের মধ্যে অনেক তফাত, মূলত গ্রাহকদের কারণে। তাই তাদের পলিসিতেও যে ভিন্নতা থাকবে, তা বোঝাই যায়। বিখ্যাত গোল্ড’স জিম, এসএসপি বারবেল ক্লাব, হ্যামার ফিটনেস ইত্যাদি প্রফেশনাল অ্যাথলেটদের জন্য জিমে কোনো নো-গ্রান্টিং পলিসি নেই, কারণ স্বাভাবিকভাবেই এখানে বিভিন্ন ধরনের অ্যাথলেটরা আসেন। তাদের মধ্যে অনেকে গ্রান্ট করতেই পারেন। এবং এসব জিমে অনেক ক্ষেত্রে গ্রান্টিং উৎসাহিত করা হয় ট্রেইনারদের দ্বারা।
কিন্তু কমার্শিয়াল জিমগুলোর কথা আলাদা। এখানে শুধু অ্যাথলেটরাই যান না, অনেক মধ্যবয়স্ক মানুষও যান, যাদের উদ্দেশ্য কেবল ফিট থাকা, এবং তাদেরকে সিরিয়াস অ্যাথলেটদের বড় বড় লোহার চাঙ্গড় নিয়ে গোঙ্গানি বেশ মানসিক চাপ দিতে পারে। তাই প্ল্যানেট ফিটনেস, বাজফিট জিম ইত্যাদি অনেক কমার্শিয়াল জিমে কঠিন নো-গ্রান্টিং পলিসি চালু আছে। সেখানে হালকা আওয়াজ করলেও আপনার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যেতে পারে। অনেক অ্যাথলেট ও ইন্টারনেট ফিটনেস সেলিব্রিটিই কমার্শিয়াল জিমগুলোর এরকম পলিসির সমালোচনা করেছেন।
জিম গ্রান্টিং নিয়ে বিরক্ত হলে কী করবেন?
আবার ফিরে যাই শুরুর ভিডিওটায়। মনে করুন, ঐ লোকটির জায়গায় আপনি, জিমে ব্যায়াম করতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু পাশের মানুষটির গ্রান্টিংয়ের কারণে মেজাজ ক্রমেই চড়ে যাচ্ছে। তো আপনি কি উঠে গিয়ে তার বারবেল লাথি দিয়ে ফেলে দেবেন?
এই ভিডিওতে লোকটি যা করেছিল, তাতে কিশোরটির মৃত্যুঝুঁকিও ছিল। আচমকা পায়ের পেশিতে টান খেয়ে ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে পারতো, কনকাশন হতে পারতো, শিরদাঁড়া ভেঙে যেতে পারতো, দু’হাত চিরতরে অকেজো হয়ে যেতে পারতো। যে ভারি ওজন দিয়ে ব্যায়াম করে, সে-ই বোঝে যে ব্যাপারটি কতটা ভয়ানক হতে পারে। তো আপনিও কি একই আচরণ করবেন?
নিশ্চয়ই না। আপনি বিরক্তি অনুভব করলে তাকে অনুরোধ করতে পারেন কম আওয়াজ করার জন্য। কিংবা জিমের মালিকের কাছে নালিশ জানাতে পারেন। এমন কোনো পদক্ষেপই নেয়া উচিত না যাতে অন্য কারো ক্ষতি হয়, সে যে-ই হোক না কেন।
আর সবচেয়ে ভালো কাজ হবে ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া, যদি আপনি নিজে ব্যায়াম নিয়ে সিরিয়াস হন। সব জিমেই এই ঘটনাটি আছেই অল্পবিস্তর, এবং একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে খুব একটা খারাপও নয় ব্যাপারটা, বরং অনেক সময় অন্যের গ্রান্টিং আপনাকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে।