সকাল ৭টা বেজে ৩০ মিনিট। এলার্মের শব্দ নেই। ঘুম ভেঙ্গেই বুঝতে পারলেন আজ আপনার উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আদরের দুটি সন্তানকে নাস্তা করিয়ে স্কুলে পাঠানো, স্বামীর এবং নিজের জন্য লাঞ্চ বক্স তৈরি করা, তাদের জন্য কাপড়চোপড় গুছিয়ে দেয়া- কোনো কিছুর সময়ই এখন হাতে নেই। এত কিছু করে নিজেও ঠিক সময়মত অফিসে পৌঁছাতে পারবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
একে একে ভেসে উঠলো অনেকগুলো মুখ। সন্তান দুটি স্কুলে দেরি করে ঢুকে বকা শুনলো। স্বামীর বস তার দিকে আজ আড় চোখে চাহনি দিলেন। আপনার ম্যাম আপনাকে চশমার উপর থেকে একনজর দেখে ঘড়ির দিকে একনজর তাকালেন। তারপর বললেন, “কফি শেষে আমার রুমে এসো তো একবার”। সব দৃশ্য কল্পনা করে ভয়ে আতকে উঠলেন আপনি। মনে মনে নিজেকে কথা শোনালেন গত রাতে দেরিতে মুভি শেষ করার জন্য। তারপর ভীষণ তড়িঘড়ি করেও আপনি কিছুতেই সাড়ে ১০টার আগে অফিসে পৌঁছাতে পারলেন না।
কর্মজীবি মায়েদের ক্ষেত্রে এমন দৃশ্য নতুন কিছু নয়। সারাদিন অফিস শেষ করে বাসায় ফিরে সবার জন্য রাতের খাবারের আয়োজন করে একটু বিনোদনের জন্য একটা মুভি কিংবা মজার কোনো গল্পের বই পড়া যেতেই পারে। কিন্তু এর পরিণামস্বরূপ পরদিন দেরিতে ঘুম ভাঙ্গা এবং উপরের বাকি চিত্র। তাই বলে কি নিজের ওই ইচ্ছাটুকু বিসর্জন দিয়ে দিবেন নাকি অফিসে মাঝেমাঝেই এমন দেরিতে ঢুকে চাকরিটাকে সংকটে ফেলবেন? এমন দ্বিধায় যেন না পড়তে হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
যেদিন রাতে আপনার বই পড়তে বা মুভি দেখতে ইচ্ছা করবে অথবা ঘরের কোনো কাজেই হয়ত বেশ রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকছেন আপনি, সেদিন একটু সময় নিন। কাগজ কলমে টুকে ফেলুন পরদিন সকালের কাজগুলো। তালিকা দেখে হয়ত ঘাবড়ে গেলেন। প্রতিদিন এত কাজ করতে করতে আপনি হয়ত লক্ষ্যই করেননি খুব কম সময়ে রোজ সকালে আপনাকে কত কিছু করতে হয়। আধা ঘণ্টা সময় নিয়ে কাজগুলোকে সাজিয়ে ফেলুন এবং বেশ কিছু কাজ রাতেই সেরে ফেলুন কৌশলে।
- রোজ সকালে সবার কাপড় ইস্ত্রি করতে হয়? আগেরদিন রাতেই বাচ্চাদের এবং আপনাদের কাপড় তোষকের নীচে মাপমত ভাঁজ করে রেখে দিন। পরদিন সকালে সেটা ইস্ত্রি করা কাপড়ের মতই সুন্দর দেখাবে। তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন কাপড়ের ভাঁজ যেন ঠিক থাকে।
- রাতের বেলায় গুছিয়ে ফেলতে পারেন বাচ্চাদের এবং আপনার বহন করা ব্যাগ। এতে করে ঠাণ্ডা মাথায় সময় নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রাখা যায়।
- বন্ধের দিনে বেশি করে সবজি কেটে বায়ুরুদ্ধ বাক্সে করে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। এতে করে অনেকদিন সবজি ভালো থাকবে এবং আপনাকেও রোজ তরকারি কাটার ঝামেলায় যেতে হবে না।
- মুরগির মাংস কিনে বুকের অংশ অর্থাৎ হাড়ছাড়া মাংস কেটে সিদ্ধ করে বাক্সে করে ডিপ ফ্রিজে রাখুন। হাড়ের অংশ রান্না করার মত করে কেটে রাখতে পারেন অথবা স্যুপ বানিয়ে সংরক্ষণ করতে পারেন।
- বাচ্চাদের স্কুলের রুটিন টেবিলের উপর বা টেবিল সংলগ্ন দেয়ালে সেঁটে দিন। তাহলে বই-খাতা গুছিয়ে দেবার সময় আপনাকে তেমন বেগ পেতে হবে না।
- যেদিন হাতে একটু বেশি সময় থাকবে সেদিন বেশি করে রুটি বানিয়ে রাখুন। আটা মেখে নেয়ার সময় হালকা তেল দিয়ে মাখুন। এতে আটা নরম হবে এবং সংরক্ষণে সুবিধা হবে। রুটি বানিয়ে হালকা করে সেঁকে নিন। টেবিলে বড় করে পত্রিকা বিছিয়ে তাতে সেঁকে নেয়া রুটিগুলো বিছিয়ে শুকিয়ে নিন। এরপর জিপলক ব্যাগ বা বায়ুরুদ্ধ বাক্সে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন। এভাবে বানানো রুটি ৭ দিন পর্যন্ত ফ্রিজে রাখা যায়।
- বাজারে এখন খোলা মটরশুঁটি পাওয়া যায়। মটরশুঁটি ধুয়ে লবণ পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখুন। তারপর আবার ধুয়ে সেদ্ধ করেন বাক্সে সংরক্ষণ করুন।
- স্বামীর কাপড় তুলে রাখার সময় হ্যাঙ্গার ব্যবহার করুন। একটি হ্যাঙ্গারে প্রথমে এক ভাঁজ করে প্যান্ট এবং টাই রেখে শার্ট ঝুলিয়ে দিন। তাহলে সকালে একটার পর একটা কাপড় খুঁজে খুঁজে সময় নষ্ট করতে হবে না।
- আপনার পরদিন পরে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় এবং প্রসাধনী একসাথে রাখুন।
এ তো গেল কিছু পরামর্শ যা আপনাকে পরদিন সকালের কাজ কমাতে সাহায্য করবে। চলুন এবার দেখে নিই কিছু টিপস যা আপনাকে খুব কম সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে সাহায্য করবে।
- রুটি ভাজতে ভাজতে সবজি তৈরি করা বা ডিম পোঁচ করা খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে আগে সবজির সাথে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ধনিয়াপাতা কুচি, তেল, লবণ, হলুদ মাখিয়ে নিন। তারপর একেবারে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে চুলায় মৃদু আঁচে বসিয়ে দিন। ভাপে ভাপেই সবজি হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ঢাকনা উঠিয়ে নেড়ে দিন। ডিম সহজে পোঁচ করার উপায় নীচে রেসিপির সাথে যুক্ত করা হবে।
- সকালে মাছ রান্না করা পরিহার করুন। মাছ রান্না করতে তুলনামূলকভাবে সময় লাগে বেশি। এক্ষেত্রে আগেরদিন মাছ রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন এবং পরদিন গরম করে নিয়ে যেতে পারেন।
- মুরগির মাংস সেদ্ধ করে রেখেছেন তো? এখন শুধু বের করে বরফ ছাড়িয়ে নিন এবং ব্যবহার করুন নুডলস বা অন্যান্য যেকোনো রান্নায়। মাংস সেদ্ধ হতে যে সময়টুকু লাগতো সেটা বেঁচে যাবে।
- নাস্তা খেতে বসেই চায়ের পানিতে চিনি, দুধ এবং চা পাতা বা কফি একসাথে বসিয়ে দিন। সব একসাথে ফুটে লিকার করে একেবারে ঠিক সময় আপনার চা তৈরি হয়ে যাবে।
- খাওয়া শেষে গরম পানিতে প্লেট-বাটি ধুয়ে ফেলুন। সময় কম লাগবে।
- জমে থাকা পাতিল বা কড়াইয়ের ময়লা এবং পোড়া দাগ সহজে উঠতে চায় না। এক্ষেত্রে ডিসওয়াশিং লিকুইড সাবান অথবা বার এর এক টুকরো কেটে পাতিলে বা কড়াইতে ছেড়ে দিন। এতে পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিন। পানি এবং সাবান একসাথে ফুটে ময়লা বা পোড়া দাগ তুলে ফেলবে নিমিষেই।
কম সময়ে তৈরি করা মজার কিছু খাবারের রেসিপি
-
প্যানকেক
একটি ৫০০ মি.লি. বোতলে তিনটি ডিম, আধা গ্লাস ঘন দুধ, তেল এবং চিনি দিয়ে ঝাঁকিয়ে নিন। চুলায় কড়াই গরম হলে শুধু ঢালুন এবং প্যানকেক তৈরি করে ফেলুন। রান্নাঘর কম নোংরা হবে, বারবার চামচে তোলার ঝামেলা নেই, সময়ও বাঁচবে।
-
ডিম পোঁচ
একটি প্লেট ওভেনে দিয়ে ৩০ সেকেন্ড ধরে গরম করুন। এরপর তা বের করে তাতে মাখন লাগিয়ে উপরে ডিম ছেড়ে দিয়ে লবণ ছড়িয়ে দিন। প্লেট আবার ওভেনে দিন এবং ১ মিনিটে হয়ে যাবে ডিম পোঁচ। কোনোরকম বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই। যাদের ওভেন নেই তারা চুলায় তাওয়া বসিয়ে একই ভাবে মাখন বা তেল দিয়ে ডিম লবণ একেবারে ছেড়ে ঢেকে দিতে পারেন। এভাবে কম সময়ে ডিম পোঁচ করা সম্ভব।
-
টফু
একটা পেঁয়াজ, একটা কাঁচামরিচ, একটু টমেটো এবং ধনিয়াপাতা কুচি একসাথে তেলে হালকা করে ভেজে নিন। তাতে দুটি ডিম ছেড়ে দিয়ে নেড়ে নিন এবং সেদ্ধ করা মুরগির মাংস হাতে চেপে আরও ছোট করে ছেড়ে দিন। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে নামিয়ে নিন। ৭/১০ মিনিটে তৈরি হয়ে যাবে মজাদার টফু। রুটি বা পরটা দিয়ে খাওয়ার জন্য খুব কম সময়ে পুষ্টি গুণাগুণ সম্পন্ন খুবই মজার একটি খাবার।
-
নুডলস
পাতিলে বা কড়াইতে নুডলস কেক নিন। এবার নুডলসের পরিমাণ অনুযায়ী একটু পানি দিয়ে তাতে নুডলসের মশলা এবং হালকা লবণ ছড়িয়ে ঢেকে সেদ্ধ হতে দিন। পানি এমন পরিমাণে দিন যেন সেটা শুকিয়ে নুডলস সম্পূর্ণ সেদ্ধ করে ফেলে। পাশাপাশি আরেক চুলায় পেঁয়াজ, মরিচ, ডিম, মাংস নেড়ে নিন। নুডলস সেদ্ধ হয়ে গেলে ওই চুলায় দিয়ে দিন। সব একসাথে নেড়ে ১০ থেকে ১২ মিনিটে কম ঝামেলায় নুডলস তৈরি করে ফেলুন।
যেকোনো সংসারে একজন মায়ের দায়িত্ব অপরিসীম। সংসার, ছেলে-মেয়ে, স্বামী, অফিস সবকিছু সামলে তিনি প্রায়ই হাঁপিয়ে ওঠেন। তাই কখনও কখনও নিজের জন্য একটু সময় বের করে নিতেই হয়। একদিন সময় বের করতে গিয়ে যেন আরেকদিন কাজের ব্যাঘাত না ঘটে অথবা কাজের চাপ না বেড়ে যায় সেজন্য উপরে দেয়া পরামর্শ এবং রেসিপিগুলো কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন। কর্মজীবি মায়েদের জীবন হয়ে উঠুক সহজ, সুন্দর এবং আনন্দময়!
ফিচার ইমেজ সোর্স: playbuzz