কোনো কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়ার জন্য ভাইভা বোর্ডে হয়তো আপনাকে একটি কাগজ ধরিয়ে বলা হবে, “এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন।” আপনার কাছে প্রশ্নগুলো খুবই স্বাভাবিক মনে হবে। প্রতিদিন কাজের বেলায় আপনি কীভাবে চিন্তা করে থাকেন, তার উপর ভিত্তি করেই প্রশ্নগুলো করা হয়। প্রথম দৃষ্টিতে হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন না আপনি কী এমন পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু আসলে, আপনি আপনার ব্যক্তিত্বের একটি পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছেন! এটি হলো মায়ার্স-ব্রিগস পরীক্ষা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পরিচিত হয়ে ওঠা এই ব্যক্তিত্ব বের করার পরীক্ষা আজ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
ভাইভা বোর্ডে বসে এই পরীক্ষা না দিলেও, ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা বিভিন্ন সাইটে ঢুকে এরকম পরীক্ষা প্রায় সবাই দিয়েছি। এগুলোর সবই এই মায়ার্স-ব্রিগস পরীক্ষার ক্ষুদ্র সংস্করণ। কখনও কি চিন্তা করেছেন এই ব্যক্তিত্ব পরীক্ষার ফলাফল কীভাবে হিসাব করা হয়? কিংবা এই পরীক্ষার পরিচিতি হলোই বা কীভাবে? আজ আমরা এই পরীক্ষার ফলাফল কীভাবে বের হয়, সেটা নিয়ে নয়, বরং এই পরীক্ষার সূচনা কীভাবে হলো, সেটা নিয়েই আলোচনা করবো।
পাঠকের জানার সুবিধার্থে বলে রাখা দরকার যে ইসাবেল ব্রিগস মায়ার্স হলেন ক্যাথরিন কুক ব্রিগসের মেয়ে। অর্থাৎ মা ও মেয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পরীক্ষা পরিচিতি লাভ করে। এবার ফিরে যাওয়া যাক ১৯১৭ সালে যখন ব্রিগস তার মেয়ে মায়ার্সের হবু বরের সাথে পরিচিত হন। মেয়ের হবু বরের আচরণে তিনি এমন কিছু লক্ষ করলেন, যা তাকে মানুষের মানসিকতা বা ব্যক্তিত্ব নিয়ে জানার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলে। তখন ব্রিগস বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী এবং মনস্তত্ত্ব বিষয়ক বই পড়তে থাকেন। তখন তিনি মানুষের মানসিকতার চারটি প্রকারভেদ বের করেন। চিন্তাশীল, স্বতঃস্ফূর্ত, নির্বাহী, এবং সামাজিক। এই ৪টি প্রকার ছিলো তার গবেষণার প্রাথমিক রূপ।
১৯২৩ সালে কার্ল জাং এর সাইকোলোজিক্যাল টাইপস বইটির ইংরেজি অনুবাদ বের হয়, যা ১৯২১ সালে প্রথম জার্মান ভাষায় প্রকাশ হয়। এই বই পড়ে ব্রিগস মনোবিজ্ঞানের ব্যাপারে আরও গভীর চিন্তা করা শুরু করেন। বইটির ব্যাপারে তিনি এতই উৎসাহী ছিলেন যে, এই বইয়ের উপরই ১৯২৬ এবং ১৯২৮ সালে আমেরিকান পত্রিকা নিউ রিপাবলিক এ দুটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। এর মাঝেই ব্রিগসের সাথে তার মেয়ে মায়ার্স যুক্ত হন। আশ্চর্যজনকভাবে মনোবিজ্ঞান নিয়ে মা-মেয়ের এত আগ্রহ থাকার সত্ত্বেও, তাদের দুজনের কারোরই মনোবিজ্ঞানের উপর আগে থেকে না ছিলো কোনো পড়াশোনা, না ছিলো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী। শুধুমাত্র আগ্রহের বশেই তারা এই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
কার্ল জং এর বই পড়ে মায়ার্স এবং ব্রিগস মনোবিজ্ঞানের কেবল তাত্ত্বিক বিষয়াবলীর ব্যাপারে ধারণা নিতে পারছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞানের জন্য তো আর তারা এত কষ্ট করছেন না। তাদের মনোবিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকের ব্যাপারেও জানা চাই। তখন ইসাবেল মায়ার্স যোগাযোগ করলেন আমেরিকার পেনসিলভানিয়া প্রদেশের একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড নর্থউইপ হ্যায়ের সাথে। হ্যায় তখন প্যানসিলভেনিয়ার সবচেয়ে বড় শহর ফিলাডেলফিয়ার একটি ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন এবং একইসাথে তিনি ব্যবসায়িক পরামর্শদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। এখান থেকে মায়ার্স প্রাথমিক পরীক্ষা নির্মাণ, স্কোরিং, স্কোরের বৈধতা প্রদান এবং পরিসংখ্যান পদ্ধতি সম্পর্কে শিখে নিলেন। তখন থেকেই মায়ার্স এবং ব্রিগস মানুষের মানসিকতা ব্যবহারিক দিক থেকে কীভাবে কাজ করে, সে ব্যপারে ধারণা নিতে থাকেন।
এর মাঝেই বেজে গেলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ১৯৪১ সালে পার্ল হার্বারে বোমা হামলার পরপরই আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেয়। তখন আমেরিকার মোটামোটি সকল স্তরের লোক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। মহিলাদের তো আর যুদ্ধের মাঝে ঘরে বসিয়ে রাখা যাবে না। তাদেরও যুদ্ধের সময় কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা দেখা গেলো। দীর্ঘসময় ঘরে বসে থাকার অভ্যাস হয়ে যাওয়ার ফলে অধিকাংশ মহিলাই যুদ্ধের মাঝে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তাদের কোন কাজে লাগানো যায়, এটা ভাবতে গিয়েই কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছিলো। তখনই কাজে লাগলো মায়ার্স-ব্রিগসের গবেষণা।
১৯৪১-১৯৪৩ এই দুই বছরে মায়ার্স-ব্রিগস মিলে একটি মানসিক পরীক্ষা পদ্ধতি তৈরি করেন। এই পরীক্ষার স্কোর থেকে তারা জানতে পারেন যে কোন মহিলা মানসিকভাবে কীরকম শক্ত, তাদের ব্যক্তিত্ব কীরকম এবং যুদ্ধের মাঝে তাকে কোন কাজে পাঠানো যায়। সেই পরীক্ষার ফলাফল কীভাবে কাজ করতো, সে ব্যাপারে একটু পরেই আলোচনা করছি। মূলত যুদ্ধের ময়দানে মহিলাদের কার্যকরী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই এই পরীক্ষা পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিলো। আজ সেই পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
১৯৪৪ সালে মায়ার্স এবং ব্রিগস তাদের গবেষণার উপর প্রথম বই বের করে ব্রিগস-মায়ার্স টাইপ ইন্ডিকেটর হ্যান্ডবুক নামে। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে এর নামকরণ করা হয় মায়ার্স-ব্রিগস টাইপ ইন্ডিকেটর । এখানে যে মানসিক পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, তাকেই সংক্ষেপে বলা হয় এমবিটিআই। ব্রিগস ১৯৬৮ সালে এবং মায়ার্স ১৯৮০ সালে মারা যাবার পর ১৯৭৫ সাল থেকে এই এমবিটিআই বিভিন্ন ব্যাক্তিত্বের সহায়তার হাত ধরে বর্তমানে এর প্রকাশনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে কনসাল্টিং সাইকোলোজিস্টস প্রেস ।
তো এখন জানা যাক কী আছে এই এমবিটিআইয়ের মধ্যে এবং কীভাবে এটি আপনার মানসিক সক্ষমতাকে প্রকাশ করে ফেলতে পারে। এই পরীক্ষায় আপনাকে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করা হবে, যেগুলো মায়ার্স এবং ব্রিগস তৈরি করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আপনার পদক্ষেপ কী হতে পারে, তা আপনাকে জানাতে হবে। যেমন– আপনি অপরিচিত মানুষের সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে কেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? আপনি কি সহজে নতুন কারো সাথে মিশে যেতে পারেন? আপনি কি নিজের কাজ নিয়ে খুব বেশি দ্বিধায় ভোগেন? এধরনের কিছু প্রশ্ন আপনাকে করা হবে এবং সে অনুযায়ী আপনাকে উত্তর দিতে হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর বিবেচনা করে আপনার ব্যক্তিত্ব বের করে আনা হবে।
কিন্তু এসব উত্তর থেকে কীভাবে আপনার ব্যক্তিত্ব বের হবে? আপনার প্রতিটি উত্তরের জন্য আলাদা স্কোরিং আছে। সেই স্কোরগুলো হিসাব করে আপনার ব্যক্তিত্ব বের করা হয়।
তাহলে আপনার কী কী রকমের ব্যক্তিত্ব হতে পারে? আপনার ব্যক্তিত্বের ধরনকে কিছু সংকেত দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এগুলো নিচে দেখানো হয়েছে। এই সংকেতগুলোর কাজ কী, সেটা পরে বলছি।
আপনার ব্যক্তিত্ব হতে পারে এক্সট্রোভার্ট (E) অথবা ইন্ট্রোভার্ট (I), সেন্সিং (S) অথবা ইন্টুইশন (N), থিঙ্কিং (T) অথবা ফিলিং (F), জাজমেন্ট (J) অথবা পারসেপশন (P)।
এক্সট্রোভার্ট (E) অথবা ইন্ট্রোভার্ট (I)
আপনি যদি বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, আপনি যদি মনে করেন আপনার চারপাশে সবসময় কেউ না কেউ থাকলে আপনার ভালো লাগে তাহলে আপনি একজন এক্সট্রোভার্ট অর্থাৎ বহির্মুখ ব্যক্তি। আর যদি আপনি একা থাকতেই পছন্দ বেশি করেন, লোকজনের সাথে কম মিশতেই বেশি পছন্দ করেন, তবে আপনি একজন ইন্ট্রোভার্ট অর্থাৎ অন্তর্মুখী ব্যক্তি।
সেন্সিং (S) অথবা ইন্টুইশন (N)
আপনি একটি সমস্যা সমাধান করার জন্য কীভাবে আগাবেন? সমস্যা সংক্রান্ত যেসকল তথ্য হাতে আছে কেবল সেগুলোর উপরই ভরসা করে থাকবেন নাকি সীমিত তথ্যের বাইরে গিয়েও চিন্তা করবেন? যদি আপনি প্রথম ধারণার সাথে একমত হয়ে থাকেন তাহলে আপনার ব্যক্তিত্ব হলো সেন্সিং। আর আপনি যদি দ্বিতীয় ধারণার সাথে একমত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার ব্যক্তিত্ব হলো ইন্টুইশন।
থিঙ্কিং (T) অথবা ফিলিং (F)
কোনো সমস্যা সমাধানে আপনি কোনটিকে আগে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন? তথ্য কী বলছে সেটি, নাকি আপনার মন কী বলছে, সেটি? নিজেকে একজন বিচারকের আসনে কল্পনা করুন। আপনি এমন একজনের বিচার করছেন, যাকে তথ্যের ভিত্তিতে দোষী প্রমাণ করা হয়েছে। কিন্তু আপনি জানেন যে সে দোষী নয়। অথবা দোষী হলেও, সে আপনার পরিবারের খুব কাছের একজন ব্যক্তি। এক্ষেত্রে আপনি কীভাবে আগাবেন? যদি আপনি তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনার ব্যক্তিত্ব থিঙ্কিং বা চিন্তাশীল। আর যদি মনকে গুরুত্ব দেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি অনুভূতিকে এড়িয়ে চলতে পারেন না।
জাজমেন্ট (J) অথবা পারসেপশন (P)
খুব সহজ একটি উদাহরণ চিন্তা করুন। কোনো কাজের ডেডলাইনকে আপনি কীভাবে বিবেচনা করেন? আপনি কী সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলেন এবং ডেডলাইনের আগেই সুন্দরমতো কাজ শেষ করে ফেলেন? তাহলে আপনি জাজমেন্টাল। আর যদি আপনি কোনো রকমে ডেডলাইনের আগের রাতে কাজ শেষ করে জমা দেওয়ার চিন্তা করেন, তাহলে আপনার ব্যক্তিত্ব হলো পারসেপশন।
এগুলো তো হলো আপনার ব্যক্তিত্বের ধরন। এখানে যে চারটি ভাগের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আপনি প্রতিটির যেকোনো একটি ব্যক্তিত্বের দিকে এগোবেন। অর্থাৎ মোট চার জোড়া ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে যেকোনো চারটি প্রকার নিয়ে আপনার পূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাবে। আপনার পূর্ণ ব্যক্তিত্ব হবে নিচের ছবির ১৬ প্রকারের যেকোনো একটি।
এখন আপনি কীভাবে বুঝবেন আপনার ব্যক্তিত্ব কোন প্রকারের মধ্যে পড়ে? এমবিটিআই পরীক্ষার জন্য আপনাকে অর্থ খরচ করতে হবে, যা অধিকাংশ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে করে থাকে। তবে আপনি গুগল করলেই কিছু ওয়েব সাইট পাবেন যেখান থেকে বিনামূল্যে এই ধরনের পরীক্ষা দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন।
Feature image: blog.prototypr.io