
আমাদের জীবনে খুব পরিচিত একটি শব্দ ‘খুশকি’। দৈনন্দিন চলার পথে এই সমস্যায় আমাদের অনেককেই ভুগতে হয়। খুশকি মূলত একধরনের ছত্রাক, যা আমাদের মাথার লোমকূপে বিভিন্ন ধরনের ময়লা ও ধুলোবালি জমে হয়ে থাকে। খুশকি সাধারণত আমাদের মাথার উপরের অংশে দেখা দেয়। তবে চুল ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন লোমকূপেও খুশকি দেখা দিতে পারে। ‘সেবেরিয়েক ডারমেটাইটিস‘ বা ‘সেবরিয়া’ নামক চর্মজনিত ব্যাধি থেকেই মূলত খুশকির সৃষ্টি।
এই রোগে আক্রান্ত হলে মাথার তালুর ত্বক অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে যায় এবং এই শুষ্কতা ত্বকের উপরিঅংশে খুশকি তৈরিতে সাহায্য করে থাকে। খুশকি হলে মাথায় চুলকানো, জ্বালা করা, অস্বস্তি হওয়া, চুল পড়াসহ অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়াও খুশকি হলে শরীরে বা কাপড়-চোপড়ে সাদা দানার মতো পড়ে, যার কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মানুষের জীবনপ্রবাহে যেকোনো সময় খুশকি দেখা দিতে পারে, তবে বয়ঃসন্ধিকালীন এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যেই খুশকির আধিক্য দেখা যায়।

মাথায় খুশকির সংক্রমণ; Source: youtube.com
খুশকি হওয়ার কারণ
আবহাওয়ার সাথে সাথে খুশকির আধিক্যের তারতম্য ঘটে থাকে। বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে খুশকির সংক্রমণ অনেক বেশি চোখে পড়ে। আবার মাথার ত্বকের ভিন্নতার উপরও খুশকি অনেকাংশে নির্ভর করে। অতিরিক্ত খুশকি হলে মাথার ত্বকে অনেক ধরনের জটিল সমস্যা হতে পারে। তাই চুলে খুশকি দেখা দিলে দ্রুত তা দূর করার চেষ্টা করা উচিত। আর খুশকি দূর করার আগে আমাদের খুশকির আসল কারণগুলো জেনে নিতে হবে।
শুষ্ক ত্বক
মাথার শুষ্ক ত্বক খুশকি হওয়ার অন্যতম চারণভূমি। শীতকালে আবহাওয়া অনেকটাই আর্দ্র থাকে বলে ঐ সময় মাথার ত্বক অনেকটাই শুষ্ক হয়ে পড়ে। তাই শীতকালে খুশকির প্রাধান্য বেশি থাকে। তবে বর্তমানে তাপানুকূল ব্যবস্থায় গরম ও ঠান্ডা আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে গ্রীষ্মকালেও মাথার ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়।

অতিরিক্ত শুষ্ক ত্বক হতে পারে খুশকির আবাসভূমি; Source: sajsojja.com
মাথায় ময়লা জমলে
মাথায় অতিরিক্ত ময়লা জমা মাথার ত্বকের জন্য মোটেও ভালো কিছু নয়। অতিরিক্ত ময়লা জমার ফলে খুব সহজেই খুশকি আক্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ঘরে এবং বাইরে প্রচুর ধুলোবালির সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে নিজের অজান্তেই আমাদের মাথায় অনেক ময়লা জমে থাকে। ফলে মাথায় ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে।

অতিরিক্ত ময়লা মাথায় হতে পারে খুশকি; Source: tissavel.fr
তৈলাক্ত তালুর ত্বক
শারীরিক গঠনের ভিন্নতার কারণে আমাদের মাথার ত্বক বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। অনেকের মাথার ত্বকে তৈলাক্ত ভাবের আধিক্য থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এছাড়াও হরমোনজনিত কারণে অনেকের মধ্যে ঘামের আধিক্য দেখা যায়। এই ধরনের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও মাথার ত্বকে অনেক বেশি খুশকি দেখা যেতে পারে।

তৈলাক্ত ত্বকের মাথায় দেখা যেতে পারে খুশকি; Source: youtube.com
ম্যালাসেজিয়া ছত্রাক
আমাদের সকলের ত্বকেই কম-বেশি এই ছত্রাকের উপস্থিতি রয়েছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ এই ছত্রাকের উপস্থিতি কোনো প্রকার সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে যখন ত্বকে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে, তখন ত্বক থেকে তেল শুষে নিয়ে ত্বককে অনেক বেশি শুষ্ক করে তোলে। ফলে ত্বকে ধীরে ধীরে মৃত কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর ফলে মৃত কোষগুলো লোমকূপ থেকে খুশকির সৃষ্টি করে।
বংশগত কারণ
অনেক সময় বংশগত কারণকেও খুশকির হওয়ার জন্যে অনেকাংশে দায়ী করা হয়ে থাকে। এছাড়াও হরমোনজনিত কারণেও খুশকি দেখা যেতে পারে। এই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রেও অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ
বিশেষজ্ঞগণ ব্যক্তিজীবনে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, কাজের চাপ, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম, ঘুমের ঘাটতি, সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের অভাব ইত্যাদিকে খুশকির অন্যতম কারণ হিসেবেও উল্লেখ করে থাকেন।

অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে চুলের ক্ষতি হতে পারে; Source: somoyerkonthosor.com
ত্বকের উপযোগী পণ্যের ব্যবহার না করলে
আমাদের দেশে অনেকেরই প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহারে বিশেষ অজ্ঞতা বা উদাসিনতা লক্ষ করা যায়। নিম্নমানের এবং ত্বকের অনুপযোগী প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে মাথার ত্বক বা চুলের বিশেষ ক্ষতি হতে পারে। ত্বকের উপযোগী সামগ্রী খুঁজে পেতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ত্বকের যত্নে ভালো ব্র্যান্ড বা মানসম্মত পণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যকীয়।
খুশকি থেকে মুক্তি পেতে করণীয়
খুশকির সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। অনেকেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার করে থাকেন, যার ফল অনেক সময় আরো খারাপ হয়ে উঠতে পারে। তাই খুশকি সমস্যার সমাধান প্রথমে ঘর থেকে শুরু করতে হবে। আমাদের হাতের কাছে যা আছে তার সাহায্যে খুশকি সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে তার জন্য কিছু নিয়মকানুন বা জীবনযাপনে কিছুটা পরিবর্তন আনা বাঞ্ছনীয়।
নিমপাতা ও মেথির গুঁড়ো
নিমপাতা, মেথি ও আমলকির গুঁড়ো একত্র করে পানির সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর মিশ্রণটি চুলোয় ভালো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে। মিশ্রণটি ঠাণ্ডা হয়ে এলে মাথার ত্বকে ভালোভাবে লাগিয়ে নিতে হবে। মাথায় কিছু সময় রেখে গোসল করার সময় ধুয়ে ফেললেই হয়ে গেলো। তবে মিশ্রণটির ব্যবহার নিয়মিত করতে হবে। অন্তত সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে।

খুশকি নিরাময়ে নিমপাতার ব্যবহার; Source: roddure.com
নারকেল তেল ও কর্পূরের ব্যবহার
এক কাপের অর্ধেক পরিমাণ নারকেল তেলের মধ্যে এক চা-চামচ কর্পূর তেল মিশিয়ে একটি মুখ বন্ধ পাত্রে ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এরপর প্রতিরাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মাথায় ভালোভাবে চুলের গোড়ায় মাখতে হবে। কিছুদিন ব্যবহারের পর সুফল পাওয়া গেলে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমিয়ে দেয়া যেতে পারে।
বেকিং সোডার ব্যবহার
গোসলের সময় শ্যাম্পু না করে মাথায় ভালো করে বেকিং সোডা হালকা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। বেকিং সোডার ব্যবহারের ফলে মাথার ত্বকে জমে থাকা ছত্রাকগুলোর উপস্থিতি কমে আসবে। প্রথমদিকে মাথার ত্বক কিছুটা শুষ্ক হয়ে গেলেও কিছুদিন পর আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

খুশকি নিরাময়ে বেকিং সোডা; Source: tinystep.in
ঘৃতকুমারীর ব্যবহার
‘অ্যালোভেরা’ বা ‘ঘৃতকুমারী’র ভেষজগুণ সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবহিত রয়েছি। এর মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন আমাদের মাথার ত্বকের পুষ্টিতে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। তাই ঘরের কোণে পড়ে থাকা ঘৃতকুমারীর গাছগুলোও হয়ে উঠতে পারে আপনার খুশকি সমস্যার অন্যতম সমাধান।

খুশকি নিরাময়ে ঘৃতকুমারীর রস বিশেষভাবে সহায়ক; Source: medicalnewstoday.com
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা
যারা খুব বেশি খুশকি সমস্যায় ভুগছেন তাদের অবশ্যই নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে আসার পর অবশ্যই হালকা কুসুম গরম পানিতে গোসল করার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনযাপনে অনেক বেশি শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। চুলের এবং ত্বকের সাথে মানানসই ও ভালো মানের প্রসাধনী ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়াও জলপাইয়ের তেল, মেথির তেল, লেবুর রস ও লবণের ব্যবহারেও খুশকি থেকে মুক্তিতে ভালো ফল পাওয়া যায়। খুশকি সমস্যা সমাধানে এসব ঘরোয়া উপায়গুলো বেশ কার্যকরী। তবে এসকল পদ্ধতি নিয়মিত মেনে চলা অত্যাবশ্যকীয়। এরপরেও যদি আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া না যায় তবে অতিসত্বর ভালো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যকীয়।
ফিচার ইমেজ- healthline.com