করোনা মহামারী আমাদেরকে এক নতুন জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। স্বাভাবিক জীবনযাপনের সংজ্ঞা যা ছিল, তা আক্ষরিক অর্থেই বদলে গেছে গত কয়েক মাসে। পারিবারিক প্রেক্ষাপটে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে চলমান মহামারি তা নিয়ে বিস্তর গবেষণাও হয়ে গেছে। সম্প্রতি বিখ্যাত অ্যামেরিকান সংবাদ সংস্থা ভক্সের কাছে চারজন বাবা তাদের জীবনে মহামারির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তাদের ব্যক্তব্যে উঠে এসেছে পিতৃত্ব, ‘ঘরে বসে করি কাজ’, সাংসারিক জীবনসহ বেশ কিছু প্রসঙ্গ। এই চারজন বাবার কথাবার্তা ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে উপস্থাপন করা হলো।
নিজেকে নিয়ে সত্যিই অপটু অনুভূত হচ্ছিল
জেসন কার্ট, ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট, শিকাগো, ইলিনয়।
ব্যবসা একেবারেই ভেঙে পড়ল। লক ডাউনের আদেশ কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই শিকাগোর শহরতলী পুরোপুরি জনমানবশূন্য হয়ে গেল। দু’ সপ্তাহের মাঝে জীবনযাত্রায় এল অকল্পনীয় পরিবর্তন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৩-১৪ জন রোগীকে সময় দেওয়া থেকে জীবন পাল্টে গেল মধ্যাহ্নভোজের সময় ‘দ্য প্রাইস ইজ রাইট’ দেখাতে। তবে শেষ অবধি ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতা আমার জন্য ধোপে টেকেনি আর কারণ ছিল আমার পেশার ধরন- আমাকে রোগী দেখার অনুমতি দেওয়া হয়। আমার স্ত্রী ওর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। পেশায় সেও একজন ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট তবে সে একটি হাসপাতালে রোগী দেখে। মহামারির কারণে তার কর্মঘণ্টা ৬৬% হ্রাস পেয়েছিল যেটি হাসপাতালে কর্মরত কোনো থেরাপিস্টের জন্য কখনোই স্বাভাবিক নয়। তার কাজের সময় কমে গেলেও আমাদের দুজনের কেউই সেই অর্থে বাচ্চাদের সময় দিতে পারছিলাম না বাসায় থেকে। আর এমনিতেও আমার স্ত্রী তার কাজ নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না আর তার উপর কর্মঘণ্টা হ্রাস পাওয়াটা কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো ভূমিকা রাখল। শেষমেশ সে তার হাসপাতালের কাজটি ছেড়ে দিল।
সত্যি বলতে লক ডাউন আমাকে সমন্বয় সাধন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে শিখিয়ে গেছে। বাচ্চাদের সামলানোর দক্ষতাটা আমার একেবারেই ছিল না। দিনের যতটা সময় আমার স্ত্রী বাইরে থাকত তার পুরোটা জুড়ে তিন সন্তানকে ঠিক সময়ে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, তাদের সাথে খেলাধুলা করা, বিকালের নাস্তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজ করতে গিয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কলাকৌশল শিখতে হয়েছে। আমার সবসময় মাথায় রাখতে হয়েছে কোনোভাবেই যাতে বাচ্চারা তাদের মায়ের অভাববোধ না করতে পারে।
দাম্পত্য জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি আমার স্ত্রীকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। একজন মানুষ একই সাথে তিনটি সন্তানের মা এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের স্ত্রীর ভূমিকায় এতটা দক্ষতা এবং নৈপুণ্যের সাথে অবদান রেখে যেতে পেরেছে- এটি সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ এবারই প্রথম হয়েছে। তার প্রতি এখন আমার বাড়তি মর্যাদাবোধ কাজ করে। পুরো পরিবার বা একটি সংসারকে কীভাবে এক সুতোয় গাঁথতে হয়- এটি তার কাছ থেকেই আমি শিখতে পেরেছি। বাচ্চাদের সাথে বেশি করে সময় কাটাতে গিয়ে পিতৃত্বের যে অপার্থিব আনন্দ সেটি আমি নতুনভাবে লাভ করেছি। প্রতিদিন সকালে বাচ্চাদের সাথে ৫-১০ মিনিট দুষ্টুমি করার যে মজা সেটি জীবনে সবসময় আসে না আর তাই এই অভিজ্ঞতাকে আমি আশ্লেষে আলিঙ্গন করে নিই প্রতিবার।
বাঁচার জন্য ভিন্ন এক দর্শন ভীষণ জরুরী হয়ে পড়েছিল
এরিক বটসফোর্ড, ফ্লোরিডায় নিযুক্ত নিউ ইয়র্ক সরকারের কর্মকর্তা।
১২ বছর বয়সী দু’টি যমজ সন্তান নিয়ে আমরা এখানে আমার মায়ের বাসাতেই থাকছি। এক ছেলের মতে জীবনের বর্তমান এই ধারাটিই বেশ লাগছে। আগের জীবনযাত্রায় ফেরত যেতে সে একেবারেই নারাজ। আর অন্য ছেলের ভাবগতিক দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সে সামাজিক মেলামেশার বিষয়টিকে দারুণভাবে মিস করছে। স্কুলের যে বন্ধু, আনন্দ ও ফূর্তি সেটি সে ভুলতে পারছে না। প্যারেন্টিংয়ের উপর বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধ পড়লাম যেখানে বলা হয়েছে এই ‘নব্য স্বাভাবিকতা’কে সহজভাবে গ্রহণ করতে। অভিভাবক হিসেবে চলমান বাস্তবতায় সন্তানদেরকে ওদের মতো থাকতে দিতে বলছেন অনেকেই। তারা সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত টানা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলেও কিছু বলিনি কিন্তু এরপর তারা নিজেরা এমনকি আমিও বুঝতে পেরেছি যে এভাবে দিনানিপাত সম্ভব নয়। নতুন একটা উপায় বের না করলেই নয় এবার।
পরবর্তীতে কাজের চেয়ে বা বলা ভালো আর্থিক দিকটিকে কিছুটা কম গুরুত্ব দিয়ে বাচ্চাদের সাথেই সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। সন্তানদের প্রাথমিক যত্নটুকু পরিবারের বাইরে কেউই দিতে পারে বলে আমি মনে করি না। পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি আমার সন্তানদের প্রাথমিক যত্নআত্তিটুকু বিলিয়ে দিতে রাজি নই। নিজের পরিবার নিয়ে মায়ের বাসায় আছি- এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। অভিভাবক হিসেবে দুটি যমজ সন্তানের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতে গিয়ে ক্লান্তির শিকার হয়েছি আমি বহুবার তবুও এই কাজটির প্রতি আমি ভেতর থেকে এক ধরনের তাড়না অনুভব করি। মহামারী নিজে কোনোভাবেই ভালো কোনো বিষয় নয় তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও কিছু না কিছু ইতিবাচক দিক তো রয়েছেই, আর সেটিই আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি।
কাজের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার পর এক অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তি পেয়েছিলাম যা বিগত এক দশকেও মেলেনি
জুয়ান কমাস, আর্ট ফ্যাব্রিকেটর, টালাহাসি, ফ্লোরিডা
কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার দু’ সপ্তাহ আগে আমি আমার পূর্ণকালীন চাকরিটি সপ্তাহে দু’ দিনে রূপান্তর করে নিই। আমার স্ত্রী আমার তুলনায় অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে তার কাজ নিয়ে এবং কাজের ধরন অনুযায়ী তাকে প্রচুর ভ্রমণ করতে হয়। তার মাসিক আয় আমার প্রায় তিনগুণ আর তাই তার কাজের গুরুত্বও আমাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে বাসা আর দু’টি সন্তান সামলানোর মূল দায়িত্বটা আমিই নেব। ৮ এবং ১০ বছর বয়সী দু’টি সন্তানের স্কুলের সব কাজ প্রতিদিন বাসায় আসতে থাকে আর তাদের পড়ালেখা প্রধানত আমিই দেখভাল করতে থাকি। ওদিকে আমার স্ত্রী দিনের অধিকাংশ সময় কাজের জন্য জুম অনলাইন মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
বাচ্চাদের নিয়ে প্রথম দুটি সপ্তাহ ছিল অসম্ভব চাপের। শুরুর এই দিনগুলোতে দুই সন্তানের জন্য আমাকে যা পরিশ্রম করতে হয়েছে তা এক কথায় অচিন্তনীয়। স্কুল থেকে পাঠানো অসংখ্য বাড়ির কাজ বুঝে নেওয়া, সেগুলো বাচ্চাদেরকে দিয়ে করানো, নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে সেগুলো নির্ধারিত ওয়েবসাইটে আপলোড করা এই সমস্ত কাজ আমাদের প্রত্যকের জন্যই সম্পূর্ণ নতুন ছিল। বাসায় স্ত্রী তার কম্পিউটার ব্যবহার করত আর এছাড়া আরও একটি কম্পিউটার এবং একটি আইপ্যাড ছিল। নির্ধারিত ওয়েবসাইটগুলোর সার্ভার ছিল খুবই দুর্বল যার কারণে অপ্রত্যাশিত সংখ্যক ব্যবহারকারীর চাপ সামলাতে না পেরে ধীরগতির হয়ে যাচ্ছিল। এছাড়াও সেগুলো ছিল নানারকম বাগে পরিপূর্ণ। দু’ সপ্তাহের অভিজ্ঞতায় এবার আমি পুরো ব্যপারটাকে নিজের মতো করে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ঢেলে সাজালাম।
যেহেতু নির্ধারিত কোনো ওয়েবসাইটই আইপ্যাডে কাজ করছিল না তাই প্রতিদিন কম্পিউটার ব্যবহারের সময় দুই সন্তানের জন্য আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হত। প্রতিদিন কে কখন কতক্ষণ যাবত কাজ করবে সেটি ঠিক করে রাখতাম আগে থেকেই। প্রতিটি মুহূর্ত বাচ্চাদের কে কখন কী করবে সেটি একদম রুটিনমাফিক চলতে শুরু করল। ঘড়ির কাঁটা ধরে সবকিছু যখন একবার মসৃণভাবে চলতে শুরু করল তখন পরিবারের প্রত্যেকে এক অনাবিল, অনির্বচনীয় আনন্দের সান্নিধ্য পেতে শুরু করল। পরিবার হিসেবে নানা রকমের অনভিজ্ঞতা, সমস্যা, সমন্বয়হীনতা ইত্যাদির মুখোমুখি হয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সেগুলোকে সমাধান করার যে অসাধারণ তৃপ্তি সেটিই এই লকডাউন আমাদেরকে উপহার দিয়ে গেছে।
সন্তানদের সাথে জীবনে কাটানো দীর্ঘতম সময়
জ্যাক পোলাকোফ, সঙ্গীত প্রযোজক, সাময়িকভাবে ব্রুকলিন থেকে ভারমনে স্থানান্তরিত
এখন যেখানে বসবাস করছি সেখানে কাছাকাছি কোথাও ময়লা ফেলার নির্ধারিত স্থান নেই। বাসা থেকে বের হয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে যেতে হয় ময়লা ফেলে আসার জন্য- আর এটিই আমার এখনকার নতুন দায়িত্ব। প্রশ্নাতীতভাবে জীবনে এখন পর্যন্ত বাচ্চাদের সাথে কাটানো সবচেয়ে দীর্ঘ সময় এটিই। বাসায় থেকে সবার সাথে সময় কাটানোতে একধরনের মানসিক মুক্তির সন্ধান মেলে যার দেখা সম্ভবত স্বাভাবিক, প্রলচিত জীবনে খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে কিছুদিন ধরে খানিকটা একাকী সময়ের অভাব বোধ করছি। আমার ধারণা এ কথা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে নিজের জন্য প্রত্যেকেরই কিছুটা সময় ভীষণ জরুরী। ৩ বছর এবং ৯ মাস বয়সী দুই সন্তানের দেখভাল করার কাজটা আমরা দুজন পালা করে করি। আজ স্ত্রী সকালের প্রায় পুরোটা সময় কাজে ব্যস্ত ছিল তাই আমার মিটিংগুলো পর্যায়ক্রমে দুপুর ৩টা থেকে এক ঘণ্টা পরপর ঠিক করেছি। এই সময়টুকুতে আমি আমার নিজেকে সময় দিতে পারব। এছাড়া যখন নিয়ম করে বাইরে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য গাড়ি নিয়ে বের হই তখন গাড়ি চালাতে চালাতে হালকা করে গান ছেড়ে দিই আর নিজের মতো উপভোগ করি।
প্যারেন্টিংয়ের প্রেক্ষাপটে সব দম্পতিই একটি সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক আশা করে। আমার স্ত্রীর প্রতি আমি আক্ষরিক অর্থেই কৃতজ্ঞ যে সে তার কাজের পাশাপাশি সম্পূর্ণ সজাগ আমার কাজকর্ম সম্পর্কে। সন্তানদের সামলাতে গিয়ে যখনই আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় তখনই সে প্রতিবারের মতো আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাচ্চাদের থেকে যেকোনো একজনকে সে তার নিজের কাছে নিয়ে সামলায় আর তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার উপর চাপ কমে আসে। এই অনিন্দ্য উপহারটি সে অনেকটা নিয়ম করেই আমাকে দিয়ে যাচ্ছে।