
ইট, কাঠ, ধুলাবালি আর যান্ত্রিকতার এই শহরে একটু সবুজ এনে দিতে পারে সজীবতা। সারাদিনের ঘর্মক্লান্ত শ্রান্ত দেহটা নিয়ে যখন ঘরে পা দিবেন, তখন এক ঝলক সবুজ আপনাকে দিবে প্রকৃতির পরশ। মন মাতানো অর্কিড কিংবা বেলি ফুলের ঘ্রাণ আপনাকে নিয়ে যাবে মাদকতার অন্য এক জগতে। তাছাড়া আপনার বাসায় ফ্রিজ, অ্যারোসল বা মশার কয়েল এবং আপনি যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করেন, তার জন্য ঘরে গাছ লাগানো জরুরি। কাঠাফাটা গরমে আপনার ঘরকে সুশীতল রাখবে গাছপালা। চলুন দেখে আসি কী কী গাছ লাগিয়ে নিজের ঘরে অরণ্যের আবহ নিয়ে আসতে পারেন।

Image Credit: buzz16.com
প্রথমেই কিছু ইনডোর প্ল্যান্টের নাম জেনে নেই। তারপর দেখা যাবে সেগুলো কোথায় লাগালে ভালো হবে। ইনডোর প্ল্যান্ট হলো যেসব গাছ কম সূর্যের আলো ও ছায়ায় বেড়ে উঠতে পারে। যেমনঃ পাতাবাহার, ক্যাকটাস, চাইনিজ পাম, পনিটেইল পাম, পেপেরোমিয়া, জিজি প্ল্যান্ট, বাহারি কচু, মথ অর্কিড, এরিকা রোজ, কেবি রোজ, বাঁশপাতা, গ্রেপ আইভি, ইংলিশ আইভি, ড্রেসিনা, আইভি লতা, কুইনস টিয়ারস (Queens Tears), পেপেরোমিয়া ইত্যাদি। ইনডোর প্ল্যান্টের জন্য খুব বেশি আলো বাতাসের দরকার হয় না, কিন্তু একদম বদ্ধ ঘর হলেও চলবে না। যত্নের পাশাপাশি ঘরে আলো বাতাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখবেন।
পেপেরোমিয়া (Peperomia Plant)

পেপেরোমিয়া
প্রথমে আসা যাক পেপেরোমিয়ার কথায়। এটা এতটাই জনপ্রিয় যে প্রায় প্রত্যক বাসা বাড়ির নিচে এবং ছাদের দেখা যায়। আপনি চাইলে ঘরেও লাগাতে পারেন পেপেরোমিয়া। এর পাতার রঙের ছটা ঘরকে করে তোলে বর্ণময়। বসার ঘরের এক কোনায় পেপেরোমিয়া লাগাতে পারেন। এটা খুব ছোট পটেই এঁটে যায় (ফুটবল সাইজের), বেশি জায়গা নষ্ট করবে না। মাঝারি আলোয় রাখলে ভালো হয়। তবে এই গাছের পাতা বিষাক্ত। বাসায় কুকুর, বিড়াল বা অন্যান্য পোষা প্রাণীর সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখবেন। গাছের পাতা দেখলে আপনার আদরের কুকুর বা বিড়ালের তা চিবুতে ইচ্ছা হতেই পারে!
গ্রেপ আইভি (Grape Ivy)

গ্রেপ আইভি
গ্রেপ আইভি আর্দ্র পরিবেশে ভালো হয় তাই এটি বারান্দায়, জানালায় এবং দরজার মুখে লাগাতে পারেন। বাদলা দিনে যখনই বারান্দায় আসবেন, এর কচি সবুজ,সতেজ পাতার যে সৌন্দর্য আপনি দেখবেন তা কখনোই ভুলতে পারবেন না। এর জন্য আপনাকে ঝুড়ি ব্যবহার করতে হবে। মাঝারি সাইজের প্ল্যান্ট ঝুড়িগুলোতে রাখতে পারেন। এটি নিজে নিজেই বাড়ে, বিশেষ যত্নের তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে মাঝে মাঝে কচি পাতাগুলো মুছে দিতে পারেন। একইভাবে ইংলিশ আইভিও লাগাতে পারেন বারান্দায়, বাথটাবের পাশে। বাসায় পুরনো চায়ের কেটলি বা সুগার পটের হ্যান্ডেল ভেঙ্গে গেলে, ভাঙা স্থানটি পরিষ্কার করে, রং করে তাতে গাছ লাগিয়ে বাথরুম বা কিচেনে সাজিয়ে রাখলে বেশ শোভাবর্ধিত হয়। তবে এক্ষেত্রে সাবধান থাকবেন। বাচ্চারা একটা বয়সে যাই হাতের কাছে পায় তাই মুখে দেয়। গ্রেপ আইভি এবং ইংলিশ আইভির পাতা অত্যন্ত বিষাক্ত।
জিজি প্ল্যান্ট (Zeezee Plant)

জিজি প্ল্যান্ট
জিজি প্ল্যান্টের প্রাণ হলো কৈ মাছের প্রাণ। সহজে মরতে চায় না। এই গাছের পাতা এতটাই সতেজ আর তীব্র সবুজ যে দেখলেই মনে হয় প্লাস্টিকের গাছ। খুব বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় না। মাঝে মাঝে পানি দেয়ার পাশাপাশি পাতা মুছে দিলেই হয়। এটি অন্যান্য গাছের চেয়ে খানিক বড় হওয়ায় একে বসার ঘরে কিংবা খাবার ঘরের এক কোণায় জায়গা দিতে পারেন। কেনার সময় একটু বড় দেখে কিনবেন। তারপর নিয়মিত পাতা আর ডাল ছেঁটে দিলেই আর তেমন বড় হবে না। এর পাতাও বিষাক্ত। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাচ্চা এবং পোষা প্রাণীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখবেন।
মানিপ্ল্যান্ট (Money Plant)

মানিপ্ল্যান্ট
মানিপ্ল্যান্টকে সৌভাগ্যের গাছও বলা হয়। ধারণা করা হয়, এই গাছ বাড়িতে বা অফিসে লাগালে, বাড়ির সুখ- শান্তি আর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হিসেবে কথিত আছে- গাছের প্রত্যেকটি শাখায় ৫টি করে পাতা থাকে। এই পাঁচটি পাতা ধাতু, কাঠ, জল, আগুন ও পৃথিবীর প্রতীক। এই পাঁচটি উপাদান সমৃদ্ধিকে আকর্ষণ করে।
পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, সুখ-শান্তি আর সমৃদ্ধি মানবসৃষ্ট। সেটা কোনো গাছ কিংবা ফুল বয়ে নিয়ে আসতে পারে না। এছাড়া মানিপ্ল্যান্টের ফুলের সুগন্ধ বেশ মাদকতাময়। এই মাহাত্ম্যময় গাছটির যত্ন করাও বেশ সহজ। পাতা বা ডাল ছিড়ে এনে অল্প মাটিতে পুঁতে দিলে দেখবেন কিছুদিনের মাঝে এটি ডালপালা মেলতে শুরু করেছে, চাইলে পানিতেও রাখতে পারেন। পানিতে রাখতে চাইলে কন্টেইনার ব্যবহার করতে পারেন।
পনিটেইল পাম (Ponytail palm)

পনিটেইল পাম
পনিটেইল পামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর পাতা দেখতে অনেকটা সামুরাই কিংবা জাপানীজ কার্টুনের নায়কের চুলের মতো। চিকন চিকন সবুজ পাতা নেতিয়ে থাকে। এ গাছ প্রায় ১০ ফুট লম্বা হয়। অন্যান্য ইনডোর প্ল্যান্টের তুলনায় এই গাছ বেশি আলোতে বেড়ে উঠে। পনিটেইল পাম শোবার ঘরে রাখতে পারেন।
ড্রেসিনা (Dracaena)

ড্রেসিনা
সবুজের মাঝে হলুদের চিরল কাটা ড্রেসিনা পাতা আপনার ঘরে নিয়ে আসবে বর্ণের বৈচিত্র্যময়তা। এটি হালকা আলো বাতাসে বেড়ে উঠে। পরিণত অবস্থায় লম্বায় প্রায় ১০ ফুট হয়। এ ধরনের বড় গাছগুলো খাবার এবং শোবার ঘরে রাখাটাই উত্তম। এছাড়াও খাবার এবং শোবার ঘরে রক্তপাতা, ক্রোটন, রিবন প্ল্যান্ট, শতমূলী, ক্যালাডিয়াম, ডাম্বকেইন ও অ্যাগলিওনিমা প্রভৃতি উদ্ভিদ বেছে নিতে পারেন।
এবার আসা যাক কিছু সাধারণ যত্নের কথায়। টবসহ গাছ ঘরে এনে রেখে দিলেই হবে না। এর নিয়মিত যত্ন করতে হবে। প্রায় সব ইনডোর প্ল্যান্টের যত্ন একই রকম। যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন-
- প্রত্যেকটা টবের তলায় ছিদ্র আছে কিনা দেখে কিনবেন। কারণ ছিদ্র দিয়ে গাছের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়। ফলে গাছের মূল পচে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়।
- একবারে বেশি পানি দিবেন না। অল্প পরিমাণ পানি দিবেন। সাধারণত ইনডোর প্ল্যান্টের পানির চাহিদা সাধারণের চেয়ে কম থাকে। তবে প্রতিদিনই অল্প অল্প করে পানি দিতে হবে। এতে আপনার খুব বেশি সময় নষ্ট হবে না। চাইলে অফিস থেকে ফিরে বিকেলের চা নাস্তা খাবার আগে গাছের হালকা যত্ন নিতে পারেন। সতেজ সব গাছ দেখতে দেখতে বিকালে পরিবারের সাথে একসাথে চা নাস্তা খেতে পারেন।
- ইনডোর প্ল্যান্ট বড় হতে বেশি আলোর দরকার হয় না। কিন্তু একদম সূর্যের আলো ছাড়াও তেমন সতেজ থাকে না। তাই গাছগুলোকে সপ্তাহে ১-২ বার সকালে অথবা বিকালের মিষ্টি রোদে দিন। মনে রাখবেন দুপুরের কড়া রোদে এসব গাছ মারা যায়।
- গাছে মাঝে মাঝে সার দিন। সার নার্সারিতে কিনতে পাবেন। চাইলে নিজেও ঘরে বানিয়ে দিতে পারেন। চায়ের পাতা আর ডিমের খোসা দিয়ে ঘরেও সার বানাতে পারেন। চায়ের পাতার সাথে ডিমের খোসা শুকিয়ে গুড়ো করে রোদে দিলে তা গাছের জন্য উত্তম সার হিসেবে গণ্য হবে। চাইলে জৈবসারও (গরু, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা) ব্যবহার করতে পারেন। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করাই উত্তম।
- ৮-১০ দিন পর পর মাটি উল্টেপাল্টে দিন। এতে মাটির মাঝে জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে যাবে।
- ইনডোর প্ল্যান্ট ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তাই এসব গাছ বেশি বড় হতে না দেয়াই ভালো। এতে ঘর অন্ধকার দেখাবে।
- অনেকে মনে করেন ঘরে গাছ লাগালে মশা মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড়ের উপদ্রব হতে পারে। কথা সত্য। তবে সেটা যদি হয়, আপনি কখনোই টবে জমে থাকা পানি পরিষ্কার না করেন, ঠিকভাবে গাছের পরিচর্যা না করেন তখন। যাদের অ্যালার্জি বা অ্যাজমার সমস্যা আছে তারা শোবার রুমে গাছ রাখবেন না।

Image Credit: ideas4homes.com
এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে। আপনি প্রচণ্ড ব্যস্ত একজন মানুষ, এত ব্যস্ততার মাঝেও কেন এত কষ্ট করে গাছ লাগাবেন, আবার যত্ন করবেন, এতে লাভটা কী? চলুন খানিক লাভ ক্ষতির হিসাব করে নেই।
- প্রথমত গাছ লাগালে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাচ্ছেন। বিশুদ্ধ বাতাস পাচ্ছেন। দূষিত বায়ু গ্রহণের ফলে আপনি অল্প বয়সেই বিভিন্ন শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগেন, তা থেকে মুক্তি পাবেন।
- উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ এবং শ্বসন উভয় প্রক্রিয়াতেই পানি নিঃসরণ করে। উদ্ভিদ যে পরিমাণ পানি গ্রহণ করে তার ৯৭% প্রক্রিয়া শেষে নির্গত করে। বুঝতেই পারছেন, উদ্ভিদ আপনার বাসার এসি হিসেবে কাজ করছে।
- গাছ ঘরের বাতাসকে বিশুদ্ধ রাখে। নাসার এক গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভিদ প্রতি ২৪ ঘণ্টায় বাতাসের প্রায় ৮৭% VOC (Volatile Organic Compound) গ্রহণ করে। VOC-গুলো হলো ফরমালডিহাইড জাতীয় দ্রব্য, বেনজিন এবং ট্রাইক্লোরোইথিলিন। বেনজিন সাধারণত পড়াশুনার জিনিসপত্র যেমন বই খাতা ইত্যাদির মাঝে বেশি পাওয়া যায়। গাছ এই বিষাক্ত উপাদানকে মাটির ক্ষুদ্র অনুজীব দ্বারা খাদ্যে পরিণত করে।
- The Royal College of Agriculture in Circencester, England এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাছপালা সমৃদ্ধ স্কুল ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মনোযোগ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি।
তাই নিজে গাছ লাগান, সন্তানদের মাঝেও গাছ লাগানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। কারণ কাল আপনার সন্তানকেই এই দূষিত পৃথিবীর বাতাসে শ্বাস নিতে হবে।