চাকরির মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আরিফ সাহেব ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি হয়ে সফলভাবে সবকিছু উৎরে এলেও, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারখানা কেন জানি তার হাতে ‘আসি আসি’ করেও আসছে না। হঠাৎ একদিন আরিফ সাহেবের ফোন বেজে উঠলো। অন্য একদিন অফিসে গিয়ে দেখা করে আসার তারিখ জানানো হলো। সেদিন গিয়ে দেখলেন টালমাটাল অবস্থা। রীতিমতো ব্ল্যাকমেইলিং!
তাকে বলা হলো, তিনি যদি চাকরিতে ‘অস্থায়ীভাবে’ যোগদান করতে না চান, তবে পরবর্তী প্রার্থীকে তার বদলে নিয়ে নেওয়া হবে। চাকরিটা তার খুবই দরকার। বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল স্পষ্ট অক্ষরে, “বেতন ৪৩ হাজার টাকা, সাথে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা“। পরীক্ষা ভালো দিয়ে সে দিন থেকেই তিনি ছেঁড়া কাথায় শুয়ে শুয়ে সেই ৪৩ হাজার টাকার স্বপ্নই দেখে যেতেন রোজ। সেই স্বপ্ন মরীচিকাময় দুঃস্বপ্ন হয়ে যেন আজ ধরা দিলো ৪৩ হাজার বনাম ২০ হাজার টাকার অস্থায়ী চাকরিরূপী অধ্যায়ে। তিনি এসবের কোনো সদুত্তর খুঁজে পেলেন না। ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’, এই ভেবে যোগদান করলেন অস্থায়ী চাকরিতে। তার জীবনখানা তখন থেকেই যেন তেজপাতা হয়ে যেতে লাগলো। এভাবে ৬ মাস পার হয়ে গেলো।
অফিসের বস কথা দিয়েছিলেন ৬ মাসের মাথায় চাকরি স্থায়ী করার। কিন্তু কথা দিয়েও কথা রাখলেন না তিনি। স্থায়ী হতে হলে নাকি তাকে অপেক্ষা করতে হবে দুই থেকে তিন বছর! তার আগে রয়েছে আরো অনেক সিনিয়রদের চাকরি স্থায়ীকরণের সিরিয়াল। সে লাইন উৎরে তবেই তার পালা। অবশ্য তিনি সে কথা জানলেন চাকরিতে যোগদান করার বহু পরে। একে তো অস্থায়ী ঝুলন্ত দশা, তার উপর জুনিয়র হওয়ার দায়ে তার উপর বর্তায় অতিরিক্ত কাজের চাপ। কাজ করতে করতে আশপাশের পার্মানেন্ট কলিগদের ‘হাই-ফাই’ জীবন এবং ফুলে উঠা মানিব্যাগ দেখে গোপনে তার চোখের কোণে জমে আসে জল।
সেসব আরিফ সাহেবদের জীবনে সুপারম্যানের মতো ম্যাজিক খাটিয়ে অস্থায়ী চাকরিকে স্থায়ী করার সহজ কিছু টিপস বাতলে দেয়া হবে আজ। তেমন কিছুই নয়। সামান্য কিছু বিষয় মাথায় রাখলেই আপনিও হয়ে উঠবেন পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে সকলের চোখের মণি তথা ‘সুপারম্যান’ কিংবা ‘সুপারহিরো’।
হাতঘড়ির টিক্ টিক্ কে ‘না’ বলুন
অফিস বলেছে ন’টা- পাঁচটা ডিউটি? ভুলে যান সময়। ভুলে যান বাড়ি। পেয়েছেনটা কী? অন্যদের মতন চোখ কচলে ন’টায় অফিসে পৌঁছুবেন আর বিকেলে পাঁচটার ঘরে ঘড়ির কাঁটা আসতে না আসতেই, তল্পি-তল্পা গুটিয়ে হন্যে হয়ে বাড়ির পথে ছুটবেন- সেটা দেখে অফিস টগমগ হয়ে আনন্দে আপনাকে একেবারেই পার্মানেন্ট করে দেবে সিরিয়াস কর্মী ভেবে? মোটেও সেটা হবে না।
সকালে ফ্রেশ মুডে ঝাড়ুদারদের আগেই অফিসে পৌঁছে কাজের হিড়িক দেখাবেন, আর রাতে নাইট গার্ডের সাথে অফিসে তালা ঝুলিয়ে একত্রে খোশগল্প করতে করতে তবেই বেরিয়ে আসবেন। তাহলেই না দেখবেন, চাকরির বাজারে আপনাকে আর আটকায় কে? এমন ঘটনার ক’দিন পরেই খেয়াল করবেন, আপনার নামে তুখোড় আলোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। এই আলোচনার সূত্রপাত অবশ্য ঝাড়ুদার আর নাইট গার্ডদের মাধ্যমেও হতে পারে। কারণ অফিসের বসেরা বেশিরভাগ খোঁজ-খবর নেন এদের মাধ্যমেই। কর্তব্যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে থাকুন। বেশ কিছুদিন নিজের কাজটা যথাযথভাবে করে যান। অফিসের পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী
কথাটা পুরনো হলেও এর ভোল একেবারেই পাল্টে যায়নি কিন্তু। আচ্ছা ভাবুন তো, ছোটবেলায় স্কুল-কলেজে যাওয়া থেকে শুরু করে সব কাজেই কি কোনো না কোনো রকম ইউনিফর্ম ছিল না? তবে অফিসের ক্ষেত্রে কেন নয়? এটা তো আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। ভাবছেন স্বাধীন দেশে আপনার পোশাকের স্বাধীনতা হরণ হলো বুঝি? মোটেও তা নয়।
ইমোশন ছেঁটে প্র্যাকটিক্যালি ভাবুন তো, অফিসের গোছালো গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশে যদি আপনার পোশাকটা হয় ব্যাচেলর পার্টির মতো, তবে সেটা কি শোভনীয়? সুতরাং প্রথমে পোশাক তারপর পারফর্মেন্স। অফিসের ড্রেস কোড যদি থাকে, তবে তা মেনে চলুন অথবা ফর্মাল ড্রেস, যা অফিসের সাথে যুতসই মানিয়ে যায়, সেটাই বজায় রাখুন। বস যখন অফিস পরিদর্শনে আসবেন অথবা মিটিংয়ে যখন আপনাকে দেখবেন, তখন যাতে আপনার পোশাক আর স্মার্টনেস তার বিশেষভাবে নজরে পড়ে। এর ফলাফলটা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন কী হবে।
মেজাজ কমিয়ে হয়ে উঠুন উদ্যমতায় পরিপূর্ণ
নতুন কর্মস্থলে কাজের চাপ স্বভাবত একটু বেশিই হয়ে থাকে। এতে যদি আপনার মেজাজ সপ্তকে চড়ে বসে, তবে আপনার কপালে শনি-ই রয়েছে। টেকনিক্যাল হোন। আপনি কি ভেবেছেন, আপনার খেয়াল খুশি মতো আপনি চলবেন আর বস আপনাকে বরমালা দিয়ে রথে চড়িয়ে চাকরি স্থায়ী করে দেবেন? মনে রাখবেন, প্রথম সময়টাই হলো আপনার পারফর্মেন্স দেখানোর সুবর্ণ সুযোগ।
আপনি পরিশ্রমী নাকি অলস, কোম্পানি আপনার কাছ থেকে ভালো কিছু কি প্রত্যাশা করতে পারে নাকি না, সেটা পরীক্ষা করার সময়ই হলো আপনার চাকরির প্রথম দিককার সময়। কথা হলো, কীভাবে আপনি বসের সুনজরে আসবেন? আপনাকে দেওয়া কাজ ডেডলাইনের আগেই শেষ করে নতুন কাজের জন্য মুখিয়ে থাকাটা এই সময়কার একমাত্র দুর্দান্ত টেকনিক। শুধু নিজের কাজেই নয়, এভাবে নানা বিষয়ে নানা ক্ষেত্রে আপনার কাজ করার উদ্যমকে কিছুতেই যখন অবদমিত করা যাবে না, তখনই কোম্পানি রুই-কাতলাদের মন প্রসন্ন হয়ে আপনাকে তারা বরমাল্য হিসেবে দিতে পারে স্থায়ী চাকরি।
কথা বেশি, কাজ বেশি
আজকাল উন্নত জীবনযাত্রার যুগে এসে ‘কথা কম, কাজ বেশি’ যুক্তি অনেকটাই যেন বেমানান। কাজের সাথে সাথে আপনার মুখটাকেও যে চালু রাখতে হবে বস, তবেই না আপনি হয়ে উঠবেন দশের মাঝ থেকে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব! তবে অতিরিক্ত চাপাবাজি মোটেও নয় কিন্তু। তাহলে হিতে বিপরীত ঘটবে। কেবলমাত্র নিজের কাজটুকুন সূচারুরূপে সেরে কেটে পড়ছেন কি? তবে আপনি আর বিশেষ হলেন কীভাবে? খেয়াল রাখুন, পাশের ডেস্কে অমুক সিনিয়র কলিগের কাজে দায়সারা ভাব? নাকি তমুক জন কাজ করতে গিয়ে পড়ে গেছেন কোনো ঝামেলায়? ঠিক তখনই সুযোগ নিন আপনার সুপারম্যান রূপটি ফুটিয়ে তোলার। ঝামেলায় পড়া কলিগদের কর্মক্ষেত্রে হয়ে উঠুন মূর্তিমান মুশকিল আসান।
জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সিঁড়ি ধরে পা রাখুন একেবারে শীর্ষে। তারাই আপনাকে পথ বাতলে দেবে। ভুলে বসবেন না যেন, আপনার সমস্ত কাজের ট্র্যাক রাখছেন কিন্তু উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ। এই ট্র্যাকে যদি চিড়ে না-ই ভিজে, তবে জনগণের দাবি বলে তো একটা কথা আছে, তাই না? মনে রাখবেন, সকলের মুশকিল আসান হয়ে ওঠার খাটুনির প্রতিদান কিন্তু আপনার ঝোলাতেই থাকবে। এটাই একমাত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠার রাস্তা।
আইডিয়া ‘হিরো’
পাশের ডেস্কের সিনিয়র কলিগ তার রোজকার মজার মজার রান্না এনে তার সিনিয়রদের খাইয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন নাকি? ব্যাপার না। রান্না আপনি খাওয়ান বা না-ই খাওয়ান, কিন্তু আপনার নিজের নতুন নতুন আইডিয়া শেয়ার করে ডাবল তাক লাগিয়ে দিন তাদেরকে।
তবে মনে রাখবেন, যথা স্থানে যথা জিনিস। আইডিয়া যা-তা হলে চলবে না। আপনার শেয়ার করা আইডিয়াতে যদি কোম্পানি ফুলে ফেঁপে ওঠে, তাহলে তো স্বয়ং বসই এসে আপনাকে বলবে- “এমন একজনকেই তো কোম্পানি এতদিন খুঁজছিল।” সাথে সাথে আপনার ভাগ্যের চাকাও সপাং করেই খুলে যেতে বাধ্য, তা আর মুখে বলার অপেক্ষা রাখবে না।
হজম গুরু
ভুলেও একজনের শেয়ার করা কথা আরেকজনের কাছে বলতে যাবেন না। যার কাছ থেকে যা যা শুনবেন, সব কিছুই গিলে ফেলুন। সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন। চাকরির ক্ষেত্রে অন্তর্কোন্দল বা আন্তঃরাজনীতি থাকতেই পারে। একজনের কথা আরেকজনকে বলতে গেলেই তাতে আগুনে ঘি ঢালার কাজটি হয়ে যাবে। সুতরাং এ থেকে প্রথমে গা বাঁচিয়ে মুখ বন্ধ আর চোখ-কান খোলা রেখে চলুন। দেখবেন আপনিই সকলের হজমী ওষুধ হয়ে উঠেছেন। লাভটা কিন্তু আপনারই।
নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলুন
কর্মক্ষেত্রে সংযত থাকুন। অবস্থা বেগতিক দেখতে থাকলে অন্য জায়গায় চাকরির দরখাস্ত দেওয়া জারি রাখুন। নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে, লক্ষ্যে স্থির থেকে, নিজের সহজাত প্রতিভা বিকশিত করে নিজের দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলুন, যাতে প্রতিষ্ঠানে আপনার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। আর যদি দেখেন, এত কিছুর পরেও কোনো উন্নতির অবকাশের লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না, এই প্রতিষ্ঠান আপনার মেধার মূল্যয়ন করবে না; তখন সুযোগ বুঝে প্রতিষ্ঠানকে একদিন বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কেটে পড়তে পারেন।