প্রথমেই তিনটি দৃশ্যপট থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
১. পাঁচ বছর বয়সী তুলি। রাতে হঠাৎ একটি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর সে কিছুটা ভীত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে, মায়ের শ্বাসপ্রশ্বাস চালু আছে কি না!
গত মাসে বাবার সাথে প্রচণ্ড ঝগড়া করে মা ব্লেড দিয়ে নিজের হাতের রগ কাটার চেষ্টা করেছিল। সেই থেকে তুলি মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভয় নিয়ে বেঁচে আছে, যে ভয়ের কথা কাউকে বলা যায় না।
২. সাত বছরের রিফাত। ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চে বসেও শিক্ষকের কথাগুলোতে কোনোভাবেই মনোযোগ দিতে পারছে না। মনে হচ্ছে, শিক্ষকের সব কথা শুধু তার কান ঘেঁষে চলে যাচ্ছে।
৩. চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তমাল। সে ক্রিকেট খেলা নিয়ে ঝগড়া করে এক বন্ধুর মাথায় ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে জোরে মেরেছে। তবে বিষয়টা নিয়ে তার মধ্যে তেমন কোনো অনুশোচনা আছে বলেও মনে হচ্ছে না।
দুঃস্বপ্নের একটা সুবিধা আছে, কোনো না কোনো সময় স্বপ্নটা ভাঙবেই। তবে আপনার সন্তানের জীবনটাই যদি একটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে যায়, এর ফলাফলটা কোনদিকে এগোতে পারে, একবার ভেবে দেখেছেন কি?
‘Parental Strife’ কিংবা ‘পিতা-মাতার কলহ’ বিষয়টার সাথে একটুও পরিচিত নন, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিয়ের মাধ্যমে দুজন নর-নারীর মাঝে সমাজস্বীকৃত একটি বন্ধন তৈরি হয় এবং সেই সাথে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে একধরনের আত্মিক সম্পর্কও। যেহেতু স্বামী এবং স্ত্রী দুজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কাজেই তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে স্বামী স্ত্রীর সেই মতপার্থক্য যেন কলহে রূপান্তরিত না হয়, সে বিষয়ে অবশ্যই তাদেরকে সচেতন থাকতে হবে। বিশেষত যখন তারা সন্তানের বাবা-মা হয়ে ওঠেন, তখন তাদের উচিত, এ দিকটায় সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখা।
এই মতপার্থক্য কি সবসময় সন্তানদের জন্য নেতিবাচক ?
এর উত্তরটা নির্ভর করছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হলে তারা কীভাবে সেটাকে সামলে নিচ্ছেন, তার ওপর। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতের অমিল হতে পারে। তবে তারা যদি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে সুস্থ ও সুস্পষ্টভাবে যুক্তি উপস্থাপন করে নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় আসতে পারেন, তাহলে বিষয়টি তাদের সন্তানের মানসিক দৃঢ়তা তৈরিতে সহায়ক হয়। [1]
কিন্তু এটা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অধিকাংশ দম্পতিই বিচক্ষণতার সাথে এ ধরনের পরিস্থিতিগুলো সামলে নিতে সমর্থ হন না। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা নিজেদের মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে খুব ঘন ঘন ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং সন্তানের সামনেই পরস্পরের প্রতি আক্রমণাত্মক অনেক বাক্য ছুঁড়ে দেন, যেটা নিঃসন্দেহে তাদের সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।
এই কলহ কীভাবে সন্তানদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে?
বাবা-মায়ের কলহ তাদের সন্তানদের ওপর যে ধরনের প্রভাব ফেলে, সেগুলোকে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি। যার প্রথমটা হলো মানসিক এবং দ্বিতীয়টা সামাজিক প্রভাব। এই কলহ যদি তীব্র কিংবা দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে অবশ্যই সেটা সন্তানদের জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ট্রমা, প্রচণ্ড মানসিক চাপ, প্রতিকূল শৈশব শিশুদের মস্তিষ্কে ভয়ানক প্রভাব ফেলে থাকে, যার রেশ থেকে যেতে পারে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও।
শিশুদের সামনে যদি বাবা-মায়ের পরস্পরের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ ক্রমেই বাড়তে থাকে, তাহলে সেটি শিশুদের স্ট্রেস হরমোন রিলিজের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শৈশবের শুরুতেই ঘন ঘন এমনটা হতে থাকলে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে মস্তিষ্কের যে অংশ কোনোকিছু শেখা এবং যুক্তিনির্ভর কাজগুলো সম্পন্ন করে থাকে, সেখানে নিউরনের সংযুক্তি স্থানগুলো কমে কিংবা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। এতে দেখা যায়, একটা সময় শিশুদের মস্তিষ্কের চিন্তাশীল অংশের নিউরাল সংযোগসমূহ দুর্বল হয়ে সার্ভাইভাল অংশের নিউরাল সংযোগসমূহকে শক্তিশালী করে তোলে। এর ফলে ভবিষ্যৎ জীবনের তাদেরকে নানা প্রকার সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এতে ব্যাহত হয় তাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোও। [2]
শিশুরা স্বভাবতই একটু বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তারা যখন বাড়িতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের মধ্যে ঘন ঘন লড়াই ঝগড়া দেখতে থাকে, তখন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
এতে সৃষ্ট সাধারণ সমস্যা
- বাবা-মায়ের সাথে শিশুদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হওয়া।
- শিশুদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতাজনিত ভীতি তৈরি হওয়া।
- প্রবল বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হওয়াসহ একাকিত্বে ভোগা।
- বন্ধুহীনতা।
- বিদ্যালয়ের কোনো কাজে স্বকীয় অংশগ্রহণ না করা।
- অনিদ্রাজনিত সমস্যা সৃষ্টি হওয়া।
- ওজনের অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি।
- স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া।
- মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
- অতিমাত্রায় উদ্বেগ তৈরি হওয়া।
- উচ্চতর ফ্যান্টাসিময় জীবন।
- সহোদরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়া।
- নেতৃত্বের গুণাবলি না থাকা।
- যৌন অপরাধের সাথে অধিকতর সম্পৃক্ততা।
- নিজ আবেগ ও ক্রোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়া। [3], [4]
তাহলে সচেতন হওয়ার সঠিক সময় কোনটা?
সন্তান প্রতিপালনের কাজটায় প্রবল আবেগের পাশাপাশি কঠিন দায়িত্বশীলতাও থাকা উচিত। আর এক্ষেত্রে সঠিক সময়েই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। একজন নারী গর্ভধারণের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর উচিত, এসকল বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে একপ্রকার বোঝাপড়া তৈরি করে নেওয়া। কেননা, গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় একজন নারী যদি দাম্পত্য কলহের মধ্য দিয়ে যায়, তবে সেটা তার গর্ভে থাকা সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’ ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে এ বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য প্রদান করেছে। [5] ‘বায়োলজিক্যাল সাইকিয়াট্রি’তে তারা যে গবেষণাটি প্রকাশ করেছে, সেখানে ২৫১ জন প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চার ওপর পর্যবেক্ষণ চালানো হয়। এ পর্যবেক্ষণে তারা বাচ্চাদের মস্তিষ্কের গড়ে ওঠার সাথে মায়েদের গর্ভকালীন মানসিক চাপের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেছে। গবেষণায় তারা এ বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় যেসকল মা খুব বেশি মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তাদের সন্তানদের মস্তিষ্কের ‘হোয়াইট ম্যাটার’ অংশ লক্ষণীয় মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কলহ রোধে যেসকল পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে
- আপনার সন্তানদের যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিন। তাদেরকে নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুন, পিতা-মাতা হিসেবে আপনারা সবসময়ই তাদের পাশে আছেন।
- স্বামী=স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে হবে।
- কোনো বিষয়ে ভিন্নমত তৈরি হলে, শুধুমাত্র ঐ বিশেষ বিষয়টিকে সামনে রেখে আলোচনা করা যেতে পারে। এই আলোচনায় অতীতের কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে টেনে আনা ঠিক হবে না।
- আলোচনার জন্য সময় নির্বাচনে সচেতন হতে হবে। আপনার সারাজীবনের সঙ্গীটি মানসিক চাপে থাকে, এমন কোনো সময় বেছে নেওয়া উচিত হবে না।
- নিজ নিজ মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে হবে। সংকোচ কিংবা অভিমানজনিত কারণে মনের কথাগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পারলে আপনার আপনজনদেরই ক্ষতি হতে পারে সবচাইতে বেশি।
- আলোচ্য বিষয় বস্তুর ধরনের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিন, এই আলোচনাগুলো আপনার সন্তানের সামনে করা ঠিক হবে কি না।
- পরিবারকে সময় দিন। সম্ভব হলেই কিছু সুখস্মৃতি গড়ে তুলুন। একসঙ্গে ঘুরতে যেতে পারেন, কিংবা আয়োজন করতে পারেন ছোটখাটো সারপ্রাইজের। বাড়ি ফেরার সময় কখনও সাথে করে কিছু লজেন্স এনে যদি নিজ হাতে পরিবারের সবার মুখে তুলে দিতে পারেন, বিশ্বাস করুন, সেটি আপনার আপনজনদের জন্য ঐ দিনটির সেরা স্মৃতি হবে।
- মনে রাখতে হবে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা কোনোরকম প্রতিযোগিতার নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতার একটি সম্পর্ক। [6], [7]
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা-মা চাইলে তাদের সংসারকে অসম্ভব সুখী ও সুন্দর একটি সংসার হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। একটি সুন্দর সংসারে বেড়ে ওঠা শিশুরা অবশ্যই সুন্দর ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে সমর্থ হয়। কাজেই আপনার সন্তানের শৈশবকে অনিশ্চয়তা দিয়ে নয়, বরং পূর্ণ করুন ভালোবাসা দিয়ে।
লেখাটির ইতি টানা যেতে পারে ২০১৮ সালের ২৬ জুন ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ দিয়ে। যার শিরোনাম ছিল ‘শুধু মা-বাবাকে একসঙ্গে দেখতে চাই: কাঁদলেন বিচারপতি, আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীরা’। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে ধ্রুব এবং লুব্ধক নামে দুই শিশুর কান্নায় বিচ্ছেদে যেতে চাওয়া মা-বাবাও বলতে বাধ্য হলেন, তারা আবার একসঙ্গে সংসার করতে চান। [8] হ্যাঁ, ঐদিনের আদালতে বেশ নাটকীয় একটি দৃশ্যের অবতারণা হয়। দম্পতির বড় ছেলে ধ্রুব তার বাবা ও মায়ের হাত একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে,
“তোমরা আলাদা হয়ে গেলে কেন? আমরা আর কিছু চাই না। আমরা তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই।”