শিরোনাম পড়ে যদি মনে করে থাকেন ভূতের ভয় জয় করার ব্যাপারে কথা বলছি, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য না। লেখাটি কেবল তাদের জন্য যারা জীবনের নানা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগে থাকেন। যারা বুঝে উঠতে পারেন না জীবনের পরবর্তী ধাপের জন্য কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন কিংবা ভয়ের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও থমকে যান, পেছনে ফিরে আসেন, তাদের জন্য এই লেখাটি। অন্যভাবে বললে, জীবনে দু’ রকমের মানুষ দেখবেন। এক হলো, যারা প্রবল আশাবাদী। কোনো রকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে এদের সময় লাগে না। যেকোনো ব্যাপারে খুব দ্রুত তারা সমাধানে চলে যেতে পারে। আরেক হলো চরম নৈরাশ্যবাদী। এদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে পড়তে হয় চরম বিপাকে। সামনে পা আগাবে, নাকি আগাবে না- এটা ঠিক করতে করতেই তাদের সময় পার হয়ে যায়। ভয়কে তারা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারে না। কেন এই ভয় কাজ করে? এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? চলুন এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে নেয়ার চেষ্টা করা যাক।
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক ‘ভয়’ জিনিসটা কী। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ভয় দুই প্রকার। একটি হলো আমাদের পারিপার্শ্বিক কোনো বিষয়ের প্রতি ভয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাসায় আগুন লেগে যাওয়ার ভয়, চুরি হবার ভয়, রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার ভয় কিংবা কেউ হঠাৎ আক্রমণ করে বসে কি না, সেই ভয়। আবার অজানা কিংবা অলৌকিক কোনো কিছুর প্রতি ভয়ও এর মধ্যে পড়ে। এখানে তো কেবল বিপজ্জনক ঘটনার কথা বলা হয়েছে। আরেকটি ধরন হলো, যেটি এগুলোর মতো কোনোদিক থেকেই বিপজ্জনক না। কিন্তু তবুও বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের ভয় কাজ করে। যেমন ধরুন, পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া, প্রেজেন্টেশনের জন্য সবার সামনে দাঁড়ানো, চাকরির ইন্টারভিউ দেয়া। এই বিষয়গুলো এমন না যে আমাদের অনেক বড় রকমের ক্ষতি করে ফেলবে। কিন্তু তবুও মুহূর্তগুলোকে ঘিরে আমাদের অনেকেরই ভয় কাজ করে। কিন্তু কেন?
মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো অজানাকে ভয় করা। একটি অন্ধকার ঘরের কথা চিন্তা করুন। স্বাভাবিকভাবেই আপনি সেই ঘরে পা ফেলতে ভয় করবেন, কারণ আপনি জানেন না আপনার সামনে কী অপেক্ষা করছে। তাই অজানাকে ভয় করা অস্বাভাবিক কিছু না। আদিম যুগে মানুষের মনে ভয় কাজ করতো শিকার ধরা নিয়ে কিংবা যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে। সেখানে সবসময়ই জীবননাশের ভয় কাজ করতো কিংবা কোনো শারীরিক সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকতো। বর্তমানে সেই ভয় অনেকের মন থেকেই চলে গেলেও জায়গা করে নিয়েছে নতুন ধরনের ভয়- ‘উদ্বেগ’। সিদ্ধান্ত নিতে না পারার পেছনে যে সমস্যাটি মূলত কাজ করে, তা হলো উদ্বেগ। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ থেকে কোনোভাবেই রক্ষা পাওয়া যায় না। তাহলে কী করবেন এ থেকে পরিত্রাণের জন্য? চলুন জেনে নিই কিছু উপায়।
আগে নিজের এবং সমস্যার ব্যাপারে জানুন
আপনার সমস্যা কিংবা ভয়ের মুখোমুখি হবার আগে দু’পাশের অবস্থার ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে রাখা ভালো। উদাহরণ হিসেবে পরীক্ষার কথা ধরে নিলাম। আর এক সপ্তাহ পর আপনার পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু আপনি এখনও পড়ালেখার ধারে-কাছে নেই। এই ভয় আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অথবা আপনার বাসা ভাড়া বাকি আছে প্রায় ৩ মাসের, কিন্তু আপনি কোনোভাবেই বকেয়া টাকা পরিশোধের উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। এরকম ক্ষেত্রে আগে নিজের অবস্থানের ব্যাপারটি পরিষ্কার করা দরকার। আপনার যদি পড়ালেখা করা নিয়ে সমস্যা থাকে, তাহলে কী কী কারণে পড়ালেখা হচ্ছে না সেগুলো নির্ধারণ করুন। বকেয়া ভাড়া পরিশোধের সমস্যা থাকলে আপনার বর্তমানে হাতে কাজ কিংবা অর্থ না থাকার কারণগুলো বের করুন। এরপর সেগুলো সমাধানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। দু’দিকের সমস্যাগুলো নির্ধারণ না করেই সমস্যা সমাধানের আশা করলে সবসময়ই শূন্যের মাঝে ঘুরতে থাকবেন।
আপনার সমস্যাটি নিয়ে কারো সাথে কথা বলুন
অনেকের মনে এই ধারণা থাকে যে, একজনের সমস্যা আরেকজন শুনতে চায় না কিংবা শুনেই বা কী করবে। ব্যাপারটা কিছুটা সত্য হলেও সমস্যা সমাধানের জন্য কারো না কারো সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা দরকার। আপনার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা কোনো আপন আত্মীয় অবশ্যই আছেন, যিনি সময় দিয়ে আপনার কথা শুনবেন। অথবা আপনার মতো এই সমস্যায় আগেও ছিলো, এমন কেউ আপনার পরিচিত আছে কি না, দেখুন। আপনার সমস্যার কথা কেউ না কেউ অবশ্যই শুনবেন এবং এর একটি সমাধান বের করতেও সাহায্য করবেন। তাই সমস্যা নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা করবেন না। কথা বলাটা জরুরি। আপনার যদি পড়ালেখা নিয়ে সমস্যা থাকে, তাহলে দরকারে আপনার কোনো সহপাঠীর সাথে কথা বলে বিষয়টি সমাধানে কাজ করুন। আপনি যদি সমস্যাটা কেবল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে দেন, তাহলে দিন দিন এটি আপনার ভয় আরও বাড়াতে থাকবে। ভয় আপনাকে গ্রাস করে ফেলার আগেই উচিত এর একটি সুন্দর সমাধান খুঁজে বের করা।
নিজের শরীরের দিকে নজর রাখুন
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যখন কোনো বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ভয় কাজ করে, হতাশা তখন আমাদের গ্রাস করে নিতে সময় নেয় না। এসময় নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ঠিক রাখা খুবই জরুরি। আপনার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খান। শাকসবজি এবং ফলমূল বেশি করে খাওয়ার চেষ্টা করুন। চিনি, তেল জাতীয় খাবার এগুলো আপনার শরীরে ব্লাড সুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে, যা উদ্বেগ বা অতিরিক্ত চিন্তা করার অভ্যাস বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত চা, কফি এবং অন্যান্য ক্যাফেইনজাত খাবার বর্জন করাও বাঞ্ছনীয়।
অ্যালকোহলজাত পানীয় এবং সিগারেট ও অন্যান্য মাদক থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন। এগুলো আপনাকে সাময়িকভাবে বর্তমান সমস্যা ভুলে থাকতে সাহায্য করলেও সমস্যা সমাধানের কোনো মাধ্যম এগুলো হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এগুলো আপনার জন্য নতুন সব সমস্যা তৈরির পেছনে কাজ করে। তাই নিজেকে যতটা সম্ভব মাদক থেকে বিরত রাখুন। নিয়মিত ব্যায়াম করাও এক্ষেত্রে অনেকখানি উপকারী।
নিজের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখুন
আপনার সমস্যা সমাধানের পথে অন্যতম একটি নিয়ামক হলো একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখা। আপনি বর্তমান যে অবস্থায় আছেন, সেখান থেকে উন্নতি করে কবের মধ্যে নতুন একটি অবস্থায় নিজেকে দেখতে চান, তা ঠিক করে রাখুন একটি লক্ষ্যমাত্রার মাধ্যমে। এটি আপনার সমস্যা সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে অনেকখানি সাহায্য করবে।
আপনার সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে বেশি দরকার নিজের মাঝে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা। একজন হতাশ এবং একজন আশাবাদী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ দেখা যায়। নিজেকে একজন আশাবাদী হিসেবে গড়ে তুলুন, আত্মবিশ্বাস ধরে রাখুন। কারণ এগুলোই দরকার আপনার ভয় কাটিয়ে ওঠার জন্য।