একজন নারীর সমগ্র জীবনকাল কয়েকটি নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ। এই গণ্ডির ভেতর তাদের জীবনকাল চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। একজন নারী বিয়ে করবে, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে নিজের মাতৃত্বের সূচনা ঘটাবে, একটি সুন্দর জীবনের জন্ম দিবে, তাকে লালন পালন করে বড় করে তুলবে, মা এবং সন্তানের মধ্যকার শক্ত বন্ধন তৈরি করবে, সংসার সামাল দেবে, সবাইকে একা হাতে দেখে-শুনে রাখবে- এই হলো তাদের ছোট্ট জীবনের নিয়মিত জীবনচক্র।
যুগ বদলেছে এবং বেড়েছে নারীদের নিজেদের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। নারীরা এখন বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত। বিজ্ঞানে নারীদের অবদান স্বীকার করে নিতেই হবে। তার সাথে সাথে এখনকার সমাজেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে নারীরা একাডেমিক এবং প্রফেশনাল- দুদিকেই নিজেদের ছাপ রাখতে পারছে। কাজে যোগ দেয়ার পর একজন বিবাহিত নারীকে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে কাজে যোগ দেয়ার পর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে নারীদের আশেপাশের মানুষদের কাছে বিভিন্ন ধরনের কথা শুনতে হয়। এমনকি গর্ভবতী হওয়ার কারণে এমন সব মন্তব্য নারীদেরকে শুনতে হয় যেটার কারণে কাজের প্রতি তাদের অনীহা চলে আসে।
আমরা দেখি, অনেক নারী এখন অনেক ধরনের কাজে যোগ দিচ্ছে। তারা একদিক দিয়ে কাজ করছে আবার নিজের বাচ্চা মানুষ করছে। কাজ করতে করতে অনেকে বাচ্চা সামাল দেয়ার জন্য কাজ ছেড়ে দিচ্ছে, আর কাজে ফিরছে না। আবার অনেকে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই আশপাশ থেকে প্রতিবন্ধকতা পেয়ে কাজে পুনরায় যোগ দেয়ার সাহস করে না।
নারীরা বিভিন্ন পেশায় নিজেদেরকে প্রমাণ করে চলেছে। সব পেশাতেই নারীদেরকে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবে আজকের এই লেখায় আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যখন একজন নারী একাধারে শিক্ষিকা, বিজ্ঞানী এবং নারী হওয়ার দায়িত্ব পালন করে, তখন তাদের কী ধরনের বাঁধা অতিক্রম করতে হয়? সামাজিকভাবে সমানাধিকার আদায় করতে হলে যেকোনো পেশায় নারী-পুরুষের সংখ্যা এবং মর্যাদা সমান হতে হয়। লেখাপড়া এবং শিক্ষা জগতে নারীদের অবস্থান কীরকম সেটাই আজকের আলোচ্য বিষয়।
একাডেমিক জগতে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং গবেষকরূপে যখন একজন নারী কাজ শুরু করে, তখন তার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। এই পেশায় নিযুক্ত সকলকেই কয়েকটি কাজ নিয়মিত করতে হয়। যেমন- ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য লেকচার তৈরি করা, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজ তত্ত্বাবধান করা এবং দিকনির্দেশনা দেয়া, নিজে গবেষণা করা এবং সেগুলো ভালো জার্নালে পাবলিশ করা এবং কনফারেন্সে গিয়ে সবার সামনে তা উপস্থাপন করা, সরকার থেকে গবেষণার জন্য ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং এই ফান্ড যোগাড় করতে গবেষণার বিষয় প্রস্তাবনা করা ও এর উপর একটি সম্পূর্ণ প্রতিবেদন তৈরি করা ইত্যাদি কাজ প্রায় প্রতিদিনই করতে হয়।
একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপরোক্ত কাজগুলো সবসময় করতে হবেই। নাহলে হয় তাদের চাকরি থাকবে না, না হয় প্রমোশন হবে না, চাকরির চুক্তিকাল নবায়ন করা হবে না। তাই একাডেমিক জগতে সব শিক্ষক-শিক্ষিকার উপর এই ধরনের চাপ থাকে। এসবের ভেতর আবার বিভিন্ন জার্নাল বা কনফারেন্স পেপার রিভিউ করতে হয়, সেগুলো আবার সময়মতো উত্তর লিখে পাঠিয়ে দিতে হয়।
একজন নারী যে একইসাথে একজন স্ত্রী এবং মা, তাকে পরিবারের দিক সামলে তার নিজের চাকরির দিক সামাল দিতে হয়। একাডেমিক জগতেও নারীদের অনেক সময় ছোট হওয়ার অপমান স্বীকার করে নিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি শুরু করার পর একজন নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে মাতৃত্বকালীন এবং তার পরবর্তী ছুটির পরিমাণ একদিক দিয়ে কম হয়ে যায়। কারণ চাকরির বিভিন্ন কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে গবেষণা এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণা পর্যালোচনা করা। সে নিজে ছাড়া এই কাজটি অন্য কেউ কিন্তু করে দিতে পারবে না, যেটা কর্পোরেট চাকরির ক্ষেত্রে বা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে করা যেতে পারে। মা হিসেবে যখন একজন নারীর সূচনা হয়, এরপর অনেকটা বছর পর্যন্ত সেই বাচ্চার মাকে তার বাচ্চার দিকে একটু বেশিই সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু দেখা যায়, বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরে একজন শিক্ষিকা তার মা হিসেবে যে দায়িত্ব সেটা পালন করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন।
বিজ্ঞানী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হলে অনেক রকমের দুশ্চিন্তার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। এই দুশ্চিন্তা সদ্যোজাত শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। যেহেতু বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণা একটি মৌলিক বিষয়, তাই এই গবেষণার সাথে যে আরও অনেক শিক্ষার্থী জড়িত তাদের জন্য ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা অনেক বড় চিন্তার বিষয়। আবার এসব শিক্ষার্থীর মাস্টার্স থিসিস, ডক্টরেট থিসিস ও গবেষণাগুলো তদারকি করা এবং এসব থেকে ভালো জার্নালে প্রবন্ধ ছাপানো আরেকটি বড় দুশ্চিন্তা। কারণ দেখা যায়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হচ্ছে মাস্টার্স বা ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে হলে ন্যূনতম দুটি বা তিনটি নিজের থিসিসের উপর প্রবন্ধ কোনো জার্নালে গৃহীত অবস্থায় থাকতে হবে বা পাবলিশ হয়ে যেতে হবে, নাহলে ডিগ্রি দেয়া হবে না। একজন শিক্ষিকার জন্য অবশ্যই এটা একটি দুশ্চিন্তার বিষয়। এসব কারণে একজন নারীর মাতৃসত্ত্বাকে প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
আবার দেখা যায়, সদ্যোজাত শিশুটিকে নিয়ে দূরে কোথাও কোনো বৈজ্ঞানিক কনফারেন্সে গিয়ে প্রবন্ধ পড়তে হচ্ছে। তখন শুরু হতে পারে অন্যরকম সমস্যা। জন্মের পর কয়েক বছর একটি শিশু মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বাঁচে। নিয়মমাফিক এই দায়িত্ব একজন মাকে সবসময় পালন করতে হয়। এরকম কনফারেন্সে গেলে সেখানে যদি লেকটেশন (Lactation) বা বাচ্চাকে স্তন্যদানের কোনো সুযোগ, জায়গা এবং পরিবেশ না থাকে, তাহলে এ ব্যাপারটি একজন নারীর জন্য অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। আবার আগে থেকে আয়োজকদের এই ব্যাপারে জানিয়ে রাখলেও এত অল্প সময়ের কনফারেন্সের জন্য এই আলাদা ব্যবস্থাটুকু তারা করতে চায় না। অনেক সময় সেই নারী গবেষকের কনফারেন্স পেপারও বাতিল করে দিতে পারে। এই ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে সবার থেকে সহযোগিতার প্রয়োজন। তবুও আশার কথা হচ্ছে, এখন অনেক কনফারেন্সের আয়োজকেরা এই ব্যাপারটির কথা মাথায় রেখে লেকটেশনের ব্যবস্থা রাখে।
মেয়েদের গর্ভাবস্থা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। সেখানে মাতৃত্বকালীন সময়ের বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে। এই সময় কর্মজীবী নারীদের কী করা উচিত, কীভাবে চলা উচিত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয় এবং সেগুলো জার্নালে পাবলিশও করা হয়। কিন্তু এসব যখন বাস্তবায়ন করার সময় আসে, তখন সবার মধ্যে একধরনের অমনোযোগিতা লক্ষ্য করা যায়।
সমাজে নারীদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অনেক সময় অবেহেলার শিকার হতে হয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায় তারা অন্যদের তুলনায় লেখাপড়ায় তুলনামূলক ভালো হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি হিসেবে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুপাত এক নয়। মেয়েদের সংখ্যা এখানে অনেক কম। অনেক পুরুষ নারীদেরকে এই ধরনের পেশাতে দেখতে চায় না, আবার অনেক সময় রেজাল্ট বা পাবলিকেশন যত ভালোই হোক না কেন, নারী বলে চাকরিই দিতে চায় না। আবার কোনো গবেষণা প্রবন্ধ ছাপার জন্য কোনো জার্নালে পেপার পাঠালে সেটা গ্রহণ না করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়, যদি লেখক একজন নারী গবেষক হয়।
এখনও এই ধরনের মনমানসিকতার মানুষ পৃথিবীতে বর্তমান। উপরের আলোচনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং একজন বিজ্ঞানী মায়ের জীবন মোটেও সহজ নয়। অনেকে মনে করতে পারে বা বলতে পারে, সংসার করার ইচ্ছা থাকলে এরকম পেশা নির্বাচন করা উচিত নয়, আবার এরকম পেশা নির্বাচন করলে সাংসারিক বা মা হওয়াও উচিত নয়!
মা হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে গর্বের একটি ব্যাপার। একজন পুরুষ সেটা কখনোই পারে না। সাথে সাথে সমাজে মা হিসেবে নিজের মতো করে টিকে থাকতে হলে একটি চাকরিও প্রয়োজন, যাতে আশেপাশের মানুষ নিজের হাতে গড়া সংসারে বাম হাত না দিতে পারে। অন্যদিকে একজন মা যদি একজন ভালো গবেষক এবং শিক্ষিকা হয়, তাহলে সেটা তার জন্য আরও গর্বের বিষয়। সমাজের আর দশটি মেয়ে, যারা নিজেরা ভবিষ্যতে গবেষণা করতে চায়, শিক্ষিকা হতে চায়, বিজ্ঞানী হতে চায়– তাদের জন্য একজন পেশাজীবী বিজ্ঞানী-শিক্ষিকা মা উদাহরণ তৈরি করতে পারেন। এতে সমাজের প্রতিভা যেমন বের হয়ে আসবে, ঠিক তেমনি সমাজের অগ্রসরতাও বৃদ্ধি পাবে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: Scientific american@Thanasis Zovoilis Getty Images