অামরা অামাদের প্রাত্যহিক জীবনে পথ চলতে কতই না চাহিদা অনুভব করি। এর মধ্যে কিছু চাহিদা পূরণ হয়, কিছু পূরণ হয় না। কিন্তু অামরা কখনো ভেবে দেখেছি কি, অামাদের জীবনে এই চাহিদাগুলো কতটা গুরুত্ব রাখে? অার এর মধ্যে কোন চাহিদাগুলো পূরণ না হলেই নয়?
উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে অামাদের পরিচিত হতে হবে একটি নতুন ধারণার সাথে। সেটি হলো ‘মসলোর চাহিদার পিরামিড কাঠামো’।
চাহিদার পিরামিড কাঠামো
চাহিদার পিরামিড কাঠামো তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন মনোবিদ অাব্রাহাম মসলো, যাকে অভিহিত করা হয় মানবিক মনোবিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে। বলা হয়, মসলো মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে গোটা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
তার মতে, একজন মানুষকে তার জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কোনো না কোনোভাবে পাঁচটি চাহিদা স্তর অতিক্রম করে যেতে হয়। একটি স্তরের চাহিদা পূরণ না করে পরবর্তী স্তরে উন্নীত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এবং এই চাহিদাগুলো যথাযথভাবে পূরণ হলেই সে মানুষ হিসেবে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে অধিষ্ঠিত হতে পারে।
মসলো এই চাহিদাগুলোকে একটি পিরামিড মডেলে কাঠামোবদ্ধ করে একে দুটি ভাগে ভাগ করেন।
১. ডেফিসিয়েন্সি চাহিদা, যেগুলো মসলোর পিরামিড মডেলের প্রথম তিন স্তারে স্থান পেয়েছে।
২. বিয়িং চাহিদা, এসব চাহিদাকে মসলো তার পিরামিডের উঁচু দুটি স্তরে রেখেছেন।
প্রেক্ষাপট
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, সভ্যতার অাদিকাল থেকে মনোবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ছিলো বিভিন্ন মানসিক বিকার, বৈকল্য এবং অসুস্থতার মতো নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর অালোকপাত করে যাওয়া। তাই মনোবিজ্ঞানকে অভিহিত করা হতো নৈরাশ্যবাদী মানুষদের চিন্তার খোরাক হিসেবে।
কিন্ত মসলো ছিলেন অন্য সবার থেকে অালাদা। তিনি তার গবেষণার অংশ হিসেবে কিছু সফল ব্যক্তিত্ব, যেমন- অ্যালবার্ট অাইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধীর মতো সফল ব্যক্তিদের জীবন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেন। কীভাবে এসব মানুষ খুবই সাধারণ অবস্থা থেকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছালেন, সেটিই ছিলো তার অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু।
মসলোর এই গবেষণার ফলাফল ১৯৫৪ সালে তার ‘মোটিভেশন অ্যান্ড পারসোনালিটি‘ গ্রন্থে স্থান পায়। এরপর থেকেই এই তত্ত্বটি মসলোর পিরামিড নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
মসলোর পাঁচটি চাহিদা স্তর:
১. জৈবিক চাহিদা (Physiological needs)
মসলোর চাহিদা পিরামিডের সবার নিচে রয়েছে জৈবিক চাহিদা, যাকে অামরা শারীরিক চাহিদাও বলতে পারি। এই জৈবিক চাহিদাগুলো সকল মানবিক চাহিদার মধ্যে সবচেয়ে অত্যাবশকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। একে অগ্রাহ্য করা খুবই কঠিন। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার পর শ্বাসপ্রক্রিয়ার সাহায্যে অক্সিজেনের চাহিদা পূরণের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় মানুষের এই জৈবিক চাহিদার চক্র, যার সমাপ্তি ঘটে কেবল মৃত্যুর মাধ্যমে। খাদ্যগ্রহণ, ঘুমানো, তাপমাত্রার সাম্যাবস্থা রক্ষার (হোমিওস্ট্যাসিস) মতো প্রক্রিয়াগুলো এই চাহিদার ভেতরে পড়ে।
এই চাহিদাগুলো অামাদের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা একটি গল্পের মাধ্যমে কল্পনা করতে বেশ সুবিধা হবে। ধরা যাক, অামাদের গল্পের প্রধান চরিত্র একটি সাত বছরের ছেলে, যার নাম সজীব।
তো, কোনো এক সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সজীব টের পেলো, তার প্রচন্ড পানির পিপাসা লেগেছে, সেই সাথে ক্ষিধেও। কিছুক্ষণ পরই সজীবের মা তাকে নাশতা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। সে নাশতার টেবিলে গিয়ে খাওয়াদাওয়া সারলো। এভাবেই তার জৈবিক চাহিদা, অর্থাৎ ক্ষুধা ও তৃষ্ণার চাহিদা পূরণ হলো।
২. নিরাপত্তা চাহিদা (Safety needs)
এই চাহিদার ভেতরে পড়ে:
- ব্যক্তিগত নিরাপত্তা
- অার্থিক নিরাপত্তা
- স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা
- দুর্যোগ এবং অাপদকালীন নিরাপত্তা
অাবার গল্পের সেই সজীবের কথাই ধরা যাক। সে তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তারা যে এলাকায় থাকে সেখানকার রাস্তাগুলোয় প্রতিদিন কোনো না কোনো মারামারি লেগেই থাকে। তাই সজীব বাইরে গেলে তার নিরাপত্তা নিয়ে বাবা-মা উদ্বিগ্ন থাকেন। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার পরিবার বাসা বদল করলো। এভাবে সজীবের নিরাপত্তা চাহিদাটিও পূরণ হয়ে গেলো।
৩. সামাজিক চাহিদা (Social Needs)
মসলোর পিরামিডের এই স্তরে রয়েছে অামাদের চারপাশের মানুষদের সাথে অামাদের সম্পর্ক। হতে পারে তা পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব, প্রণয় কিংবা দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসা। মানবজীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার অন্যতম প্রধান জ্বালানী হলো সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি, যা অামরা অামাদের বন্ধুবান্ধব, সঙ্গী, পরিবার কিংবা সমাজের মাধ্যমে পেয়ে থাকি। এই চাহিদাটি পূরণের মাধ্যমে মানুষ জীবনে চলার পথে অনুপ্রেরণা পায়, যা তাকে পরবর্তী স্তরগুলোতে উন্নীত করতে সহায়তা করে।
অামাদের গল্পের সজীব নতুন বাসায় চলে অাসার পর একাকীত্বে ভুগতে অারম্ভ করলো। অবসর সময় কাটাতে সে এলাকার ক্রিকেট দলে যোগ দিলো। সেখানে গিয়ে সে নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হলো, যাদের মধ্যে কয়েকজন তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করলো। এভাবেই নতুন পরিবেশকে অাপন করে নেয়ার মাধ্যমে সজীবের একাকীত্ব ও অনিরাপত্তাবোধ দূর হলো।
৪. অহং এর চাহিদা (Esteem needs)
মসলোর মতে, প্রত্যেক মানুষেরই মনের গহীনে অন্যের কাছ থেকে স্বীকৃতি এবং মর্যাদা পাবার চিরায়ত কামনা অবদমিত থাকে। যখন কোনো ব্যক্তি তার চারপাশ থেকে ভরসা, প্রশংসা, সম্মান কিংবা স্বীকৃতি পান, তখন তার অহং বা ইগো পরিতৃপ্ত হয়। এটিই ইস্টিম চাহিদা। এটি যথাযথভাবে পূরণ না হলে ব্যক্তি হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করে, যা তার ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের উত্তরোত্তর উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি ব্যক্তির মনে অাত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়, যা ব্যক্তিত্ব সংকটেও রূপ নিতে পারে।
অামাদের গল্পের সজীব যখন তার প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে গেল, তখন তার মনে একটাই চিন্তা কাজ করছিলো। তা হলো, সে যদি খারাপ খেলে তবে তার দলের অন্যরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু যখন সে ভালো খেললো, তখন দলের অন্যদের প্রশংসা করলো, যার ফলে সে মানসিক প্রশান্তি ও অাত্মবিশ্বাস লাভ করলো। এভাবে তার অহং বা ইগো সন্তুষ্ট হলো।
৫. অাত্ম-মূল্যায়নের চাহিদা (Self-actualization needs)
মসলোর পিরামিডের সবার উপরের স্তরে রয়েছে অাত্ম-মূল্যায়ন। শব্দটি শুনতে বেশ সহজ শোনালেও এর ধারণাটি বেশ কঠিন। মূলত একজন মানুষের জীবনোদ্দেশ্য, অাত্মচরিত চিত্রায়ন, নিজের সামষ্টিক সামর্থ্য সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ উপলব্ধি এই গুণগুলোর মিশেলেই গড়ে উঠেছে অাত্ম-মূল্যায়নের ধারণা।
মানুষ হিসেবে অামরা যেমন একে অপরের থেকে অালাদা; তেমনি অামাদের রুচিবোধ, পছন্দ-অপছন্দও অন্যদের থেকে অালাদা। ব্যক্তিত্বের এই বৈচিত্র্যের কারণে একেকজন ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং স্বপ্নও অন্য সবার থেকে অালাদা। সেই সাথে প্রতিটি মানুষের অাত্মতৃপ্তিবোধ এবং সন্তুষ্টির জায়গাও ভিন্ন। এ কারণেই দেখা যায়, কেউ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ছয় অঙ্কের বেতনে চাকরি করেও হতাশাবোধ ও অপ্রাপ্তির বেদনায় ভোগে, অন্যদিকে কেউ গ্রামের কোনো এক নিভৃত পল্লীতে নামমাত্র বেতনে বাচ্চাদের পড়ালেখা শিখিয়ে অানন্দ পায়।
অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তিই চায় নিজের যোগ্যতা ও অাকাঙ্খার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন এক অবস্থানে থাকতে, যা তার মানসিক প্রশান্তি এবং সন্তুষ্টির কারণ হবে। এই চিন্তাটি সহজাত প্রবৃত্তির অংশ হিসেবে সবার মধ্যেই প্রোথিত থাকে।
মসলোর মতে, প্রতিটি মানুষই পৃথিবীতে কিছু সার্বজনীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলে। যেমন, কেনই বা সে এই পৃথিবীতে অাবির্ভূত হলো? পৃথিবীতে তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী? তার পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা কতটুকু? একজন মানুষ হিসেবে তার মধ্যে কতটুকু সম্ভাবনা লুকিয়ে অাছে? মানুষের যখন মনে হয় সে এই প্রশ্নের উত্তরগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছে, তখনই সে চূড়ান্তভাবে প্রশান্তি লাভ করে। এটিই হলো নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারার অর্থ।
যেমন অামাদের গল্পের সজীব ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতো একদিন সে ভালো ক্রিকেটার হবে। তাই সে ভালোভাবে অনুশীলন করতে শুরু করলো। একসময় বড় হয়ে নামকরা ক্রিকেটার হিসেবে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলো। সে বুঝতে পারলো তার প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগই তাকে এই সাফল্য এনে দিয়েছে এবং তার মধ্যে যে অমিত সম্ভাবনা ছিলো, ক্রিকেটার হওয়ার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও তা পরিস্ফুটিত হয়েছে। এভাবেই সে অাত্মমূল্যায়নের স্তরে পদার্পণ করলো।
মূল্যায়ন ও সমালোচনা
মসলো বর্ণিত বিভিন্ন চাহিদা, যেমন: শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য, নিরাপত্তা পরিমাপযোগ্য হলেও অাত্মবিশ্বাস, মননশীলতার মতো বিষয়গুলো বিমূর্ত ধারণা হওয়ায় এগুলোকে কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি দ্বারা পরিমাপ করা সম্ভবপর নয়। কিন্তু বিজ্ঞান চায় যুক্তি, তথ্য অার অকাট্য প্রমাণ। তাই মসলোর পিরামিডের এই অংশটি প্রথাগত বিজ্ঞান দ্বারা ব্যাখা করা যায় না।
একজন প্রচন্ড অাশাবাদী তাত্ত্বিক হওয়ায় মসলো মনে করতেন, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে সৎ পথে পরিচালিত করে থাকে। তার মতে, মানুষ তখনই ইতিবাচকতার পথ থেকে সরে অাসে, যখন সে কোনো বাধার সম্মুখীন হয় কিংবা কোনো উদ্বেগ বা যন্ত্রণায় ভোগে। কিন্তু হবস বা ম্যাকিয়াভেলির দর্শন এই যুক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করে।
বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও মসলোর পিরামিড মডেল দেখতে অাকর্ষণীয়, সহজবোধ্য এবং বাস্তবসম্মত হওয়ায় বিপনন, শিক্ষা এবং ব্যক্তি উন্নয়নে এই মডেলের বহুল ব্যবহার দেখা যায়।