![](https://assets.roar.media/assets/Hl7bew10hdG0a2ob_180117-time-restricted-diet-se-1212p_4cfc42adb7b6acd84c5d55a245f0b4e9-1024x683.jpg?w=1200)
এই পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসে? নিজেকে। নিজের সাথে জড়িয়ে ভালোবাসে পরিবার-পরিজন, আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবকে। নিজের জন্যই চায় টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ, সম্মান। কিন্তু এসব কিছুর ওপরে প্রত্যেকটি মানুষই নিজের জন্য সবচেয়ে বেশি চায় সুস্বাস্থ্য, কেননা প্রকৃতপক্ষেই মানবজীবনে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।
শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষকে অর্থ-সম্পদ, সম্মান কিছুই সুখী করতে পারে না, এমনকি কখনো কখনো নিরুপায় হয়ে পড়ে আপনজনেরাও। এজন্যই তো চিরকাল মানুষের সুন্দর জীবনের জন্য প্রথম আকাঙ্ক্ষা থাকে সুস্বাস্থ্যের। সুখী জীবনের জন্য সুঠাম দেহের বিকল্প আর কী-ই হতে পারে? অনেক আগে থেকেই মানুষ সুঠাম দেহের স্বপ্ন দেখে আসছে। এই সুঠাম দেহের প্রথম ও চরম শত্রু মেদ। শরীরের মেদ বা চর্বি যে কেবল দেহের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয় তা-ই নয়, বরং বয়ে আনে নানা রোগ ও অসুবিধা।
স্থূলকায় ব্যক্তি যেমন নিজের জীবনযাপন ও চলাফেরায় প্রতিনিয়ত নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়, তেমনই ডায়াবেটিস, রক্ত চাপের অসামঞ্জস্যতা ও হৃদরোগের মতো ঘাতক ব্যাধি সেসব ব্যক্তির দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের সামনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় অতি অল্প বয়সেই। এমনকি এর কুফল এত বেশি যে তা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মেও ছড়িয়ে যেতে থাকে। তবে আশার কথা এই যে, সর্বস্তরের সাধারণ মানুষই এখন মেদজনিত স্থূলাকৃতি ও এর ফলাফলের ব্যাপারে খুব দ্রুতই সচেতন হচ্ছে।
![](https://assets.roar.media/assets/yi73Mbc80uBA3JSx_file82397257_2paqpewq.dmv.jpg)
মানুষকে এখন দেখা যায় মেদ কমাতে পরিমিত খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সচেতন হতে। অপরিমিত ফাস্ট ফুড গ্রহণের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও তারা জানে। চিকিৎসকরা এখন ত্রিশ বছর বয়সের পর থেকে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে উৎসাহিত করেন। খাবারের এসব দিক খেয়াল রাখার সাথে সাথে খাবার গ্রহণের সময়ও মানুষের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কতটা ভূমিকা রাখে তা নিয়েও মানুষের মনে এখন প্রশ্ন উঠেছে। দিনে ঠিক কতবার খাবার গ্রহণ করা উচিত, প্রত্যেক বেলা গড়ে কী পরিমাণ খাবার গ্রহণ করা ভালো কিংবা সকাল ও রাতের খাবারের বৈশিষ্ট্যগত ও পরিমাণগত পার্থক্য ঠিক কেমন হওয়া উচিত- এগুলো সবই আজকের স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের জিজ্ঞাসার ক্ষেত্র। তাই আমাদের সচেতন পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই আজকের এই লেখাটি আমরা সাজিয়েছি।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো- তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অল্প বয়সে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা সারা পৃথিবীতেই এখন বেশি। তাই এই প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে- তবে কি অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড গ্রহণের সাথে সাথে রাত জেগে পড়াশোনা-খাওয়াদাওয়া-সিনেমা দেখার যে সংস্কৃতি এখন গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী, তা-ই এই মুটিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করছে? পাশাপাশি অনির্দিষ্ট নিয়মে যখন-তখন খাবার গ্রহণ তো আছেই। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত হলো, তারা মনে করেন, যারা ওজন কমাতে চায় এবং সকালে ভারী নাস্তা গ্রহণ করে, তারা প্রায় আড়াই গুণ দ্রুত মেদ ঝরিয়ে ফেলে তাদের থেকে যারা এ ব্যাপারে আগ্রহী কিন্তু সকালে কম ও রাতে বেশি খায়।
এমনকি এই অনুপাত একই থাকে যদিও তারা উভয়ই শেষমেশ দৈনিক সমপরিমাণ খাবার খায়। সকালের ও রাতের খাবারের তারতম্যের এই প্রভাবের পেছনে কারণগুলো খুঁজলে দেখা যায়, শরীরের মেদক্ষয় তখনই হয় যখন আমাদের পাকস্থলী শূন্য থাকে এবং জ্বালানির জন্য চর্বিক্ষয়ের প্রয়োজন হয়। রাতের চেয়ে সকালে খাবার হজম করতে দেহের অনেক বেশি শক্তিক্ষয়ের প্রয়োজন হয়, ফলে দ্রুত জ্বালানি শেষ হয়। সেই সাথে রাতে বিশ্রামের কারণে খাবার দ্রুত হজমের সুযোগ কম থাকে বলে শরীরের বাড়তি চর্বির ক্ষয় হয় না বললেই চলে।
![](https://assets.roar.media/assets/KK3Ulbh6B3vfZ6Li_Over-Eating-Lead-to-Obesity.jpg)
বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের পূর্বে মানুষের রাত্রি জাগরণের অভ্যাস তেমন ছিল না। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে বদলেছে মানুষের অভ্যাস ও জীবন। তবে চীনারা কিন্তু চিরকালই খাবার গ্রহণের সময়টা খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই তারা মনে করতো, মানুষের খাবার গ্রহণ প্রক্রিয়া সূর্যের পরিভ্রমণ প্রক্রিয়ারই অনুরুপ হওয়া উচিত। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সূর্যের তাপ থাকে সবচেয়ে বেশি, দিন শেষের দিকে যেতে থাকলে কমতে থাকে তাপ। তাই সকালে সবচেয়ে পুষ্টিকর ও রাতের খাবার সামান্য রেখে তারা খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করে। ক্যালিফোর্নিয়া সাল্ক ইনস্টিটিউশনের গবেষক শচীন পাণ্ডের করা পরিসংখ্যান দেখায় যে, আমেরিকাতে দিনের এক-তৃতীয়াংশের অধিক খাবার কেবল সন্ধ্যার পর থেকে গ্রহণ করা হয়। তাদের মধ্যে অতিদ্রুত মুটিয়ে যাবার প্রবণতার জন্য এই অভ্যাস অবশ্যই দায়ী।
![](https://assets.roar.media/assets/vsELbq8sFZbrTqXP_ext.jpg)
আমাদের শরীর প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে নিজের মধ্যেই সময়ের ছন্দ মিলিয়ে চলে। তাই দিনের আলোতে মস্তিষ্ক চোখে আলোতে সাড়াদানকারী যে নির্দেশনা পাঠায় রাতে তা পাঠায় না। শরীরের স্বাভাবিক ছন্দের পতন ঘটলে তাই এলোমেলো হতে পারে আরো অনেক হিসাব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অধিক রাতজাগা ও অপর্যাপ্ত ঘুম দেহে লেপ্টিন ও গ্রেলিনের মতো ক্ষুধা উদ্রেককারী হরমোনের অসামঞ্জস্যতা তৈরি করে আমাদের স্থূলতার দিকে ঠেলে দেয়। আবার অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত ঘুম শরীরের খাবার হজম প্রক্রিয়ার সামনেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
লন্ডনের কিংস কলেজের পুষ্টিবিদ জেরডা পট এ বিষয়টি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে এ প্রসঙ্গে হেসে বলেন, “আমাদের দাদী-নানীদের নিয়মানুযায়ী জীবনধারণই তাদের নব্বইয়ের বেশি বয়সী সুস্থ জীবনের আসল রহস্য ছিলো।” ব্যাখ্যা করতে তিনি বলেন, সকালে শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোনের কার্যক্ষমতা বেশি থাকে বলে খাবারের গ্লুকোজ শরীরের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হলেও রাতে এই হরমোন ততোটা কার্যকর থাকে না। তাই খাবারের গ্লুকোজ রক্তে বজায় থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়ায়।
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো জরুরি, তেমনি জরুরি সঠিক সময়ে মধ্যে সকালের নাস্তা গ্রহণ। পান্ডে ও তার সহকর্মীরা ২০১২ সালে দু’দল ইঁদুরের ওপর পরিচালিত এক পরীক্ষায় দেখান, দিনে অধিক ও রাতে অল্প খাবার গ্রহণ কেবল স্থূলতা নয়, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, যকৃতের রোগের মতো অনেক প্রাণঘাতী রোগ থেকেই মুক্তি এনে দিতে পারে। আবার দিনে শর্করা ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে ওজনের যে বৃদ্ধি হয়, তার থেকে প্রায় আড়াই থেকে তিনগুন বেশি বৃদ্ধি হয় রাতে সেই একই খাবারগুলো গ্রহণ করলে।
সৃষ্টিকর্তা দিনকে শ্রম ও রাতকে বিশ্রামের জন্য তৈরি করেছেন, আর তাতেই যে আছে মানুষের প্রকৃত কল্যাণ তা আজ আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে প্রমাণিত। কেবল ওজন কমানো নয়, সার্বিক সুন্দর জীবনের জন্যই প্রয়োজন আমাদের খাদ্যাভাস নির্বাচনে সচেতনতা ও সতর্কতা। সকালে রাজার মতো আর রাতে ভিখারির মতো আহার গ্রহণ আমাদের জীবনকে রাজকীয় করুক বা না করুক, স্বাস্থ্যকে ছন্দপূর্ণ করতে অবশ্যই কাজে আসবে। তাই ওজন কমানো নিয়ে যারা ভাবছেন, সতর্কতার সাথে খাবার তালিকা নির্ধারণের সাথে সাথে সচেতনতার সাথে বেছে নিন উপর্যুক্ত খাবারের সময়টিও।