জাগতিক সব ব্যস্ততাকে বিদায় জানিয়ে সব হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দিনশেষে মানুষ বাড়িতেই ফিরে আসে। কারণ মোটকথা নিজের বাড়িই হচ্ছে সবচেয়ে শান্তির জায়গা। আশ্রয়ের আর আরামের জায়গা। এজন্য প্রিয় এই বাড়িকে সুরক্ষিত করার চেষ্টার কোনো কমতি থাকে না। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই চায় বাসা-বাড়ি নিরাপদ হোক। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ তার সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুরক্ষিত বাড়িটাই নির্মাণ করতে চেয়েছে। বলা বাহুল্য, আমেরিকান প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউস থেকে শুরু করে ব্রিটিশ রানীর বাকিংহাম প্যালেস এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বাড়ির বিবরণের পাশাপাশি হাল আমলের সেলেব্রেটি কিম কারদাশিয়ানের বাড়ির টপক্লাস সিকিউরিটি সিস্টেমও আপনাকে নিশ্চিতভাবে শিহরিত করবেই।
সেইফ হাউস
বলা যায় পোল্যান্ডের এই বাড়িটা দুনিয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত বাড়িগুলোর একটি। ‘সেইফ হাউস‘ নামে এ বাড়ির মালিক তৈরির আগে স্থপতিকে জানান সর্বোচ্চ নিরাপদ এবং সুরক্ষিত বাড়ি চান তিনি। বাড়ির মালিকের এ দাবি থেকেই সত্যিকারের সেইফ হাউস (নিরাপদ বাড়ি) নির্মাণ করেন স্থপতি রবার্ট কনিকজনি। দেখতে নেহায়েৎ বিলাসবহুল বাড়ি হলে আদতে বাংকারের মতো এ বাড়িতে রয়েছে সুইমিং পুল, যেখানে আপনি ইচ্ছামতো ব্যাকস্ট্রোক সাঁতার কাটতে পারবেন জম্বির হাতছোঁয়া দূরত্বে। বাড়িটিতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ির ব্যবস্থা, যাতে করে আপনি অনায়েসেই আপনার বাড়ির ছাদে চলে যেতে পারবেন। তাছাড়া যেকোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত অনুপ্রবেশ ঠেকানোর মতো সবধরনের ব্যবস্থাও অাছে এ বাড়িতে। নামে যেমন সেইফ; কাজেও শতভাগ সেইফ এ বাড়ি।
এসবালভার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট
নরওয়ের স্পিডবারগেন দ্বীপের এই বাড়িটি মূলত একটি বীজ সংরক্ষণাগার। এখানে কোনো মানুষ বাস করে না। প্রতিটি ব্যাগে ৫০০ করে বীজ নিয়ে ৪.৫ মিলিয়ন নমুনা বীজ আছে- এ বাড়িতে। এজন্যই এ বাড়িকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত বীজ সংরক্ষণাগার হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দিলে এই সংরক্ষণাগারে রাখা বীজ দিয়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। এই সংরক্ষণাগারে মানুষ না থাকার অন্যতম কারণ হলো এখানে মাইনাস ১৮ ডিগ্রিতে বীজ সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া অক্সিজেনের সরবরাহও নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে বীজগুলো তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে না যায়। এ বীজ বাড়ির যারা রক্ষণাবেক্ষণ করেন, তারা পাশেই থাকেন অনেকটা আর্কটিক দীপপুঞ্জের পরিবেশে।
ফেয়ারফিল্ড স্টেট
আমেরিকান ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারী ইরা রেনার্ট হলেন নিউইয়র্কের অ্যা ফেয়ারফিল্ড স্টেটের মালিক। ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় হওয়া এ বাড়িটি আমেরিকার সবচেয়ে বেশি দামি বাড়িগুলোরও একটি। কোনো অনুপ্রবেশকারী যাতে এ বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে না পারে সেজন্য সবধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেন রেনার্ট। চুরি করা দূরে থাক, এ বাড়িতে বিনা আমন্ত্রণে প্রবেশ করা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। এই বাড়ির ২১টি শোবার কক্ষ বুলেট প্রুফ এবং প্রবেশের একমাত্র দরজায় ২৪/৭ নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রহরায় থাকেন। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকার জাদুঘরগুলোর চেয়ে এ বাড়িতে সিসি টিভির সংখ্যা অনেক বেশি।
বিল গেটস’ হোম
ওয়াশিংটনের মেদিনায় উঁচু ভবন থেকে তাকালে গাছের ফাঁক দিয়ে যে বাড়িটি সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেটিই বিল গেটসের বাড়ি। ‘জানাডু ২.০’ নামে এ বাড়ি নির্মাণে খরচ পড়েছে ৬৩ মিলিয়ন ডলার এবং সময় লেগেছে ৭ বছর। বাড়িতে অতিথি আসলে তাকে বিশেষ একটি পিন দেওয়া হয়। এ পিন অতিথির প্রয়োজন অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। অতিথির একান্ত রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী সবধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা হয় এ বাড়িতে। এ বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতই উন্নত যে, এক মাইল দূরে অবস্থান করা অনাকাঙ্খিত অনুপ্রবেশকারীর অবস্থানও বলে দেয়। বাড়ির অবস্থানের কারণেই পাপারাজ্জিদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গাছ-গাছালির মাঝে বসে ওয়াশিংটন হ্রদের সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারেন গেটস পরিবারের সদস্যরা।
ম্যাক্সিম্যাম সিকিউরিটি ম্যানশন
আমেরিকার কলোরাডোর ‘ম্যাক্সিম্যাম সিকিউরিটি ম্যানশন’ বাড়িটি দেখলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বিউটি এন্ড বিস্ট চলচ্চিত্রের বাড়ি, আসল বাড়ি নয়। তবে সত্যটি হলো, এ বাড়ি নামের মতোই সুরক্ষিত এবং নিরাপদ বাড়ি। এ বাড়ি হাতেগোনা কয়েকটি সবচেয়ে নিরাপদ বাড়ির মধ্যে অন্যতম। শুধু নিরাপত্তার জন্যই বাড়ির মালিক ৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। বাড়ির নিরাপত্তা বাহিনীর অনুমতি নিয়ে আইফোন দিয়ে লগ ইন করে সিসিটিভি দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে পারবে। এইটা অদ্ভুত মনে হলেও এটা সত্য। যে কেউ এ বাড়িতে ঢুকে পড়লে বের হওয়া তার জন্য বেশ কঠিনই বলা চলে।
কারদাশিয়ান স্টেট
কারদাশিয়ান পরিবার আজকের দুনিয়ার বিনোদন জগতের সবচেয়ে আলোচিত পরিবার। সঙ্গত কারণেই তাদের জন্য একটি সুরক্ষিত বাড়ি থাকা স্বাভাবিকই। অত্যাধুনিক নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা এ বসতভিটায় কারদাশিয়ান পরিবার ছাড়া অন্যদের প্রবেশে বেশ ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। পাপারাজ্জিদের ক্যামেরা থেকে বাঁচতে কিম কারদাশিয়ান বাড়ির আঙিনাতেও বিশেষ গাড়িবহর ব্যবহার করেন। তাছাড়া এ বাড়ির সদস্যদের বডিগার্ড নিয়োগ দেয়ার সময় আবেদনকারী ব্যক্তির ব্যাকগ্রাউন্ড চেকসহ কঠিন প্রশিক্ষণ দিয়ে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়।
দ্য করবি ফ্যামিলি ম্যানশন
আল করবি কাজ করতেন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং সিনিয়র ডিজাইনার হিসেবেই কাজ করতেন তিনি। তার বাড়ি ‘দ্য করবি ফ্যামিলি ম্যানশন’-এর বিশেষ গুণ হলো এটি ভূমিকম্প প্রতিরোধে সহায়ক কারণ এ বাড়ি মাটির ৩০ ফুট গভীরে শেকড় গেড়ে আছে। ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের এ বাড়িতে বিশেষ এক কক্ষ রয়েছে, যা দিয়ে নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য হুমকিকে সহজেই নির্ণয় করা যায়।
দ্য হোয়াইট হাউস
সবচেয়ে সুরক্ষিত বাড়ির তালিকা করলে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্টের বাড়ি অবশ্যই থাকবে। দর্শনার্থীদের জন্য আমেরিকার হোয়াইট হাউস সবসময় আকাঙ্খিত হলেও এ বাড়ির নিরাপত্তা সবসময় টপক্লাস। ১৩শ জন কর্মচারী সপ্তাহে ৭ দিন, দিন-রাত ২৪ ঘন্টা এ বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছেন। এছাড়া বাড়ির ছাদে সবসময় সোয়াট টিম নিয়োজিত থাকে। ৬ তলা ভবনের সবার নিচতলায় আছে ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার। অপ্রত্যাশিত হামলার সময় আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে নিরাপদে এ ভবন ত্যাগ করারও সুব্যবস্থা আছে।
বাকিংহাম প্যালেস
সবচেয়ে সুরক্ষিত বাসভবনের নাম বলা হবে কিন্তু ব্রিটেনের রানীর বাসভবন বাকিংহাম প্যালেস থাকবে না, সেটা তো অকল্পনীয়। পুলিশ ছাড়াও ব্রিটেনের সেনাবাহিনীও এ ভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। ৭৭৫টি কক্ষ এবং ৭০০ জানালা সমৃদ্ধ রানীর এ বাসভবনকে লন্ডনের সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বাসভবন বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ব্রিটেন সরকারের পক্ষ থেকে বাকিংহাম প্যালেসের সুরক্ষার জন্য আলাদা বাজেটও আছে।
রিয়ংসিয়ং রেসিডেন্স
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নেতা উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন। তার বাড়িটাও আলোচনায় কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। তার বাসভবনের নাম রিয়ংসং। অন্য নাম রেসিডেন্স নং -৫৫। তার বাড়ি এতই সুরক্ষিত যে এই বাড়ির সুষ্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ একটি ছবি পাওয়াও দুষ্কর। গুগল আর্থের ছবি দেখেই বোঝা যায় কতটা লোকচক্ষুর অন্তরালে এই বাড়ি। কিম জং উন নিজেই নিশ্চিত করেন তার বাড়ির চারপাশে বৈদ্যুতিক তার রয়েছে। বাড়ির সুরক্ষায় সুসজ্জিত বাহিনীর পাশাপাশি মাইন ফিল্ডও রয়েছে, যা যেকোনো অনাকাঙ্খিত আগন্তুককে বিপদে ফেলবে। এছাড়া মাটির ভেতরে যে টানেল আছে তা দিয়ে সহজেই নিরাপদ স্থানগুলোতে চলে যাওয়া যাবে। এই বাড়ির দেয়ালে বিশেষ কনক্রিট এমনভাবে দেয়া, যা রীতিমতো পারমাণবিক বোমার গতিপথ পাল্টে দিতে সক্ষম। এছাড়া অন্য নিরাপত্তা এবং ক্যামেরা তো অনুমিতভাবে আছেই।
ফিচার ইমেজ: Google Earth