শুরুতেই একটি পরিস্থিতির কথা তুলে ধরি। ধরুন, আপনি বাসায় বসে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম চালাচ্ছেন। এমন সময় দেখলেন, আপনার পরিচিত কয়েকজন বন্ধু কোথাও ঘুরতে গিয়েছে আর সেই ছবিগুলো ফেসবুকে বা ইন্সটাগ্রামে দিয়ে দিয়েছে। আপনার তখন কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই মনে হবে যে, ইশ্, আমিও যদি যেতে পারতাম তাদের সাথে! অথবা তারা আমাকে না জানিয়ে ঘুরতে গেলো! এমনটা আমাদের সবার সাথেই কম-বেশি হয়েছে। এমন হতেই পারে যে, আপনি কোনো এক ব্যস্ততার জন্য আপনার বন্ধুদের সাথে সময় দিতে পারেননি। কিন্তু তারপরও আমাদের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করে। নিজেকে একা একা মনে হয়। এর নামই হলো একাকিত্ব।
এখানে তো কেবল একটি উদাহরণ দেখালাম। এমনও হতে পারে যে, সম্প্রতি আপনার প্রিয়জনের সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে কিংবা আপনি আপনার পরিবার-প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরে কোথাও একা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তখনও এই একাকিত্বের অনুভূতিটা চলে আসে। আজকে আসুন এই একাকিত্ব সামলানোর কিছু উপায় নিয়েই আলোচনা হয়ে যাক।
শুরুতেই বলে রাখা উচিত, একাকিত্ব অনুভূত হওয়া আর একা একা থাকা কিন্তু এক জিনিস নয়। আপনার বেশ ভালো কয়েকজন বন্ধু আছে, আপনি একটি গোষ্ঠীর সাথে থাকেন। কিন্তু তারপরও আপনার মনে একাকিত্ব আসতে পারে। কারণ হয়তো আপনার সবার সাথে সম্পর্ক এতটা ঘনিষ্ঠ না। আবার এমন ঘটনাও হতে পারে যে, আপনাকে সবসময় একা একা দেখা যায়। আপনি পরিবার থেকে অনেক দূরে থাকেন ঠিকই, কিন্তু আপনি আপনার পরিবারের সাথে প্রতিদিন কথা বলে অনেক ভালো সময় কাটান। আপনার মনের হাসি-কান্নার কথা প্রকাশ করার মতো লোক হয়তো আপনার পাশেই আছে। এখানে আপনি একাকিত্ব অনুভব নাও করতে পারেন। অথবা এমনটাও হতে পারে যে, আপনি একা থাকতেই পছন্দ করেন। যা-ই হোক, আসল কথা হলো, একা থাকা আর একা অনুভব করা এক জিনিস নয়।
এখন আসা যাক একাকিত্বের বিষয়টিতে। এটি এমন একটি অনুভূতি, যা আপনাকে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করার জন্য বা বন্ধুমহল খুঁজে বের করার জন্য আকৃষ্ট করবে। সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে এই জিনিসটি অধিক দেখা যায়। তবে সম্প্রতি ১৬-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যেও এই একাকিত্বের অনুভূতিটি বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণটাও খুবই স্বাভাবিক। এই বয়সের মধ্যেই সাধারণত পড়ালেখা কিংবা কর্মক্ষেত্র খুঁজে বের করার জন্য আমরা পরিবার ছেড়ে দূরে কোথাও বাস করি। আবার বর্তমান সময়ে এই বয়সেই অনেকের মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটে। এগুলো খুব সহজেই আপনাকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। কারণ হঠাৎ করেই আপনি আশেপাশে আপনার আপনজনদের দেখতে পাবেন না।
একটা বিষয় খেয়াল করেছেন কি? আমাদের যখন খুব ক্ষুধা লাগে, তখন যেকোনো খাবারই আনা হোক না কেন, তা আমাদের কাছে খেতে অনেক মজার মনে হয়। ঠিক তেমনি যারা একাকিত্বের মধ্যে থাকে, তারা আশেপাশে একজন বন্ধু পেলেই তার সাথে দিনের পুরোটা সময় কাটিয়ে দিতে চায়। এটা হলো বন্ধুমহলের প্রতি একটি আকর্ষণ, যা আপনি চাইলেই উপেক্ষা করতে পারবেন না।
এবার আসি একাকিত্ব আমাদের শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে কী কী ক্ষতি করতে পারে, তা নিয়ে। আমরা যারা একাকিত্বের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, প্রায় সবাই হয়তো লক্ষ করেছি যে, যখন নিজেকে খুব একা একা মনে হয়, তখন যেন শরীরে শীত অনুভূত হয়। হতে পারে বাইরে ভালো গরম পড়েছে। কিন্তু আপনার তারপরও শীত অনুভূত হবে। লম্বা সময় ধরে একাকিত্বের মধ্যে থাকা আবার আপনাকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, দীর্ঘ সময় ধরে একাকিত্বের মধ্যে থাকলে হৃদরোগের সম্ভাবনা ২৯% এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা ৩২% বেড়ে যায়। আবার একদিন একাকিত্বের মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা দিনে ১৫টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতিকর।
তাই শরীর ও মন সুস্থ রাখার জন্য আমাদের অবশ্যই একাকিত্ব থেকে বেঁচে থাকা উচিত। বলা হয়, যারা একাকিত্বের মধ্যে থাকে না, তারা একাকিত্বের মাঝে থাকা লোকদের চেয়ে ৫০% বেশি জীবনকাল পায়। কিন্তু একাকিত্ব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা তো এত সহজও না। এটি যখন আপনাকে পায়, তখন একদম জেঁকে বসে। নিজেকে তখন সবকিছু থেকেই আড়াল করে রাখতে ইচ্ছা করে। এখানেই আমরা প্রথম ভুলটি করে ফেলি। আপনার যখন একাকী অনুভূত হবে, তখন ভুলেও নিজেকে একা করে রাখা চলবে না। যদিও এ সময় কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন, তবুও চেষ্টা করুন নিজেকে ব্যস্ত রাখতে।
এখানে কয়েকটি উপায় তুলে ধরা হলো, যা আপনাকে একাকিত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
১. চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন
কারো সাথে কথা বলার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বললে আপনার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। একাকিত্বের সময় এটি অত্যন্ত জরুরি। আত্মবিশ্বাসের অভাবের জন্যই অনেকে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে এবং অনেকক্ষেত্রে এটি আত্মহত্যার দিকেও নিয়ে যায়। আপনি নিশ্চয়ই অন্যরা আপনাকে একা করে দিচ্ছে বলে নিজেকে ধ্বংস করে দিতে চান না।
২. নতুন কারো সাথে পরিচিত হন
এই উপায়টি অত্যন্ত উপকারী। নতুন কারো সাথে পরিচিত হলে একদিকে যেমন নতুন সম্পর্কের রাস্তা খুলে যায়, অন্যদিকে তেমনই নিজেকে আর একা মনে হয় না। তাই চেষ্টা করুন নতুন এবং বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজে বের করার।
৩. পরিবারকে সময় দিন
একাকিত্বের সময় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার থেকে দূরে কোথাও থাকি। তাই এ সময় পরিবারের সাথে কথা বললে বা যোগাযোগ করলে আপনার একদিকে নিজের যেমন ভালো লাগবে, অন্যদিকে সময়টাও সুন্দর কাটবে। যতকিছুই হোক না কেন, পরিবার তো আর আমাদের কখনও ফেলে দেবে না।
৪. দিনলিপি লিখে রাখুন
অনেকসময় নিজেই নিজেকে টেনে তুলতে হয়। নিজের কথাগুলো যখন কারো সাথে প্রকাশ করতে পারেন না, তখন দিনলিপি লেখা শুরু করতে পারেন। এখানে আপনার নিজের না বলা কথাগুলো লিখে রাখবেন। সময় হলে নিজের লেখা নিজেই পড়বেন। দেখবেন আপনার নিজেরই ভালো লাগছে।
একাকিত্বের সময় আমরা নিজেদের আলাদা করে রাখতে চাই। মনের মধ্যে শুধু এটাই চলতে থাকে যে, “আমি খুবই একা। আমার দ্বারা কিছু হবে না।” কিন্তু আমরা যদি নিজেদের একা ভাবতে থাকি, তাহলে আমরা আসলেই একা হয়ে যাবো। এ সময় নিজেকে যথাসম্ভব সময় দেয়া উচিত।
একাকিত্ব থেকে প্রবলভাবে মানসিক হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। আর এই হীনমন্যতাই অনেক সময় আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কখনও যদি মনে হয় যে আপনি এই হীনমন্যতায় ভুগছেন, তখন চেষ্টা করবেন অন্যকে হাসাতে। আপনি যদি একজনকে হাসাতে পারেন কিংবা কারো মন ভালো করে দিতে পারেন, তবে পৃথিবীতে কেউ না কেউ অবশ্যই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। অন্যের মন খুশি করতে পারলে তো নিজেরও খুশি লাগে!
Feature Image: Youtube