বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রার মান এবং পদ্ধতি। আর সেই ছোঁয়া লেগেছে কর্মক্ষেত্রেও। একুশ শতকের এই প্রতিযোগিতামূলক চাকুরিবাজারে নিজের অবস্থানকে শক্ত করতে হলে নিজেকে হতে হবে দক্ষ। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম সম্প্রতি তাদের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ শীর্ষক রিপোর্টে ২০২০ সালের কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি দক্ষতার তালিকা প্রকাশ করেছে। আসুন আজকে সেসব দক্ষতার কথাই জেনে নেওয়া যাক।
১. জটিল সমস্যা সমাধান
জটিল সমস্যার সমাধান বলতে বোঝায় এমন কোনো সমস্যার সমাধান করা, যার মুখোমুখি আপনি হয়তো আগে কখনো হননি এবং আপনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটিকে বিবেচনা করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ, দারিদ্র্য কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি সমস্যা আমাদের চারপাশে প্রচুর রয়েছে। এই সমস্যাগুলো বিভিন্ন সময় আমাদের শিল্প, ব্যবসা বা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করে। দ্রুততার সাথে আপনাকে সমস্যার ধরন বুঝতে এবং সমাধান করতে জানতে হবে।
এখন কীভাবে এই দক্ষতা বাড়ানো যায়? অনেকে মনে করেন ভিডিও গেমস খেললে নাকি জটিল সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ে! তবে বিভিন্ন গবেষণা বলে যে কাজ এবং অভিজ্ঞতার সাথে এই দক্ষতা সমৃদ্ধ হয়।
২. বিশ্লেষণধর্মী ভাবনা
বিশ্লেষণধর্মী ভাবনার অধিকারী মানুষের চাহিদা সবসময়ই শীর্ষে। ধারণা করা হচ্ছে যে, এই দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের চাহিদা ভবিষ্যতে ব্যাপক হারে বাড়বে। বিশ্লেষণধর্মী ভাবনা বলতে আসলে যা বোঝায় তা হলো কারণ ও যুক্তি সহকারে কোনো সমস্যাকে বিশ্লেষণ করা এবং সমাধান বের করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই করা। এই দক্ষতা ছাড়া ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক চাকরিবাজারে নিজেকে টেকানো প্রায় অসম্ভব।
৩. সৃজনশীলতা
এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কথা বলি আর সভ্যতার উন্নয়নের কথাই বলি, সবকিছুই সম্ভব হয়েছে মানুষের অসাধারণ সৃজনীশক্তির বলে। রোবট বা মেশিনের সৃজনীশক্তি নেই, যা আমাদের আছে। তাই ভবিষ্যৎ চাকুরি বাজারে সৃজনশীল মানুষের চাহিদা কেমন হবে সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন।
সৃজনশীলতা মানে হলো নতুন কিছু সৃষ্টি করা কিংবা পুরনো কোনো কাজকেই নতুন পদ্ধতিতে করা। সৃজনশীলতা বাড়াতে চর্চার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রচুর পড়ুন, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন, ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করুন। এগুলো অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে। আর অভিজ্ঞতা রসদ জোগায় সৃজনশীলতাকে।
৪. মানব ব্যবস্থাপনা
ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেলেও মানবিক দক্ষতাগুলো আবেগ চিরন্তন। তাই মানব ব্যবস্থাপনার মতো দক্ষতার চাহিদা বাড়বে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
মানুষ হিসেবে আমরা সৃজনশীল শক্তির অধিকারী- এ কথা যেমন সত্য, তেমনি হতাশা, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তার মতো বিষয়গুলো যে আমাদের প্রভাবিত করে সে কথাও সত্যি। তাই যিনি ম্যানেজার স্থানীয় পদে থাকবেন, তাকে অবশ্যই জানতে হবে কীভাবে তার দলের সদস্যদের পরিচালনা করতে হয়, তাদের অনুপ্রাণিত করতে হয় আর সকলের প্রয়োজন বুঝতে হয়। সঠিক মানব ব্যবস্থাপনা হলো আশানুরূপ উৎপাদনের মূল চাবিকাঠি। এই দক্ষতাটি সবার জন্য, বিশেষ করে যারা ম্যানেজার স্থানীয় পদে কাজ করতে চান, তার অবশ্যই অর্জন করা প্রয়োজন।
৫. অন্যদের সাথে সমন্বয়
আপনাকে অতি অবশ্যই অন্যের সাথে সমন্বয় করতে জানতে হবে। আজকাল কোথাও আপনি একা কাজ করবেন না। তাই ভালো একজন টিম প্লেয়ার হওয়া খুব জরুরি, জরুরি দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে নেয়াটা। এটা একধরনের দক্ষতা। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যাদের টিমওয়ার্ক ভালো, তাদের কাজের ফলাফলও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো হয়।
অন্যদের সমন্বয় করার দক্ষতাটি অর্জন করতে হলে আপনাকে কিছু ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। প্রথমত, কার্যকরী যোগাযোগে দক্ষ হতে হবে অর্থাৎ আপনি যা বলতে চাচ্ছেন তা যেন শ্রোতা অনুধাবন করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, যার সাথে কাজ করছেন তার মানসিকতা বুঝতে হবে। তৃতীয়ত, ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির মানুষদের সাথে কাজ করতে জানতে হবে। মোটামুটিভাবে এই তিনটি দিক যদি আপনার জানা থাকে তাহলে অন্যের সাথে সমন্বয় সাধন আপনার জন্য অনেকাংশেই সহজসাধ্য হয়ে যাবে।
৬. আবেগিক বুদ্ধিমত্তা
বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকর্তারা মনে করছেন ভবিষ্যতে অনুপ্রাণিত করা, আবেগিক বুদ্ধিমত্তা এবং শেখানোর মত দক্ষতাগুলোর খুবই চাহিদা থাকবে। আবেগিক বুদ্ধিমত্তা আসলে একধরনের সফট স্কিল। এই দক্ষতা মানুষের বৈচিত্র্যময় মানসিকতার মাঝে ঐক্য সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আপনার এই দক্ষতা কতটুকু, তা বোঝা যায় নিজের এবং ম্যানেজার, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব সহ চারপাশের মানুষজনের মানসিক অবস্থার সাথে আপনি নিজেকে ঠিক কতখানি মানিয়ে নিয়ে আচরণ করছেন তার উপর ভিত্তি করে। আবেগিক বুদ্ধিমত্তা আমাদের আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। যারা ভবিষ্যতে ম্যানেজার বা নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতে চান, এই দক্ষতাটি তাদের অবশ্যই থাকতে হবে।
৭. সঠিক বিচার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা
এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি দক্ষতা। আপনার কাছে প্রচুর তথ্য থাকবে কারণ প্রযু্ক্তির বদৌলতে তথ্য জোগাড় করাটা বর্তমানে খুবই সহজ। কিন্তু সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করে, যাচাই বাছাই করে তা থেকে সমাধান বা নতুন আইডিয়া খুঁজে বের করার মতো লোকের ভীষণ অভাব। তাই সঠিক বিচার এবং সিদ্ধান্ত নিতে জানে এমন লোকের চাহিদা যে দিন দিন বাড়বে, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই দক্ষতা বাড়াতে হলে এখন থেকেই তথ্য যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করুন। এজন্য যেটা করতে পারেন সেটা হলো বিভিন্ন কেস স্টাডি ও তথ্য নিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারেন। এগুলো থেকে সমাধান বা নতুন কোনো আইডিয়া উদ্ভাবনের চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার সঠিক বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা গড়ে উঠবে।
৮. সেবামূলক মনোভাব
সেবামূলক মনোভাব মানে শুধু এই নয় যে আপনি অবিরত মানুষের সেবা করে যাবেন। বরং আপনাকে সেবা দিতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী। ভোক্তা আসলে কী চাইছেন, তার কী প্রয়োজন- সেটার উপর ভিত্তি করে যেমন পণ্য উৎপাদন করতে হয়, তেমনি করে আপনার প্রতিষ্ঠান বা সহকর্মী কিংবা ক্রেতার চাহিদা, মূল্যবোধ, পছন্দ অপছন্দ, আশংকা ইত্যাদি বিবেচনা করে সে অনুযায়ী সেবা নিশ্চিত করতে জানতে হবে। এবং অবশ্যই কাজের জায়গায় সৎ হতে হবে।
৯. সমঝোতা
এই সমঝোতা বা নেগোসিয়েশন মানে সরাসরি দর কষাকষি না হলেও অনেকটা সেরকমই। সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যখন রোবট বা মেশিন টেকনিক্যাল কাজের অনেকটা অংশই দখল করে নেবে। যেহেতু রোবট বা মেশিনের আমাদের মতো মস্তিষ্ক নেই এবং তাদের থেকে বুদ্ধিমত্তা আমাদেরই বেশি, তাই সমঝোতা স্থাপনের কাজটি আমাদেরই করতে হবে। অফিসের ম্যানেজার, সহকর্মী কিংবা ক্লায়েন্ট সবাইকে সামলাতে হলে আপনার অবশ্যই ভালো নেগোসিয়েশন দক্ষতা থাকতে হবে। নেগোসিয়েশন শুনে দর কষাকষির মতো একটা সহজ বিষয় মনে হলেও সেটা অফিসিয়াল কাজের বেলায় অতটা সোজা নয়। এজন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা, সঠিক জ্ঞান আর যোগাযোগ দক্ষতা।
১০. ক্ষিপ্র মস্তিষ্ক
ক্ষিপ্র মস্তিষ্ক বলতে আসলে দ্রুত চিন্তার এক স্তর থেকে আরেক স্তরে যাওয়ার ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে। আপনার মস্তিষ্ক কত দ্রুত একটা সমস্যার সমাধান বের করতে পারে, কতটা দ্রুততার সাথে কোনো পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, কোনো নতুন বিষয় রপ্ত করতে পারে তা থেকেই আপনার মস্তিষ্কের ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের যে হারে চমক দেখাচ্ছে তার সাথে টিকে থাকতে হলে ব্রেনের দ্রুত ফাংশনিং আপনার থাকতেই হবে।
ব্যাপারটা খুব একটা সহজ নয় আসলে। এজন্য প্রচুর চর্চা প্রয়োজন। কিছু অভ্যাস নিজের মাঝে গড়ে তুললে এই দক্ষতাটি অর্জনের পথে অনেক ধাপ এগিয়ে যাবেন। যেমন, কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার সাথে নিজেকে জড়ানো, নিজেকে চ্যালেঞ্জ করা, প্রতিদিনের রুটিন মাঝে মাঝে বদলানো, কখনো কখনো সহজ উপায়ের বদলে কঠিন উপায় বেছে নেয়া কিংবা নতুন কিছু শেখার মতো অভ্যাসগুলো আপনার মস্তিষ্কের ক্ষিপ্রতাকে বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।
তথ্যসূত্র: World Economic Forum, careerfaqs.com