নতুন এবং প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া বা অভিযোজন করার গুণটি খুব বেশি আকর্ষণীয় না দেখালেও একটা সুখী এবং তৃপ্তিদায়ক জীবনযাপনের জন্য এটি অপরিহার্য। আমরা প্রতিনিয়তই মানসিকভাবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হই। কিন্তু সবাই সমান মানসিক শক্তি নিয়ে সেগুলোর মুখোমুখি হতে পারে না। অনেকেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, প্রচেষ্টায় অব্যাহতি দেয় এবং বিষণ্নতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে কিছু মানুষ এই চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করে এবং এর থেকে নতুন কোনো কিছু শেখার চেষ্টা করে। এরকম সাফল্য এবং ব্যর্থতাগুলো আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনযাপনকে বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত করে। তাই যে যত বেশি নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে পারবে তার জীবনে সাফল্য এবং সন্তুষ্টির প্রবাহ তত ভালোভাবে বজায় থাকবে। তার সামাজিক সম্পর্কগুলোও ভালোভাবে বহাল থাকবে।
বর্তমান দুনিয়াতে পরিবর্তন ছাড়া আর কোনো কিছুই ধ্রুব নয়।। তাই অভিযোজন করার ক্ষমতা থাকলে নতুন পরিবেশে অনিশ্চয়তার সময়গুলো ব্যক্তিগত ভালো থাকা না থাকার উপর খুব কমই প্রভাব ফেলতে পারবে। অভিযোজনক্ষম মানুষেরা সুখী এবং সন্তুষ্ট থাকে কারণ পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তারা তা প্রতিহত করে না। তাদের কিছু চমৎকার গুণ তাদেরকে এসব বৈশিষ্ট্য ধারণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
অনুসন্ধিৎসু
অভিযোজনক্ষম মানুষেরা নতুন আইডিয়া, পদ্ধতি এবং পরিবেশের প্রতি মানসিকভাবে উন্মুক্ত থাকে। তারা কোনো একটি কাজ সবসময়েই প্রচলিত পদ্ধতিতে অনুসরণ করার চেষ্টা করেনা। অনেক সময়েই তারা ভিন্ন ভিন্ন পন্থা খুঁজে বের করে যেখানে তাদেরকে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। তারা অনেক প্রশ্ন করে এবং তাদের জানা তথ্যগুলো প্রচলিত পরিস্থিতির সাথে কতটা মানানসই তা ভেবে বের করে। এভাবে বিভিন্ন পন্থার চর্চা তাদেরকে সবসময়েই নতুন কোনো পরিস্থিতির জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখে।
তাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা হাইপোথেটিক্যাল আইডিয়াগুলো নিয়ে সবসময়েই চিন্তা করে থাকে। সম্ভাব্য নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি নিয়ে করা চিন্তাগুলো প্রয়োজনের সময়ে তাদেরকে বাকিদের থেকে এগিয়ে রাখে।
ব্যর্থতার প্রতি ভীতিহীন
সবসময়েই যে নতুন আইডিয়াগুলো কাজ করবে না- এটাই স্বাভাবিক। অভিযোজনক্ষম মানুষেরা এই সত্যটি জানে এবং তারা বেশ ভালোভাবেই তা গ্রহণ করে নিয়েছে। তাই তাদের ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু শেখার এবং আরেকটু পরিণত হওয়ার ক্ষমতা থাকে। খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এই বৈশিষ্ট্য বেশ দরকারি। ব্যর্থতা সবসময়েই মানসিক যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু এই যন্ত্রণাই অভিযোজনক্ষম মানুষদেরকে নতুন করে শুরু করার অনুপ্রেরণা জাগায়।
কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে অভিযোজনক্ষম মানুষদের সৃষ্টিশীল সমাধান খুঁজে বের করার সামর্থ্য থাকে। তারা কোনো সময়েই একমাত্র সমাধানের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে না। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, যে সিস্টেমে তারা কাজ করে তা ব্যাংক, আদালত বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাই হোক না কেন তারা সিস্টেমের খুঁটিনাটি সবকিছুই খুব ভালো করে আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করে। পুরো সিস্টেমের ব্যাপারে তাদের এই জ্ঞান সবসময়েই উন্নতি করার চিন্তার পেছনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। খুঁটিনাটি পরিবর্তন, যেগুলো প্রচলিত ব্যবস্থাকে অসামান্য করে তুলবে, এরকম উপাদানগুলোর দিকে তাদের তীক্ষ্ণ নজর থাকে।
নিজেকে প্রেরণা দেওয়া
নিজের সাথে কথা বলা, নিজেকে প্রেরণা দেওয়া অভিযোজনক্ষম মানুষদের অনেক বড় একটা বৈশিষ্ট্য। তারা যখন কোনো স্ট্রেসফুল বা হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন নিজেকেই নিজে অনুপ্রাণিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ইতিবাচক সেলফ টকের মাধ্যমে নিজের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা যায়। কোনো একটি কাজের ব্যাপারে যদি নিজেকেই ‘অসম্ভব’ বলা হয়, তাহলে সেই কাজ বাস্তবে অসম্ভব হয়েই ধরা দেবে। তাই নিজের ভেতরের ইতিবাচক সত্তাকে সবসময় জাগ্রত রাখতে হয়, সবসময় তার কথা শোনার জন্যে কান পেতে থাকতে হয়।
কৌতূহলী
অভিযোজনক্ষম মানুষেরা শেখে এবং সবসময় একটা শেখার চর্চার মধ্যেই থাকে। কারণ তাদের মধ্যে একটা বিশাল পরিমাণের জ্বালানি রয়েছে ‘কৌতূহল’ নামে। কৌতূহল পরিণত হওয়ার রাস্তায় মানুষকে ধাবিত করে। এটা এমন এক বৈশিষ্ট্য যা সহজাত, যা থাকলে কাউকে কখনো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে জোর করতে হয় না।
ধরা যাক, কারো হয়তো মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে কৌতূহল রয়েছে। এই কৌতূহলের তাগিদেই সে মহাকাশবিজ্ঞানের অনেকরকম জটিল তত্ত্ব এবং বই পড়ার উদ্যম পাবে। শুধুমাত্র নিজের কৌতূহল নিবৃত্ত করার তাগিদই তাকে এই পথে ক্রমাগত অগ্রসর হতে সাহায্য করবে। কিন্তু যার আগ্রহ নেই, তাকে যদি চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয় ঐ একই বইগুলো পড়ে শেষ করার জন্যে সে নিজের উপর জোর করে হয়তো এগোতে থাকবে কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক সহজাত নয়। এভাবে একসময় ক্লান্তি আসাটা খুবই স্বাভাবিক, বিষণ্নতা বা নৈরাশ্যও ভর করতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে কেউ বলপ্রয়োগ পছন্দ করে না। এভাবে মানসিক চাপও তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক শিক্ষার্থীই এই কারণে হতাশ হয়ে পড়ে।
প্রগতিশীল
যাদের অভিযোজন ক্ষমতা নেই, তারা নির্দিষ্ট কোনো জ্ঞান ও দক্ষতা শিখে নেয় এবং সেগুলো প্রয়োগ করায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা যখন নতুন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, বেশিরভাগ সময়েই ব্যর্থ হয়। কারণ তাদের জানা জ্ঞান এবং দক্ষতা নতুন পরিস্থিতির জন্যে ফলপ্রসূ নয়। যা আগে কাজ করত কিন্তু নতুন তথ্য এবং পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করছে না এরকম যেকোনো কিছুই বাতিল হয়ে যায়। অভিযোজনক্ষম মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা নতুন তথ্যের আলোকে তাদের কর্মপদ্ধতি এবং জানা জ্ঞানগুলো সবসময়েই হালনাগাদ করে নেয়।
বর্তমানের পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নতুন কোনো আবিষ্কার বা তথ্য যেকোনো সময়েই পুরনো ধারণা এবং বিশ্বাসকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। তাই বাতিল হয়ে পড়া পুরনো তত্ত্ব বা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে রাখলে সময়ের সাথে প্রগতিশীল হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
অহেতুক দোষারোপ করে না
অভিযোজনক্ষম মানুষেরা সমাজের অন্য কারো মতামতের উপর ভিত্তি করে নিজেকে অহেতুক দোষারোপ করে না। প্রত্যাখ্যান বা ব্যর্থ হওয়া সবসময় সব মানুষের জন্যেই বেদনাদায়ক। ব্যর্থতা আমাদের আত্মসম্মানবোধকেও আহত করে। বেশিরভাগ মানুষই ব্যর্থ হলে সমাজের বাকিদের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে। এভাবে সফল হওয়ার জন্য নিজের ভেতরকার ইতিবাচক অনুপ্রেরণাগুলোও হারিয়ে যায়। মস্তিষ্ক অটো সাজেশন নেয় যে ‘আমাকে দিয়ে কিছু হবে না’। ব্যর্থতা এবং হতাশাবোধের এক গভীর গহবরে একসময় তারা হারিয়ে যায়।
কিন্ত অভিযোজনক্ষম মানুষেরা এভাবে নিজেকে দোষারোপ করে না। তারা অন্য সবার মতই ব্যর্থতার কষ্ট অনুভব করে। কিন্তু বাকিদের সাথে তাদের পার্থক্য হচ্ছে, তারা এই ব্যর্থতার স্মৃতি মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারে।
মুক্তচিন্তার মানুষদের সাহচর্য্য
মানুষ তাদেরকেই নিজের সঙ্গী এবং বন্ধু বানায় যারা একইরকম বিশ্বাস এবং আগ্রহ শেয়ার করে। অভিযোজনক্ষম মানুষদের বন্ধুরাও তাই তাদের মতো সবসময় নিজেদের নতুন জ্ঞানের মাধ্যমে আপডেট রাখে। তারা যখন আলোচনায় বসে বা আড্ডা দেয় তখন নিজেদের মধ্যে জ্ঞানের একরকম আদান-প্রদান হয়। এভাবে পারস্পরিক জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের নতুন নতুন জানার ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়। প্রতিনিয়ত এভাবে তারা নিজেদের আপডেট করে নিচ্ছে।
যদি অন্যের মতামতকে সমান ধরনের মূল্য না দেওয়া যায় সেক্ষেত্রে মানুষ নিজের আপন চিন্তা এবং জগতের মধ্যেই বিভোর থাকবে। ফলে নতুন সম্ভাবনা এবং সুযোগগুলো চোখে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। কারণ একজনের ব্যক্তিগত চিন্তা একমাত্রিক হয়ে থাকে। কিন্তু যখন এই একমাত্রিক চিন্তা আরো কয়েকটি চিন্তার সাথে যুক্ত হয় তখন নতুন কোনো আইডিয়া, কোনো থিওরি দাঁড়িয়ে যায়। তাই অভিযোজনক্ষম মানুষেরা তাদের চিন্তাগুলো মুক্ত রাখে, আরেকজনের সাথে শেয়ার করে, আরেকজনের ভালো চিন্তাগুলোও নিজের করে নেয়। তারা মানুষকে এভাবে সম্মান দিতে শেখে এবং শ্রদ্ধা করে।