Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রেন সিলাক: মৃত্যুকে ৭ বার ধোঁকা দেয়া ‘বিশ্বের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি’

বিপর্যয় আর বিপত্তিকে যেন জীবনেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ বানিয়ে ফেলেছেন ফ্রেন সিলাক। বয়স তখন তার ৩২-৩৩ হবে। জীবনে কখনো বিমানে ওঠার অভিজ্ঞতা ছিল না। সময় যে কাকে দিয়ে কখন কী করিয়ে ফেলে, কে জানে। তারই পরিক্রমায় তিনি পৌঁছে গেলেন বিমানবন্দরে। উঠে পড়লেন বিমানে। আর দুর্ঘটনায় পড়া বিমান থেকে সোজা খড়ের গাদার উপর ভূপতিত হয়ে রক্ষা পেল তার প্রাণ। শুধু তা-ই নয়, লাইনচ্যুত ট্রেন থেকে নদীতে গিয়ে পড়া, দু-তিনবার বাস দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া, একবার গিরিখাতের মুখ থেকে জ্যান্ত ফিরে আসা, ভস্মীভূত গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা আর তারপর ১ লক্ষ মার্কিন ডলারের লটারিতে জয়ী হওয়া- ভাগ্যদেবী যার উপর এতটা সুপ্রসন্ন, তার কথা তো জানতেই হয়।

ফ্রেন সিলাককে আপনি ভাগ্যবান বলবেন না অপয়া বলবেন, তা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার সাথেই কেন এত দুর্ঘটনা ঘটতে যাবে, আর কেনই বা সেগুলো থেকে তিনি একা সহি সালামতে বেঁচে ফিরবেন, তা এক রহস্যই বটে! ১৯২৯ সালের ১৪ জুন জন্ম নেয়া ক্রোয়েশিয়ান এই নাগরিকের বয়স আর কিছুদিন পরেই ৮৯ বছর হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের কাছে তিনি ‘ওয়ার্ল্ড’স লাকিয়েস্ট ম্যান’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড’স লাকিয়েস্ট আনলাকিয়েস্ট ম্যান’ খেতাব জিতেছেন। ৭ বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আর ৪ বার ব্যর্থ বিবাহের আঘাত সহ্য করে এখনো তিনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেড়ালের নয়টি জান নিয়ে যে প্রবাদবাক্যটি প্রচলিত আছে, ফ্রেন সিলাকের বেলায়ও তা প্রযোজ্য বলেই মনে হচ্ছে।

Image Source: allthatsinteresting.com

শুরুটা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ট্রেনে চেপে সারায়েভো থেকে ডুবরোভনিকে যাচ্ছিলেন গানের শিক্ষক ফ্রেন। লাইনচ্যুত হয়ে বরফে ঢাকা এক নদীর উপরে ছিটকে পড়ে ট্রেনটি। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ১৭ জন যাত্রী। সৌভাগ্যবান ফ্রেন সেখান থেকে দিব্যি বেঁচে ফিরে আসেন। প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে একটি হাত ভাঙা আর হাইপোথার্মিয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই হয়নি বলে জানান ফ্রেন।

পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে ঠিক এক বছরের মাথায়। ১৯৬৩ সালে ৩২ বছর বয়সী ফ্রেনের কাছে খবর আসে তার মা অসুস্থ। সাথে সাথে য়াগরিব থেকে রিজেকাগামী বিমানে উঠে মায়ের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রথম ফ্লাইটের সব টিকেট আগে থেকে বুক হয়ে গেলেও মায়ের অসুস্থতার কথা বলে, সহানুভূতি আদায় করে, এয়ারলাইন্সকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে বিমানের একদম শেষ মাথায় বিমানবালার পাশে বসে যাওয়ার অনুমতি আদায় করেন। ২০০৩ সালে টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তার প্রথম বিমানযাত্রার অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের ঠিক আগমুহূর্তে আচমকা প্লেনের দরজা খুলে যায়। তার ভাষ্যমতে, “আমি আর বিমানবালা বসে চা পান করতে করতে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে বলা নেই, কওয়া নেই, কীভাবে যেন প্লেনের দরজা খুলে গেল। পর মুহূর্তে দেখতে পেলাম বিমানবালা বিমানের বাইরে শূন্যে ভাসছে। আর তাকে অনুসরণ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমিও পৌঁছে গেলাম খোলা আকাশে!”

কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে গেল। বিমানবালা, দুজন পাইলট সহ মোট ২০ জন যাত্রী মারা গেলেন। দৈবক্রমে সেখান থেকেও বেঁচে ফিরলেন ফ্রেন। খোলা আকাশে ভাসতে ভাসতে তিনি গিয়ে পড়েছিলেন এক খড়ের গাদার উপরে। কাজেই এত বড় একটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েও ছোটখাটো কিছু কাঁটা-ছেঁড়া ছাড়া বলতে গেলে কিছুই হয়নি তার! বহাল তবিয়তে মায়ের কাছে ফিরে যান ফ্রেন।

Image Source: allthatsinteresting.com

১৯৬৬ সালে মাইক্রোবাসে করে কোথাও যাচ্ছিলেন ফ্রেন। পথিমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাসটি বিকল হয়ে পার্শ্ববর্তী এক নদীর উপরে গিয়ে পড়ে। ফ্রেনের ৪ সহযাত্রীর সবাই ততক্ষণে মৃত। ফ্রেন দিব্যি সাঁতার কেটে পাড়ে উঠে আসেন। এবারও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার পেয়েছেন তিনি।  

১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে প্রায় একই রকম দুটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। প্রথমবার গাড়িতে আগুন ধরে গেলে তিনি একেবারে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসেন। দ্বিতীয়বার পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নেয়ার সময় পাম্পের বিস্ফোরণে তার গাড়িতেও আগুন লেগে গেলে মাথার বেশির ভাগ চুল পুড়ে যায় তার। ফ্রেন সিলাকের প্রাণটি এতটাই শক্ত যে, যত বড় দুর্ঘটনাই হোক না কেন, তার তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

এরপর প্রায় ২২ বছর কোনোরকম দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হয়ে কাটিয়ে দেন ফ্রেন। ১৯৯৫ সালে য়াগরিবের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকা ফ্রেনকে সরাসরি ধাক্কা দেয় সিটি বাস। সামান্য কিছু কাঁটা-ছেঁড়া ছাড়া এবারও তেমন কিছুই হয়নি তার। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে উঁচু এক পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন ফ্রেন। এমন সময় আকস্মিকভাবে সামনে এসে পড়া এক ট্রাকের আঘাতে গাড়ি সহ প্রায় ৩০০ ফুট গভীর খাদে পড়ে যান। অনেকটা সিনেমার মতোই গাড়ি থেকে ছিটকে এক গাছের মগডালে আটকে গিয়ে সে দফাও বহাল তবিয়তে বাড়ি ফিরে আসেন ফ্রেন। গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় গভীর খাদে পড়ে গাড়িটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে সেবার বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন বলে জানান ফ্রেন।

Image Source: lifebuzz.com

অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, আস্তে আস্তে বন্ধুরা তার সাথে গাড়িতে ওঠা বন্ধ করে দিতে থাকে। কেউ কেউ তো যতটা পারত, ততটা তাকে এড়িয়ে চলত। “মাঝখানে কিছুদিন এমন গেছে যে যেকোনো বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য পেলেই আমি খুশি হয়ে উঠতাম। অনেকে আমাকে অপয়া বলে আমার জীবন থেকে দূরে সরে গেছে”। ফ্রেনের এক প্রতিবেশির সাথে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, “ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, আমার কানে যদি আসতো ফ্রেন কোনো ফ্লাইট বা ট্রেনের টিকেট বুক করেছে, সে সপ্তাহেই আমি আর ঘর থেকে বের হতাম না!”

সে যা-ই হোক, আশাবাদী ফ্রেন নিজের মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার ঘটনাগুলো থেকে ফিরে আসার ব্যাপারটিকে শুভ বলেই ধরে নিতেন। তার মতে, “প্রতিটি মুদ্রার দু’পিঠ থাকে। হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তি, নয়তো সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। নিজেকে দ্বিতীয়টি ভাবতেই বেশি পছন্দ করি আমি”। মৃত্যুর সাথে শেষবার পাঞ্জা লড়ার সপ্তাহখানিকের মধ্যে খবর আসে ফ্রেন লটারিতে ১ লক্ষ মার্কিন ডলার জিতেছেন। “আমার দৃঢ় বিশ্বাস আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না আমার সাথে। বাকি জীবনটা সুখে-শান্তিতে কাটাবো বলে মনে হচ্ছে। পুনর্জন্মের মতো অনুভূতি হচ্ছে। এত বছর ধরে ঈশ্বর আমার পরীক্ষা নিয়েছেন। এবার বোধহয় সেই পরীক্ষায় জয় লাভ করেই দুর্ভাগ্যকে পিছুছাড়া করতে পেরেছি”, এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন ফ্রেন।

Image Source: alchetron.com

লটারি জেতার পর শুরুতে তার শপিং লিস্টে ছিল একটি নতুন বাড়ি, একটি গাড়ি আর স্পিডবোট। কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝতে পেরেছেন, এত পরীক্ষার পর আজ এই শেষ বয়সে যে তাকে এতটা সৌভাগ্যের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন, তাকে ধন্যবাদ না জানালে নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকবেন। কাজেই নিজের জন্মভূমি পেট্রিঞ্জায় একটি চ্যাপেল নির্মাণ করার উদ্যোগ নেন তিনি। এখন তার ডাকনাম হয়ে গেছে ‘মিস্টার লাকি’!  

তবে ফ্রেন সিলাকের এত এত সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য নিয়ে ময়নাতদন্তও কম হয়নি। এতবার দুর্ঘটনা থেকে ফিরে আসার রেকর্ড চেক করে দেখা যায়, ১৯৬২ সালের যে দুর্ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, আদতে তা ঘটেছিল ১৯৫৭ সালে। ১৯৬২ সালের লাইনচ্যুত হয়ে যাওয়া ট্রেন দুর্ঘটনার পুরো বিবরণই মিলে যায় ঐ একই বছরে সংঘটিত একটি বাস দুর্ঘটনার সাথে। কাজেই ফ্রেনের কথায় কিছুটা গড়মিল থেকে যাচ্ছে। ২০০৩ সালে টেলিগ্রাফকে দেয়া তথ্যমতে, তিনি টানা কয়েক বছর ধরে লটারি কিনছিলেন। অবশেষে সে বছর লটারি জিতেছেন। শুরুর দিকের দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে খটকা লাগায় ২০১০ সালে আবারও তার সাক্ষাৎকার নেয় টেলিগ্রাফ। সেবার তিনি বলেন, জীবনে একবার লটারি কিনে সেবারই এক লক্ষ ডলার পেয়ে গেছেন তিনি। বয়সের ভারেও তার এমন স্মৃতিভ্রম হতে পারে বলে মনে করেন সাইকোলজিস্টরা। তবে মাইক্রোবাস সহ গাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনাগুলোর রেকর্ড চেক করে সত্যতা পাওয়া গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হতে কম কষ্ট করতে হয়নি ফ্রেন সিলাককে।

ফিচার ইমেজ- lottoexposed.com

Related Articles