ছোটবেলায় খুব মিশুক ছিলাম। বাসায় থাকলেই শুরু হতো কান্নাকাটি। বাবা-মা মাত্র ৩ বছর বয়সেই তাই প্লে বা প্রি-স্কুলে ভর্তি করে দেয় আমাকে। গণিতে পরবর্তীতে আমার বোঝার ক্ষমতা কম লক্ষ্য করে আমার ভাইয়ের বেলায় অন্যরকম সিদ্ধান্ত নেন তারা। আমার ছোট ভাইকে ৬ বছর বয়সে ভর্তি করানো হয় স্কুলে। এর আগপর্যন্ত ঘরে বসেই ‘অ-আ-ক-খ’ শিখছিল সে। খুব বেশি কি পরিবর্তন এসেছিল আমার মানসিক বিকাশ আর আমার ছোট ভাইয়ের মানসিক বিকাশের মধ্যে? কখন বাবা-মায়ের তাদের শিশুকে স্কুলে ভর্তি করা উচিৎ?
দেশভেদে শিশুর প্রাক-প্রাথমিক বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির বয়স ভিন্ন। অভিভাবকের মধ্যেও তাই এ নিয়ে দ্বিধার শেষ নেই। কম বয়সে স্কুলে ভর্তি না করিয়ে দিলে মনে হয়, “আমার বাচ্চাটা পিছিয়ে যাচ্ছে না তো সবার চেয়ে?” আর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে মনে হয়, “আমার বাচ্চাটার উপরে বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে না তো?” শিশুর স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে এমন দোনোমনা কম না। সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় আবার উঠে এসেছে এই প্রশ্ন নতুন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশুকে স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রথা আছে। চলুন, আজ সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে একইসাথে এ ব্যাপারে গবেষকদের মতামতও জেনে নেওয়া যাক।
প্রাথমিক বা প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি- কোন দেশে কেমন চল?
বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশে নিয়ম হিসেবেই, আবার কোথাও শুধু একটা প্রথা হিসেবে ভিন্নতা চলে আসে। যেমন: যুক্তরাষ্ট্রে আগস্ট মাসের ৩১ তারিখের আগে যদি কোনো শিশুর ৫ বছর বয়স হয়ে থাকে, তাহলে সে চাইলে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হতে পারে। তবে এটা বাধ্যতামূলক না। বাবা-মা চাইলে সন্তানকে ৮ বছর বয়সের আগপর্যন্ত ঘরেই পড়াশোনা শেখাতে পারেন। তবে হাওয়াইয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। সেখানে শিশুর বয়স জুলাই মাসের ৩১ তারিখের আগে ৫ বছর হলে তাকে স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ম।
ফ্রান্সে, শিশুর বয়স ৩ বছর হয়ে গেলে তার স্কুলে যাওয়া শুরু করা বাধ্যতামূলক। চাইলে সেটা বাবা-মা ২ বছর বয়স থেকেও শুরু করতে পারেন। প্রি-স্কুল থেকে এভাবে ৬ বছর বয়সে একজন শিশু প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হতে পারে।
সুইডেনে, শিশুদের স্কুলের বয়সটা শুরু হয় মোটামুটি ৬ বছরে পড়লেই। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে শিশুদের স্কুলে ১০ বছর থাকাটা বাধ্যতামূলক বলেই এমনটা নিয়ম।
দক্ষিণ আফ্রিকায়, শিশুরা ৭ বছর বয়সে গ্রেড ১-এ পড়াশোনা শুরু করতে পারে। তবে এর আগে চাইলে গ্রেড ০ নামে আরেকটি গ্রেডেও ভর্তি হতে পারে তারা, যেটা বাধ্যতামূলক না।
চীনে, ৩১শে আগস্টের আগে ৬ বছর বয়স হয়ে থাকলে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হতে পারবে একজন শিশু। তবে চীনা আইন অনুযায়ী অন্তত ৯ বছর বয়সের মধ্যে শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই হবে।
রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া আর মিশরেও শিশুর বয়স ৬ বছর হলেই তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাটা প্রচলিত প্রথা। তবে এর মানে কিন্তু এই নয় যে, প্রত্যেকটা দেশ ও সেই দেশের শিশুর বাবা-মা যৌক্তিক আর পরীক্ষিত কোনো কারণে নির্দিষ্ট বয়সে তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছেন। অনেকেই বাকিরা এই বয়সেই তাদের সন্তানকে স্কুলে দিচ্ছে সেটা দেখে দেখেই নিজেদের সন্তানকেও স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কোন বয়সে শিশুদের স্কুলে যাওয়াটা সবচেয়ে ভালো?
গবেষণার ফলাফল কী?
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সম্প্রতি কোন বয়সে শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া উচিৎ সেটা নিয়ে গবেষনা পরিচালনা করেন অনুসন্ধানী থমাস ডী এবং হেনরিক সিভার্টসেন। ড্যানিশ ন্যাশনাল বার্থ কোহর্টের মাধ্যমে মোট ৫৪,২৪১ জন অভিভাবকের সাথে কথা বলেন যাদের ৭ বছর বয়সী সন্তান আছে, এবং একইসাথে ১১ বছর বয়সী সন্তান আছে এমন আরো ৩৫,৯০২ জন অভিভাবকের সাথেও কথা বলেন তারা। গবেষণার মাধ্যমে তারা সিদ্ধান্তে আসেন যে, বাবা-মায়ের মতে শিশুরা ৬ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেই সেটার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের উপরে। তারা যেমন তখন নিজেদের আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ঠিক তেমন পরীক্ষা আর অন্যান্য ব্যাপারেও ভালো করে। বিশেষ করে ৭-১১ বছর বয়সীদের মধ্যে এই মানসিক উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আত্মনিয়ন্ত্রণ অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। শিশু এই আত্মনিয়ন্ত্রণ বয়সের সাথে সাথে আরো বেশি করতে শেখে, যেটা তাকে কোনোরকম মনোযোগের ব্যাঘাত হওয়া থেকে বিরত রাখে। তাহলে কি শিশুকে একটু বড় হওয়ার পর ৬ বছর বয়সের পরই বিদ্যালয়ে পাঠানো উচিৎ? এক্ষেত্রে কিছু জরুরি প্রশ্ন আপনাকে সাহায্য করতে পারে সিদ্ধান্ত নিতে। চলুন, জেনে নেওয়া যাক প্রশ্নগুলো।
আপনার শিশুকে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তির আগে এই প্রশ্নগুলো করুন।
১) আপনার শিশু কি নির্দেশনা মানতে পারে?
বিদ্যালয়ে শিশুর যাওয়া মানেই হলো তার অন্যের কাছ থেকে নির্দেশনা নেওয়া। তার মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। স্কুলে তাকে নাশতা করা, নিজেকে পরিষ্কার রাখা, বন্ধুদের সাথে মেশা ইত্যাদি কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হতে পারে। সে এগুলো কারো সাহায্য ছাড়াই আয়ত্ব করতে পারলে কিন্ডারগার্টেনে তাকে ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন।
২) আপনার শিশু কি একটি কাজ থেকে অন্য কাজে মনোযোগ দিতে পারে?
স্কুলে একটি শিশুকে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে, এক খেলা থেকে অন্য খেলায় মনোযোগ দিতে হতেই পারে। খেলাধুলার সময় শেষ হলে তাকে আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে সে এই কার্যক্রমের পরিবর্তন নিতে পারবে কিনা সেটা জানাটা প্রয়োজন। শিশু এই ব্যাপারটি আয়ত্ব করতে পারলেই তাকে স্কুলে ভর্তি করতে পারেন।
৩) আপনার শিশু কি বাসা থেকে, পরিবার থেকে দূরে থাকতে পারে?
শিশু যদি বাসার বাইরে বা বাবা-মা ছাড়া অন্য কারো সাথে থাকতে না পারে মানসিকভাবে, সেক্ষেত্রে তাকে আপাতত স্কুলে না পাঠানোই ভালো। শিশু যদি পরিবারের বাইরেও বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারে, মিশতে পারে, তাহলে তাকে স্কুলে ভর্তি করার কথা ভাবুন।
মূলত, শিশু কেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে, সে একজন আলাদা মানুষ হিসেবে কেমন, স্কুল ব্যাপারটার সাথে তার পরিচয় কীভাবে হয়েছে- এই সবকিছু মিলেই তাকে স্কুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভালো। তাই গড়পড়তা কোনো কিছুকেই ঠিক মনে না করে আপনার শিশুকে দেখুন এবং সেই ভিত্তিতেই তাকে স্কুলে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিন।