স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র অথবা খেলার মাঠ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলগত কাজের ভূমিকা অসামান্য। ‘টিম ওয়ার্ক’, আজকের দিনে একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। একা কাউকে একটি কাজ করতে দিলে দেখা যায় কাজের চাপ যদি অতিরিক্ত হয়ে যায় তখন তার পারদর্শিতা কমে আসে। অফিসের সুনির্দিষ্ট একটি কাজ দিনের পর দিন একইভাবে একাকী করতে হলে সে কাজের প্রতি স্পৃহা কমে আসাটা স্বাভাবিক। তাই শিক্ষা, খেলাধুলা, কর্মক্ষেত্র এসবের প্রতিটি কাজেই সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করাকে উৎসাহ প্রদান করা হয়। তবে খুব প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে, “নানা মুনির নানা মত”। অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তি একসাথে একটি কাজ করতে গেলে সেখানে কিছু মতপার্থক্য তৈরী হবে, একই কাজের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন মানুষের আগ্রহ ভিন্ন ভিন্ন হবে, কাজটি করার পদ্ধতিতেও থাকবে বৈচিত্র্য। তাই অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করাকে মূল উদ্দেশ্য বিবেচনা করে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কিছু আপোস করতে হয়। সবশেষে পুরো দলের মাঝে সমঝোতা তৈরীর মাধ্যমে কাজটি শেষ করতে হয়।
সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার বিশ্বাস
কর্মক্ষেত্রে সাফল্য নির্ভর করে দলগত কাজের ক্ষেত্রে কতটা বিশ্বাস বিদ্যমান তার ওপর। একটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য দলের প্রত্যেক সদস্যের মাঝে আস্থার জায়গা স্থাপন করে নেওয়া আবশ্যক। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক সদস্যকেই অর্জিত আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে হয়। নিজের কথা, কাজ এবং ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে গৃহীত প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদক্ষেপের মাঝেও আস্থা যাতে বজায় থাকে সে ব্যপারে সচেষ্ট থাকা উচিৎ। দল হিসেবে সাফল্যের মুখ দেখতে চাইলে সদস্যদের প্রত্যেককেই দক্ষতার সাথে কাজ করার পাশাপাশি নিজেদের মাঝে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রাখাটাও দরকারি। এছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সহকর্মীদের অবগত করে নেওয়া এবং অন্যদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাও কর্তব্যের মাঝে পড়ে।
দলগত কাজের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা নির্ভর করে বেশি কিছু বিষয়ের উপর। চলুন দেখে আসা যাক সেসব বিষয় কেমন করে ভূমিকা পালন করে দলের সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে।
প্রতিশ্রুতি
একদল মানুষের মাঝে আস্থার জায়গাটাতে প্রতিশ্রুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দলীয় সাফল্যের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক সদস্যেরই অন্যদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকাটা এক ধরনের দায়িত্ব। আর দায়িত্ব শতভাগ সফলভাবে পালন করার ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক সমস্যাকে এড়িয়ে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যদি নিতান্তই বিশেষ কোনো সমস্যায় (শারীরিক অসুস্থতা কিংবা পারিবারিক সমস্যা) ছুটি কাটাতে হয় তবে সেক্ষেত্রে বাসায় অবস্থান করেই যতটা সম্ভব কাজে সহকর্মীদের সাহায্য করার মানসিকতা থাকা উচিৎ। সদস্যদের প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের ভরসা থাকাটা খুব জরুরী। প্রত্যেককেই এই বিশ্বাস রাখতে হবে দলের সব সদস্যই তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। অর্থাৎ সবার মাঝে পারস্পরিক আস্থার একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
কর্মদক্ষতা
কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান হতে হবে। কাজের প্রতি ভালবাসা এবং আন্তরিকতা তখনই জন্মায় যখন কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিজেকে একজন সদস্য উপযুক্ত মনে করেন। একটি বৃহৎ কাজকে স্বল্প সময়ের মাঝে শেষ করার জন্য দলগত প্রয়াস ভূমিকা রাখতে সক্ষম। দলের প্রত্যেক সদস্যের নিজেদের কাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা উচিৎ।
দলে টিকে থাকতে হলে প্রতিদিন কাজের প্রতি নিজেকে বেশি করে নিবেদিত করার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতাকে বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প নেই। হ্যাঁ, এটাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন। নিজস্ব সীমাবদ্ধতাকে সহকর্মীদের কাছে স্বীকার করে নেওয়া কোনো দুর্বলতা তো নয়ই বরং পরিণামে এই সৎ স্বীকারোক্তিই কাজ করে পারস্পরিক আস্থাবোধের জায়গাকে আরও মজবুত করে তুলবে। প্রত্যেকেরই নিজের দুর্বলতা অন্যদের কাছে স্বীকার করে নেওয়া এবং এর প্রত্যুত্তরে সহকর্মীদের সহানুভূতিশীল মনোভাবই পারে দলের সবার মাঝে বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করতে।
পারস্পরিক যোগাযোগ
দলের সদস্যদের মাঝে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরীর জন্য তাদের নিজেদের মাঝে ধারাবাহিক এবং অর্থবহ যোগাযোগ রক্ষা করা আবশ্যিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দলের কারও নিজের কাজটুকু যদি আগেই শেষ হয়ে যায় তখন তার উচিৎ অবশ্যই এই বিষয়টি অন্যদেরকে অবহিত করা এবং কারও কোনো ধরনের সাহায্যে তিনি আসতে পারেন কিনা সে বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে জানতে চাওয়া। আবার কেউ যদি প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় সম্পর্কে হঠাৎ করে অবগত হন সেক্ষেত্রে তার উচিৎ প্রত্যেক সহকর্মীকেই সে বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া এবং সেটি হতে পারে কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমার পরিবর্তন অথবা কাজ সম্পর্কে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সন্ধান পাওয়া।
যারা ভার্চুয়াল জগতে কাজের সম্পর্ক বজায় রাখেন তাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়াকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। একটি মেইল শুধু একজনকে না পাঠিয়ে দলের সবাইকে পাঠালে একদিকে যেমন সবার কাছে নিজের প্রতি আস্থা তৈরী করা যায় তেমনি সবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাও সম্ভব হয়।
সমন্বয়
দলগত কাজের ক্ষেত্রে সদস্যদের মাঝে সমন্বয় থাকাটা অত্যন্ত জরুরী। বিশ্বাস আর সমন্বয় যেন একে অন্যের পরিপূরক। দলের মাঝে এমন একটি পরিবেশ থাকা উচিৎ যেখানে যে কেউ কোনো ধরণের দ্বিধা ছাড়া নিজের গঠনমূলক মন্তব্য পেশ করতে পারেন।
যখন একজন সদস্যের মাঝে এই বিশ্বাস জাগ্রত হয় যে তিনি তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করলে সেটির গ্রহণযোগ্যতা থাকবে তখন তিনি কাজের প্রতি আরও বেশি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে ওঠেন। পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একটা পর্যায়ে সহকর্মীদের মাঝে পেশাগত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে সম্প্রীতির সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারে।
দলগত কাজে নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়ার গুরুত্ব
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক ব্যবহারের একজন অধ্যাপক জেফ পোলজারের মতে,
“ব্যক্তিগত দুর্বলতা খুব সংবেদেনশীল একটি বিষয়। প্রকৃতপক্ষে নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে নেতিবাচক কিছুই নেই। পুরো ব্যাপারটাই হল নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরা এবং বলতে চাওয়া যে আমার একটি বিষয়ে সাহায্য দরকার। কর্মক্ষেত্রে কেউ যদি নিজস্ব অক্ষমতার কথা সম্পর্কে আলোকপাত করতে না চান তখন ক্রমান্বয়ে প্রত্যেকের মাঝে এক ধরনের শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তার বোধ জন্ম নেয়। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে কর্মীদের আত্মবিশ্বাস কমে আসে। কিন্তু সেই একই মানুষগুলো যদি নিজের দুর্বলতার কথা তার পাশের সহকর্মী কিংবা দলের অন্য সদস্যকে জানিয়ে সাহায্য আশা করে তখন কাজের পুরো পরিবেশ হয়ে ওঠে বন্ধুত্বপূর্ণ। সেই মুহূর্ত থেকেই কারও মাঝে কাজের প্রতি অনীহা অনুভব করার মতো কিছু থাকে না।”
কর্মক্ষেত্রে আপনি সবজান্তা শমসের হবেন, এটা আশা করা স্রেফ বাতুলতা। নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রেখে সেটাকে সময়মত স্বীকার করে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজের সীমাবদ্ধতা শেয়ার করে নেওয়াই হতে পারে একটি দলের সাফল্যের পাথেয়। চলুন দেখে আসা যাক কীভাবে স্বেচ্ছায় নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়া পরিণতিতে স্বীয় চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
কোনো একটি বিষয়ে সহকর্মীর নিকট সাহায্য আশা করার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে সীমাবদ্ধতার চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দুজন সহকর্মীর কথা ভাবা যাক- ক এবং খ।
- ‘ক’ তার নিজের কোনো সমস্যার কথা ‘খ’ কে জানালেন।
- ‘খ’, ‘ক’ এর সমস্যা সম্পর্কে অবগত হলেন।
- সমস্যা সমাধানে ‘খ’ সচেষ্ট হবেন অর্থাৎ ‘ক’ এর সাহায্য প্রার্থনার প্রতি সাড়া দিবেন।
- ‘খ’ নিজের দুর্বলতা সম্পর্কেও ‘ক’-কে জানাবেন।
- ফলশ্রুতিতে সম্প্রীতিবোধের একটি রূপরেখা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ঘনিষ্ঠতা ও বিশ্বাস বাড়বে।
নিজের সীমাবদ্ধতা লজ্জা বা লুকিয়ে রাখার কিছু নয়
আমাদের বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই নিজের দুর্বলতা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু যখন পারস্পরিক সহযোগিতার প্রশ্ন চলে আসে তখন ব্যক্তিগত অক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া ঝুঁকির কিছু নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন। পোলজারের ভাষ্যানুযায়ী, “নিজের দুর্বলতাকে স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে কাজের মন্থরতা দূরীভূত হয় এবং এটি আমাদেরকে একসাথে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। কোনো ভয় বা ইতস্তত বোধ ছাড়াই এর মাধ্যমে আমরা একটি একক সত্ত্বা হিসেবে কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হই।”
কাজের ভিন্নতায় সীমাবদ্ধতার চক্রের ধরন এবং ফলাফল হয়তো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, তবে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর মূলে রয়েছে একদম একই কলাকৌশল- নিজস্ব সীমাবদ্ধতার স্বীকারোক্তি এবং এর প্রতি সাড়া দিয়ে দলের স্বার্থে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া। সহকর্মীর কাছে পাঠানো বার্তাটি সব ক্ষেত্রেই একই: আপনার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই মুহূর্তে আমার আপনার সহযোগিতা কাম্য।
দলগত কাজের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা আপনাআপনি তৈরী হয়ে যায় না। একটি দলের মূল চালিকাশক্তি হল পরস্পরের প্রতি সাহায্য করার মানসিকতা, যেটি দলের সদস্যদের পর্যায়ক্রমিক চর্চার মাধ্যমে অর্জিত একটি চমৎকার অভ্যাস। অর্জিত এই অভ্যাসটি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক: কয়েকজন ব্যক্তির একটি উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়া, যেটি কখনও কখনও একঘেয়ে মনে হতে পারে, তবে শেষাবধি যুগপতভাবে পুরষ্কার নিয়েই ফেরত আসে।
ফিচার ইমেজ: pinterest.com