ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে ঈদ। ‘ঈদ’ শব্দটির অর্থ খুশি অথবা উৎসব। বহু আগ থেকে এই শব্দটির বানানে দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবহৃত হয়ে এসেছিল। তবে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রণীত হওয়ার পর থেকে এই শব্দটির বানানের ক্ষেত্রে হ্রস্ব ই-কারের ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৫ সালের তেসরা ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী ‘যুক্তফ্রন্ট’-এর ২১ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে ‘বর্ধমান হাউস’কে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠার কথা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি বাংলা বানান প্রমিত করার লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। সেই বিশেষজ্ঞ কমিটি ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ শীর্ষক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি বাংলায় লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ-কার এর ব্যবহার (ঈদ) অথবা, হ্রস্ব ই-কার এর ব্যবহার (ইদ) এর মধ্যে কোন বানানটি ঠিক– এ নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের তৈরি হয়েছে। এই দুটো বানানের মধ্যে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য– বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশের ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে; দুটো বানানের পক্ষেই যুক্তি রয়েছে।
‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ এর ১.১-এ বর্ণিত তৎসম শব্দের বানান অনুযায়ী, তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ, কোনো তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের বানানে যদি দীর্ঘ ঈ-কার থাকে এবং সেই শব্দ যদি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে, তাহলে সেই তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের বাংলা বানানেও দীর্ঘ ঈ-কার বজায় থাকবে। তবে, ১.২ এ বর্ণিত তৎসম শব্দ বানানের নিয়ম অনুযায়ী, যেসব তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের বানান (‘ই’ অথবা, ‘ঈ’) এবং (‘উ’ অথবা, ‘ঊ’) দুটো বর্ণের মধ্যে যেকোনো একটি বর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেই শুদ্ধ; সেইসব শব্দের বানানের ক্ষেত্রে অবশ্যই যথাক্রমে (‘ই’ অথবা, ক্ষেত্রবিশেষে ‘হ্রস্ব ই-কার’) এবং (‘উ’ অথবা, ক্ষেত্রবিশেষে ‘হ্রস্ব উ-কার’) ব্যবহৃত হবে।
অন্যদিকে, ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ এর ২.১-এ বর্ণিত অতৎসম শব্দের বানানের নিয়ম অনুসারে, সকল অতৎসম শব্দে অর্থাৎ, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি এবং মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে (‘ই’ অথবা, ক্ষেত্রবিশেষে ‘হ্রস্ব ই-কার’) এবং (‘উ’ অথবা, ক্ষেত্রবিশেষে ‘হ্রস্ব উ-কার’) ব্যবহৃত হবে। প্রমিত বাংলা বানানের এই নিয়ম অনুযায়ী, বাংলা বানান ‘ইদ’ হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের মতে, ‘ঈদ’ বানানের প্রচলন কিছু সময় থাকলেও একসময় ‘ইদ’ বানান প্রধান্য পাবে। তিনি বাংলা ভাষায় কোনো নিয়মিত দীর্ঘ-স্বর না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলা বানানের বর্তমান রীতি ও প্রবণতা অনুযায়ী ‘ঈদ’ না লিখে ‘ইদ’ লেখার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
অপরদিকে, আলোচ্য শব্দটি আরবিতে ‘আঈন ইয়া দাল’ (عيد) হিসেবে লেখা হয়ে থাকে; অর্থাৎ, উৎপত্তিগতভাবে আলোচ্য স্বরটি একটি দীর্ঘ-স্বর। আরবি উচ্চারণ বাংলা শব্দে লিখে প্রকাশ করা খানিকটা দুরূহ। কারণ, আরবি ব্যাকরণ আর বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম একরকম নয়।
বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মনসুর মুসার মতে, এই শব্দটি একটি উৎসবের নাম; নাম ও ট্রেডমার্ক ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক নয়। উৎপত্তিগতভাবে দীর্ঘ-স্বর বিবেচনায় এবং ভাষার মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চিহ্নগুলো রক্ষার তাগিদে তিনি এই শব্দটির বাংলা বানানের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত ‘ঈদ’ বানানটি বজায় রাখার পক্ষপাতী।
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান অবশ্য এই দুটো বানান ব্যবহারের ক্ষেত্রেই মত দিয়েছেন। ২০১৭ সালের ২২ জুন অপরাহ্নে তার ব্যবহৃত ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন,
“বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে প্রথম বানান হিসেবে ‘ঈদ’ এবং বিকল্প বানান ‘ইদ’ দেয়া আছে। প্রথম বানানটি প্রচলিত; ২য় বানানটি সংস্কারকৃত। কোনো মানুষ দীর্ঘকাল কোনো বানান ব্যবহার করলে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। ‘ঈদ’ বানানটি তেমনি। অতএব, দুটি বানানই ব্যবহার করা যায়।”
তাহলে, কেউ যদি চিরায়ত ঐতিহ্য অনুসরণ করতে চান, তিনি বহুল প্রচলিত ‘ঈদ’ বানানটি ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যদিকে, কেউ যদি বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসরণ করতে চান, তিনি ‘ইদ’ বানানটি ব্যবহার করতে পারবেন।
সম্প্রতি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের পাঠ্যপুস্তকে এবং সরকারি বিভিন্ন কাজে বাংলা একাডেমি প্রণীত বানানরীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে একটি সুনির্দিষ্ট ভাষানীতি অনুসরণ করা না হলে বানানের ক্ষেত্রে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অপরদিকে, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নামের বানানের ক্ষেত্রে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রযোজ্য হয় না। রীতিনীতি যেটাই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষ মূলত চর্চার মাধ্যমে ভাষা এবং বানান শিখে থাকে। সেজন্য ‘ঈদ’ অথবা, ‘ইদ’– এর মধ্যে কোন বানানটি টিকে থাকবে, সেটা সময়ই নির্ধারণ করবে।