বই নিয়ে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত বিষয়টি সম্পর্কে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে নিঃসন্দেহে উত্তর আসবে বইয়ের কোন রকমটি অধিকতর সুবিধাজনক? ভীষণ ব্যস্ত-প্রযুক্তিঘেঁষা-গ্যাজেট প্রিয়রা বলবেন পিডিএফ, ইপাব এসব অর্থাৎ ডিজিটাল সংস্করণের কথা; অন্যদিকে কাগজপ্রিয়-আয়েশী পাঠকরা বলবেন মুদ্রিত সংস্করণের কথা। কখনোই বইয়ের পাতা উল্টিয়েও দেখেননি অদ্যাবধি, এমন কাউকে এই প্রশ্নটি করলেও বোধহয় তার বিজ্ঞ মতামতের অভাব হবে না। কিন্তু তর্কের মূল আলোচ্য বিষয় পাল্টে গেলে কেমন হবে?
সাহিত্য জগতে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রারম্ভ কোন রচনাগুলোর? কখনও কি ভেবে দেখেছেন এই বিষয়টি নিয়ে? তর্কাতীতভাবে যেকোনো সাহিত্যকর্মের শুরুর বাক্যটিকে হতে হয় সবচেয়ে ওজস্বী। এতে একদিকে যেমন পাঠকের মনোযোগ শুরুতেই কেন্দ্রীভূত করে নেওয়া যায়, তেমনি অন্যদিকে পুরো রচনাটির একটি প্রচ্ছন্ন আভাস প্রদান করা যায়।
সাহিত্যকর্ম দিয়ে পাঠককূলে বাজিমাত করতে চাইলে তাই রচনার প্রথম বাক্যটি হওয়া চাই ভীষণ উপলব্ধিজাত ও ভাববোধক। উপন্যাসের প্রথম লাইনটিকে হতে হবে সাহিত্যরসে পরিপূর্ণ, গঠনশৈলীতে সুসংহত, অর্থে নিগূঢ়তম এবং অলঙ্কার-উপমা-শব্দের কারুকার্যে মাধুর্যমণ্ডিত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।
পাঠক যে কল্পকাহিনীর যাত্রায় লেখকের সাথে শামিল হতে যাচ্ছেন, তার সূচনায় থাকা চাই এক অনবদ্য সম্ভাষণ। এক অমোঘ, দুর্নিবার আকর্ষণে পাঠক যাতে এই যাত্রাকে উপেক্ষা করতে না পারেন কোনোমতেই, তেমন শিহরণ জাগানিয়া ইনিশিয়াল বা প্রারম্ভই পারে অনেকাংশে পুরো ফিকশনটিকে পাঠকসমাজে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে। আজকের আয়োজনটি সাজানো হয়েছে প্রথম বাক্যটির গঠন ও অর্থের কারণে সেসব সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হয়েছে, সেসব নিয়ে।
ট্রেজার আইল্যান্ড- রবার্ট লুইস স্টিভেনসন
Squire Trelawnay, Dr Livesey, and the rest of these gentlemen having asked me to write down the whole particulars about Treasure Island, from the beginning to the end, keeping nothing back but the bearings of the island, and that only because there is still treasure not yet lifted, I take up my pen in the year of grace 17– and go back to the time when my father kept the Admiral Benbow inn and the brown old seaman with the sabre cut first took up his lodging under our roof.
স্কোয়াল ট্রেলনি, ডাক্তার লিভজি আর বাকি সবাই আমাকে বললেন, কিছু বাদ না দিয়ে ট্রেজার আইল্যান্ডের কাহিনীগুলো আগাগোড়া লিখে ফেলতে। তবে দ্বীপের ভূগোলটা না লেখাই ভালো। কারণ সেখানে আরও গুপ্তধন রয়ে গেছে। অতএব ১৭ খ্রিস্টাব্দের এক শুভদিনে আমি দোয়াতে কলম ডুবিয়ে লিখতে শুরু করলাম। শুরু করলাম সেদিন থেকে, যেদিন বাবার সেই সরাইখানা অ্যাডমিরাল বেনবোয় রোদে পোড়া, গালে কাটা দাগওয়ালা সেই বুড়ো খালাসিটা এসে আস্তানা গাড়ে।
এক অসম্ভব রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর কিশোর উপন্যাস। গুপ্তধনের নকশা খুঁজে পেয়ে এক কিশোর রওনা দেয় অভীষ্ট দ্বীপের উদ্দেশে। দস্যুদল থাকে এই যাত্রায় খল চরিত্রের ভূমিকায়। ২৩ মে, ১৮৮৩ সালে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। জনপ্রিয়তার কারণে বিশ্বের নানা ভাষায় পরবর্তী সময়ে অনূদিত হয়।
লাভ ইন দ্য টাইম অভ কলেরা- গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
It was inevitable: the scent of bitter almonds always reminded him of the fate of unrequited love.
এটি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না: তেতো স্বাদযুক্ত বাদামের ঘ্রাণ তাকে চিরকালই একতরফা প্রেমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
ম্যাজিকাল রিয়েলিটি বা জাদুবাস্তবতার জনক মার্কেজের এক অনন্য সৃষ্টি এই বইটি। নায়িকা তার সাথে প্রেমে আবদ্ধ পুরুষটিকে বিয়ে না করে এক সম্পদশালী চিকিৎসককে বিয়ে করেন। প্রেমিকের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হলেও হৃদয়ের গভীরে তার ভালোবাসা দাগ মুছে যায় না। সুস্থ, সচেতন মস্তিষ্ক নিয়েই প্রেমিকার স্বামী মারা গেলে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশ নেন সাবেক প্রেমিক। ১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাস ১৯৮৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস বুক প্রাইজ জিতে নেয় ফিকশন ক্যাটাগরিতে।
আন্না কারেনিনা- লিও টলস্টয়
Happy families are all alike; every unhappy family is unhappy in its own way.
প্রতিটি সুখী পরিবারের চিত্র একই; প্রতিটি অসুখী পরিবার নিজস্ব মৌলিক ধারায় অসুখী।
১৮৭৩ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় রাশিয়ার দ্য মেসেঞ্জার পত্রিকায়। প্রকারান্তরে লেখক পুরো রচনার নির্মাণ জুড়েই কারেনিনার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে গেছেন। ১৯৯৭ সালে আইকন প্রোডাকশন ও ওয়ার্নার ব্রাদারসের যৌথ প্রযোজনায় একই নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
ললিতা- ভ্লাদিমির নাবোকোভ
Lolita, light of my life, fire of my loins. My sin, my soul. Lo-lee-ta: the tip of the tongue taking a trip of three steps down the palate to tap, at three, on the teeth. Lo. Lee. Ta.
ললিতা, আমার জীবনের আলো, কটিদেশে প্রেমাগুন। আমার পাপ, আমার আত্মা। লো-লী-তা: জিহ্বার শীর্ষদেশ তালু থেকে তিন পদক্ষপ দূর হতে ধীরে ধীরে নেমে আসে দাঁতের গোড়ায়। লো। লী। তা।
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস প্রেম, যৌনতা, অবসেশনের এক অসাধারণ, অবিস্মরণীয় দলিল।
দ্য স্ট্রেঞ্জার- আলবেয়ার ক্যামু
Mother died today. Or maybe, yesterday; I can’t be sure.
মা মারা গেলেন আজ। অথবা হয়তো গতকাল; আমি নিশ্চিত নই এই বিষয়ে।
নোবেল বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিকের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ১৯৪২ সালে এই অসাধারণ সাহিত্যকর্মটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
প্রাইড অ্যান্ড প্রিজুডিস- জেন অস্টেন
It is a truth universally acknowledged, that a single man in possession of a good fortune, must be in want of a wife.
এ এক চিরন্তন সত্য যে সৌভাগ্যের অন্বেষণরত একজন অবিবাহিত পুরুষের জীবনে, একজন নারীর উপস্থিতি আবশ্যক।
সর্বপ্রথম ১৮১৩ সালে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয় এই উপন্যাস। পরবর্তীতে এই সাহিত্যকর্মটিকে ভিত্তি করে মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র জগতে বেশ কিছু কাজ হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত টিভি মিনিসিরিজটি। এতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন জেনিফার ও কোলিন।
দ্যা বেল জার- সিলভিয়া প্লাথ
It was a queer, sultry summer, the summer they electrocuted the Rosenbergs, and I didn’t know what I was doing in New York.
সে ছিল এক গুমোট, ভ্যাপসা আবহাওয়ার গ্রীষ্মকাল, যে গ্রীষ্মে তারা রোজেনবার্গ দম্পতিকে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে সাজা দিল এবং আমি জানতাম না নিউইয়র্কে বসে আমি ঠিক কী করছি?
একজন কবি কলম ধরলেন একজন কবির মৃত্যুর কাহিনী লিখবেন বলে। তার একমাস বাদেই আত্মহত্যা করলেন লেখক সিলভিয়া প্লাথ। ছদ্মনামে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এর দশ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। আমাদের যেমন একজন জীবনানন্দ আছেন, ইংরেজদের তেমনি আছেন একজন সিলভিয়া প্লাথ। মূলত প্লাথের বিশ বছর বয়সের কাহিনী নিয়েই এই রচনাটি নির্মিত।
মেটামরফোসিস- ফ্রানৎস কাফকা
As Gregor Samsa awoke one morning from uneasy dreams he found himself transformed in his bed into a monstrous vermin.
একদিন সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখে, জেগে উঠে বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে একটি রূপান্তরিত কীট হিসেবে।
১৯১৫ সালে প্রকাশিত এই ছোট গল্পটির আবেদন ১০০ বছর পরও এতটুকু কমেনি। ১৯১২ সালের শরৎকালে কাফকা লেখাটি নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ডিসেম্বর ৭ নাগাদ একটি কপি প্রস্তুত করলেও প্রকাশকের সাথে দ্বন্দ্ব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে শেষ অবধি মুদ্রিত হয় ১৯১৫-তে।
ডেভিড কপারফিল্ড- চার্লস ডিকেন্স
Whether I shall turn out to be the hero of my own life, or whether that station will be held by anybody else, these pages must show.
নিজের জীবনের নায়ক আমিই হব কি না, অথবা সেই অধ্যায়টি অন্য কারও জন্য তোলা রইবে কি না, এই লেখাটি সে প্রশ্নেরই মীমাংসা করবে।
১৮৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এই অসাধারণ সাহিত্যকর্মটি। ইংরেজি সাহিত্যজগতে তো বটেই, স্বয়ং চার্লস ডিকেন্সও স্বীকার করে গেছেন, তার সৃষ্টির মধ্যে এটিই তার পছন্দের শীর্ষে।
জেন এয়ার- শার্লট ব্রন্টি
There was no possibility of taking a walk that day.
সেদিন প্রাতভ্রমণে বেরোবার বিন্দুমাত্র কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
অনাথ শিশু জেনের যৌবন বয়সের পুরোটা নিয়েই এই লেখা। ১৮৪৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
এবেলা এসে পাঠকমনে প্রশ্ন জাগতে পারে, একটি জোরদার ইনিশিয়াল বা প্রারম্ভের সহজতম তরিকা কী? বস্তুত পৃথিবীর খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকেরা কোনো ‘থাম্ব রুল’ অনুসরণ করে তাদের লেখার প্রারম্ভকে শক্তিশালী করে তোলেন না। কেউ হয়তো স্রেফ কয়েক শব্দে বন্দী করেছেন পাঠককে, কেউ হয়তো কয়েক লাইনের ন্যারেটিভে কিছুটা বিশদভাবে এঁকেছেন কাহিনীর সূচনাকে।
লেখক হিসেবে যে পথেই আপনি হাঁটুন না কেন, একথা অনস্বীকার্য যে, আপনার সম্মোহনী শক্তি থাকতেই হবে। বর্ণনার ঢঙে, ভাষার শৈল্পিকতায় আপনাকে নৈপুণ্যে ভরা কিছু কথা বলে পাঠকের সাথে একটি একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যার ফলাফল হিসেবে পাঠক যাত্রার শেষ অবধি আপনার কথা শুনতে চূড়ান্ত আগ্রহ বোধ করবেন। লেখক হিসেবে গল্প বলাই তো আপনার কাজ!
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/