প্যারোডি এবং বাংলা সাহিত্য

“ধনমান্য যশ-গাঁথা,
আমাদের এই কলিকাতা।
তার মাঝে এক অফিস আছে
সব অফিসের সেরা।
ও যে, ইট পাথরে তৈরি সেটি
রেলিং দিয়ে ঘেরা।”

খুব চেনা চেনা লাগছে কবিতাটি? লাগারই কথা। এই কবিতাটি না শুনলেও দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ গীতিকবিতাটি আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন। বহুবার গেয়েছেনও হয়তো অনেকে। ‘আমার কর্মভূমি’ নামে সতীশ চন্দ্র ঘটকের একটি কবিতা রয়েছে। উপরোক্ত লাইনগুলো সেই কবিতা থেকেই নেয়া। না, কাকতালীয়ভাবে যে দুটি কবিতা একে অপরের ছায়া হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বরং সতীশ চন্দ্র ঘটক জেনেশুনে এবং বেশ সচেতনভাবেই দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের কবিতার ছায়াবলম্বনে হাস্যরসাত্মক এই লাইনগুলো লিখেছেন। এ ধরনের কবিতাকে বলা হয় ‘প্যারোডি’।

‘প্যারোডি’ একটি ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মিথ্যা অভিনয়’, যদিও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘প্যারোডি’ শব্দটিই বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শব্দশিল্পের এক দারুণ মাধ্যম এই প্যারোডি। শব্দের জাদুকরী খেলায় কোনো রচনাকে অনুকরণ করাকেই সাহিত্যের ভাষায় প্যারোডি বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে বলতেন ‘লালিকা’। প্যারোডি হতে পারে গঠনমূলক কিছু, কখনোবা আক্রমণাত্মক। আবার অনেক সময় প্যারোডি নিছকই হাস্যরস সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কেউ কেউ শব্দশিল্পের এই মাধ্যমকে কুরুচি এবং নগ্নতার মোড়কেও মুড়িয়েছেন।

বিশ্বসাহিত্যে প্যারোডির সংখ্যা নেহাত কম নয়। ধারণা করা হয়, সবচেয়ে প্রাচীন প্যারোডির শিকার হয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত গ্রীক কবি হোমার। এরপর বিশ্বসাহিত্যের অনেক মহারথীরা প্যারোডি করেছেন, আবার নিজেরাও প্যারোডির শিকার হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাম। শেক্সপিয়ার তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘হ্যামলেট’ এর একটি দৃশ্যে আরেক বিখ্যাত ইংরেজ লেখক ‘ক্রিস্টোফার মার্লো’কে প্যারোডি করেছেন। অন্যদিকে ‘জন মার্সটন’ নামের আরেক ইংরেজ সাহিত্যিক তার ‘মেটামরফোসিস অফ পিগম্যালিয়নস ইমেজ’ কবিতাটিতে শেক্সপিয়ারের লেখা ‘ভেনাস এন্ড অ্যাডোনিস’ এর প্যারোডি করেছেন। এছাড়াও জন মিল্টন, ওয়াল্টার স্কট, এডগার অ্যালেন পো, ওয়াল্ট হুইটম্যান সহ আরও অনেক খ্যাতিমান লেখকদের সৃষ্টিও তাদের সমসাময়িক এবং পরবর্তী যুগের লেখকরা প্যারোডি করেছেন।

প্রাচীনতম প্যারোডির শিকার হোমার; Source: thinglink.com

এতক্ষণ তো বলা হলো বিশ্বসাহিত্যের প্যারোডির কথা। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও কিন্তু প্যারোডির সংখ্যা অনেক। বাংলা সাহিত্যের দুই মহান দিকপাল কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাই প্যারোডির শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই রবীন্দ্রনাথের ‘১৪০০’ সাল কবিতার প্যারোডি করেছেন। ঠিক প্যারোডি হলেও সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধারই নিদর্শন স্বরূপ এবং সেটিকে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনেক প্যারোডি হয়েছে। এ থেকে অবশ্য তাঁর জনপ্রিয়তাও অনুমান করা যায়। কবিগুরুর রচিত বিখ্যাত একটি গান ‘যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। এটি প্যারোডি করলেন নিবারণ চক্রবর্তী, দিবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। নিবারণ চক্রবর্তী লিখলেন-

“যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই দ্বারে
বইব না আর বাজার বোঝা এই ঘাড়ে
চুকিয়ে দিয়ে মুদির দেনা,
সাঙ্গ করে কাপড় কেনা
প্রবাস যাত্রা করবো আমি এইবারে।”

আর সব জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের মতই রবি ঠাকুরের কবিতার প্যারোডি হয়েছে হরদম; Source: The 39 Clues Wiki Fandom

রবীন্দ্রনাথের আরেক বিখ্যাত কবিতা ‘উর্বশী’। কবিতার কিছু লাইন ছিলো-

“নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধু, সুন্দরী রূপসী,
হে নন্দন বামিনী উর্বশী।”

কবিতাটিকে প্যারোডি করলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়, বনফুলের মতো বিখ্যাত লেখকেরা। শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় লিখলেন ‘শ্যালিকা’ নামের কবিতা। লাইনগুলো ছিলো-

“নহ পৌঢ়া, নহ বৃদ্ধা, নহ শিশু, নহ নাবালিকা
হে তরুণী রূপসী শ্যালিকা।”

একই কবিতাকে প্যারোডি করে বনফুল ‘শালা’ নামের কবিতায় লিখলেন-

“সামান্য সমুষ্য নহ, নহ গৃহিণীর ভ্রাতা
হে শ্যালক, হে স্বভাব শালা।”

বাংলা সাহিত্যের প্যারোডি রচয়িতাদের মাঝে যার নাম সবার আগে চলে আসে তিনি হলেন ‘সজনীকান্ত দাস’। ‘শনিবারের চিঠি’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। সমালোচনার বাণে যেমন সমসাময়িক সাহিত্যিকদের জর্জরিত করতেন, সেই সাথে সমান তালে চলতো তার প্যারোডি রচনা। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ থাকুর, গজেন্দ্রকুমার মিত্র- কেউই তার সমালোচনা কিংবা প্যারোডির হাত থেকে রক্ষা পাননি। রবীন্দ্রনাথের পত্র কবিতার লাইনগুলো ছিলো-

“কাজল বিহীন সজল নয়নে
হৃদয় দুয়ারে ঘা দিয়ো।
আকুল অচিলে পথিক চরণে
মরণের ফাঁদ পাতিয়ো।”

এর প্যারোডি করে সজনীকান্ত লিখলেন-

“দন্ত বিহীন শুষ্ক বদনে
ফোকলা কান্না কাঁদিয়ো।
শাড়ির আঁচলে দোক্তা ও চুন
সযতনে প্রিয়া বাঁধিয়ো।”

রবীন্দ্রনাথের আরেক কবিতা ‘চঞ্চলা’র কিছু লাইন ছিলো নিম্নরূপ-

“হে বিরাট নদী,
অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল
অবিচ্ছিন্ন অবিরল
চলে নিরবধি।”

সেই কবিতা সজনীকান্তের হাতে নতুন রূপ নিলো। সজনীকান্ত তাঁর ‘গদি’ নামের কবিতায় লিখলেন-

“হে প্রাচীন গদি,
অদৃশ্য নিঃশব্দ তবতলে
ছারপোকা দলে দলে
চলে নিরবধি।”

সজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতারও প্যারোডি করেছেন সমানতালে।
‘বিদ্রোহী’ নজরুলের সেরা কবিতাগুলোর মাঝে অন্যতম নিঃসন্দেহে। সেই কবিতার প্যারোডি করে সজনীকান্ত লিখলেন-

“আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং।
ভৈরব রসে বরষা আসিলে,
ডাকি যে ঘ্যাঙর ঘাং।
আমি ব্যাঙ।”

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম; Source: pinterest

বিদ্রোহী কবি তাঁর আরেক বিখ্যাত কবিতা ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ এ লিখলেন-

“দুর্গম গিরি কান্তার মরু
দুস্তর পারাবার।
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশিথে,
যাত্রীরা হুঁশিয়ার।”

সজনীবাবু এই কবিতারও প্যারোডি করলেন। কবিতার নাম দিলেন ‘ভাণ্ডারী হুঁশিয়ার’। ভাণ্ডারী হুঁশিয়ার’এর কিছু লাইন নিচে তুলে দেওয়া হলো-

“চোর ও ছ্যাঁচোড়,
ছিচকে সিঁদেল দুনিয়া চমৎকার।
তল্পি তল্পা তহবিল নিয়ে,
ভাণ্ডারী হুঁশিয়ার।”

সজনীকান্ত ছাড়েননি মাইকেল মধুসূদন দত্তকেও। মাইকেল লিখেছিলেন ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। সেই বইয়ের প্যারোডি করে লিখে ফেললেন ‘মাইকেল বধ কাব্য’। সজনী কান্ত দাস যে শুধুই সমালোচনা করেছেন কিংবা প্যারোডি করেছেন, তেমনটা কিন্তু নয়। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অনস্বীকার্য। বিভূতিভূষণ যখন তার প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ ছাপানোর প্রকাশক পাচ্ছিলেন না, তখন নিজ থেকে এগিয়ে এসেছিলেন সজনীকান্ত। যদিও নিজে ছিলেন অর্থকষ্টে। একইভাবে সাহায্য করেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। কাজী নজরুলের অনেক বড় সমালোচক হয়েও কবির চিকিৎসার সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত। জীবনানন্দ দাশ কিংবা বুদ্ধদেব বসু সবাই বিপদের সময়ে সজনীকান্তকে কাছে পেয়েছেন। সজনীকান্ত মানুষ হিসেবে ছিলেন বেশ হৃদয়বান।

সজনীকান্ত দাসের সমসাময়িক আরেকজন প্যারোডি কারিগর ছিলেন সতীশ চন্দ্র ঘটক। সজনীকান্ত তো তবু শুধু সমসাময়িকদের লেখা প্যারোডি করেছেন, কিন্তু সতীশবাবু মধ্যযুগের কবিদের পর্যন্ত ছাড়েননি। কবি জ্ঞানদাসের রচিত একটি পদাবলী ছিলো এমন-

“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু,
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয় সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।”

এই কবিতাকে প্যারোডি করেছেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম এবং সতীশ চন্দ্র ঘটক। সতীশ চন্দ্র লিখলেন-

“ফলার লাগিয়া যে দই পাতিনু,
বিড়ালে খাইয়া গেল।
ছেলিয়া গুলিরে মানুষ করিতে
সকলি বকটি ভেল।”

বাংলা সাহিত্যে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে গঠনমূলক প্যারোডির উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবে রম্য পত্রিকাগুলো কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই এর উপস্থিতি লক্ষণীয়। কবি সাহিত্যিকরা না করলেও সাধারণ মানুষ এখনও এর চর্চা করছে। নিছক কমেডি ছাড়াও কথায় গানে অনেক সময় প্যারোডি হয়েছে প্রতিবাদের মাধ্যম। প্যারোডি আসলে একধরণের শব্দশিল্প। শিল্প সাহিত্য যতদিন থাকবে ততদিন মানুষের সৃজনশীলতায় এই শিল্পও বেঁচে থাকবে।

ফিচার ইমেজ- Youtube

Related Articles

Exit mobile version