আপনার যখন হাঁপানির টান শুরু হবে, তখন নিঃশ্বাস নিতে পারবেন না। আর যখন নিঃশ্বাস নিতে পারবেন না, তখন কথাও প্রায় কিছুই বলতে পারবেন না। একটা বাক্য বলার জন্য শুধু ফুসফুসে রয়ে যাওয়া বাতাসটুকুই আপনার একমাত্র সম্বল। যেটার পরিমাণ খুব বেশি নয়। তিন থেকে ছয়টা শব্দ বলা যাবে হয়তো।
আপনি তখন শব্দের গুরুত্ব সম্পর্কে শিখতে পারবেন। আউলিয়ে থাকা মাথার ভেতর তন্ন তন্ন করে হাতড়াবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো বাছাই করবেন- ওগুলোর মূল্যও দিতে হবে আপনাকে। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরা মাথায় যা আসে, তা-ই বলে ফেলতে পারে, আস্তাকুঁড়েতে আবর্জনা ফেলার মতো করে। একজন হাঁপানি রোগীর “তোমাকে ভালবাসি,” আর “তোমাকে অসম্ভব ভালবাসি” বলার মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। পুরো একটা শব্দের পার্থক্য। একটা শব্দের গুরুত্ব অনেক কিছু। শব্দটা হতে পারত “থামো”, কিংবা “ইনহেলার”। এমনকি “অ্যাম্বুলেন্স”ও কিন্তু হতে পারত।
গল্প: অ্যাজমা অ্যাটাক; মূল: এটগার কেরেট; ভাষান্তর: কৌশিক জামান
গল্পটা পড়ে কেমন লাগছে? একধরনের ঘোরলাগা ভাব কাজ করছে না? কিংবা ভাবনার খোরাক তো জুটেছে? বাস্তবতার এক ভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয়েছেন লেখক। পাঠক মুগ্ধ হয়ে ভাবে, বাস্তবেও কি এমনটা হয়? শিল্প-সাহিত্যে এমন ঘোরলাগা ব্যাপারগুলোকে পরাবাস্তবতা বলা হয়ে থাকে।
পরাবাস্তবতা শিল্প-সাহিত্যের এক শক্তিশালী ধারা। বাস্তবতা সবার চোখে একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হয় না। বাস্তবতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আরেক বাস্তবতাকেই হয়তো পরাবাস্তবতা বলা হয়ে থাকে। পরাবাস্তবতা এমনই এক বাস্তবতা, যে বাস্তবতার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোনো মিলই নেই। আবার ক্ষেত্রবিশেষে মিল থাকতেও পারে। মনোবিজ্ঞান বলে, মানুষের মনের দুটি ভাগ আছে- চেতন আর অবচেতন। চেতন মন যে ব্যাপারটা দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, অবচেতন মন যেন তাকে কাছে টেনে নেয়। আবার, এর উল্টোটাও ঘটতে পারে। অবচেতন মনের কাজকর্ম যখন রূপকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়, তখন তাকে পরাবাস্তববাদ বলে।
১৯১৭ সালে ফরাসি লেখক গিয়োম এপোলেনেয়ার সর্বপ্রথম ‘স্যুরিয়ালিজম’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তবে এই পরাবাস্তববাদ আন্দোলনের সূত্রপাতটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণেই ঘটেছিল। কেননা, তখনকার শিল্পী সমাজ মানুষের অতিরিক্ত চিন্তার ফসল হিসেবে যুদ্ধকে দায়ী করেছিল। শিল্পীরা তাই অর্থহীন আঁকাআঁকি আর যুক্তিহীন লেখালেখি করে এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করলেন; যা প্রচলিত ধারার বিপরীত বা অ্যান্টিআর্ট। ইতিহাসে এই আন্দোলন ডাডা মুভমেন্ট বা ডাডা আন্দোলন নামে অভিহিত আর এই আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী আন্দ্রে ব্রেটন। পরে এই আন্দোলনের সঙ্গে মার্কসবাদ জড়িয়ে গেলে আন্দোলন আরো তীব্র হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২৪ সালে ব্রেটন দ্য স্যুরিয়াল ম্যানোফেস্ট গ্রন্থ প্রকাশ করে পরাবাস্তবতাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
পরাবাস্তবতার অসংখ্য উদাহরণ আমরা আমাদের জীবনযাপনের মাঝেই দেখতে পাই। লেড জ্যাপলিনের ‘স্টেয়ারওয়ে টু হেভেন’ গানটা শুনে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে স্বর্গীয় এক আবেশে। হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে এক রমণীকে খোঁজার কাহিনী শুনতে পাই আমরা জীবনানন্দের কবিতায়। স্পেনের কবি লোরকার সাথে ঘুমাতে চাই আপেলের মতো নিশ্চিন্ত এক ঘুম। শহীদুল জহিরের গল্পের মতো দুপুরবেলার কাকশূন্য এক শহর দেখতে ইচ্ছে করে আমাদের। হুমায়ূন আহমেদের গল্প পড়ে পাঠকের ইচ্ছা জাগে, একই আকাশে দুটো সূর্য কিংবা চাঁদ দেখার। হারুকি মুরাকামির গল্পে আমরা মানুষের মতো কথাবলা এক ব্যাঙের খোঁজ পাই।
অথবা জীবনের চরম অসহায়ত্ব আর অসারতাকে বুঝাতে জার্মানির কাফকার গল্পে এক সেলসম্যানকে দেখি, সকালে উঠেই যে নিজেকে এক গুবরেপোকায় আবিষ্কার করে। স্টিফেন কিংয়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য শাইনিং’-এর থিয়েটারের সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যে হারিয়ে যাই আমরা এখনো, যখন আতঙ্ক এসে ভর করে আমাদের কাঁধে।
এই পরাবাস্তব সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম এটগার কেরেট। তাকে ‘ইসরায়েলের কাফকা’ নামেও অভিহিত করা হয়। ছোট গল্প, গ্রাফিক নভেলা এবং চিত্রনাট্যের জন্য তুমুল জনপ্রিয় এই লেখকের লেখার বিষয়বস্তু পরাবাস্তববাদ। দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনাকে পরাবাস্তববাদে রূপ দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন গভীর জীবনবোধের কথা। সহজ, সাবলীল আর প্রচলিত ভাষায় লেখা তার ছোট কলেবরের গল্পগুলো বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়। পরিমিত শব্দসংখ্যা, অনন্য পরাবাস্তববাদ, সাবলীল আর প্রাঞ্জল ভাষা, সহজ শব্দচয়ন এবং সুন্দর বাক্যগঠনের মধ্য দিয়ে এটগার কেরেট বিশাল কলেবরের একটা গল্পই লেখেন নিজস্ব ঢঙে, নিজস্ব স্টাইলে; তাও একদম স্বল্প পরিসরে। আর তাই পিপলের কাইল স্মিথ এটগার কেরেট সম্পর্কে বলেন,
“অন্য লেখকেরা ৬০০ পৃষ্ঠায় যা করতে পারেন, কেরেট ৬টা অনুচ্ছেদেই তার চেয়ে বেশি করতে সক্ষম…!”
কেরেটের গল্পে স্বর্গের দূতেরা আকাশ থেকে নেমে আসে এক মধ্যদুপুরে। মিশে যায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে। মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ফিশবোল থেকে নেমে আসে গোল্ডফিশ, বাড়ির কর্তার চটি পরে হেঁটে বেড়ায় সারা বাড়িঘর। পয়সা পেটে রাখতে রাখতে জীবন্ত হয়ে ওঠে এক বালকের মাটির ব্যাংক। প্রেয়সীর চুম্বনে যেন গ্লু’র চেয়ে শক্ত কোনো আঠায় ঝুলে থাকে প্রেমিক আজীবন। নতুন রূপে পাঠক বিচ্ছেদ আর ভালোবাসার সংজ্ঞা পায়। মনস্তাত্ত্বিক দর্শন, গভীর জীবনবোধ, দৈনন্দিন জীবনের গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অপরিচিত এক জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে পাঠকের।
ইসরায়েলের ভাষায় কেরেট অর্থ শহর এবং এটগার অর্থ চ্যালেঞ্জ (মায়ের গর্ভে ছয় মাস কঠিন গর্ভাবস্থায় থাকার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে সিজারিয়ান করে তার জন্ম হয়)। তিনি নিজেই নিজেকে ‘আরবান চ্যালেঞ্জ’ বা ‘শহুরে চ্যালেঞ্জ’ বলে ব্যঙ্গ করে থাকেন। কেরেটের জন্ম ১৯৬৭ সালের সিক্স-ডে ওয়ার বা জুন ওয়ার নামে পরিচিত আরব-ইসরায়েলের যুদ্ধ চলাকালে। তার শৈশব এবং বেড়ে ওঠা রামাত গান নামক শিল্পকেন্দ্রের শহরে; পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে ইরাক এখানে তাদের স্কাড মিসাইল হামলা করে।
কেরেট তার বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। ইসরায়েলে জন্ম নেয়া প্রতিটি নাগরিকের জন্যই বাধ্যতামূলকভাবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে হয় বছর দুয়েক। আর সেই সুবাদেই কেরেটও সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। পুরোনো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক আশ্রয়কেন্দ্রের কম্পিউটারের সামনে তাকে ৪৮ ঘণ্টা টানা কাজ করতে হতো। সেখান থেকেই মূলত তার লেখালেখির যাত্রা শুরু। এমন একটা জায়গায় কেরেটকে রাখা হতো, যেখান থেকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। তাই কেরেট কল্পনার আশ্রয় নিতেন। সেই কল্পনাই পরাবাস্তবতার রূপে ফিরে আসে তার লেখায়।
তার লেখা প্রথম গল্প পাইপস; যে গল্পটা ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তার প্রথম গল্পসংকলন ‘পাইপলাইন’-এ ছিল। গল্পটা এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তির; যে কি না একটা পাইপের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। বিশ্বের কারো সাথেই তার যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই। এক রাতে আচমকা লোকটা অনেক প্যাঁচওয়ালা একটা জটিল পাইপ বানায়, যার মধ্য দিয়ে মার্বেল ছাড়ামাত্রই তা অদৃশ্য হয়ে যায়। লোকটা তখন চিন্তা করে, যদি এত বিশাল একটা পাইপ বানানো যায়, যেটা দিয়ে সে নিজে অদৃশ্য হতে পারবে!
সেই পাইপের গল্প এটগার কেরেটকে ইসরায়েলের তরুণ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং পরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয় তাকে। তার লেখা রচনা প্রকাশ পেয়েছে বিশ্বখ্যাত সব পত্রিকায়, যেমন- দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য নিউ ইয়োর্কার, দ্য প্যারিস রিভিউ, লে ম্যোন্ডে এবং জোয়েট্রাপ। তার লেখা ছোট গল্পের উপর ভিত্তি করে ৪০টিরও অধিক শর্টফিল্ম বা ক্ষুদে সিনেমা নির্মাণ করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি আমেরিকান এমটিভি পুরস্কার জিতেছে। তার উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে ২০০৬ সালে নির্মাণ করা হয় সিনেমা ‘রিস্টকাটার্স: অ্যা লাভ স্টোরি’, যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসা পায়।
তার প্রাপ্তির ঝুলিতে আছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অসংখ্য পুরস্কার; যার মধ্যে বুক পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্ল্যাটিনাম পুরস্কার, প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিনেমা পুরস্কার, জিউশ কোয়াটার্লি উইনগেট পুরস্কার, সেন্ট পিটার্সবার্গ পাবলিক লাইব্রেরির সেরা বিদেশি ভাষার প্রিয় লেখক পুরস্কার এবং দ্য নিউমান পুরস্কার অন্যতম। ২০০৭ সালে এটগার কেরেট এবং তার স্ত্রী শিরা গেফেন তাদের চলচ্চিত্র জেলিফিশ-এর জন্য কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ক্যামেরা ডি’অর বা গোল্ডেন ক্যামেরা পুরস্কার পান।
এছাড়া, তারা ফরাসি শিল্পী ও লেখক গিল্ডের সেরা পরিচালকের পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে কেরেটকে ফ্রান্সের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ফরাসি শেভালিয়ার ডেস আর্টস অ্যাট ডেস লেট্রেস ডেকোরেশনে ভূষিত করা হয়। ও’কনর শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ডে দুবার ফাইনালিস্ট হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছেন এই গুনী লেখক। আর অতি সাম্প্রতিককালে, চার্লস ব্রোনফম্যান পুরস্কার এবং আদেই উইজো পুরস্কার পেয়েছেন কেরেট। কেরেটের বই বিশ্বের ৪৫টি দেশে ৪২টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমানে তিনি ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে বসবাস করেন। অধ্যাপনা করছেন নেগেভের বেন-গুড়িয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া, তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম স্কুলের অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। তার সিনেমা ‘স্কিন ডিপ’ ইসরায়েলের অস্কার পুরস্কার জিতেছে এবং আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে বেশ কয়েকটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সম্মানিত হয়েছে।
ইসরায়েলের বিখ্যাত পত্রিকা ইয়েডিওথ আহরোনোথ তার ‘দ্য মিসিং কিসিঞ্জার’ নামক বইটিকে ইসরায়েলি সাহিত্যের সেরা পঞ্চাশটির বইয়ের তালিকায় স্থান দিয়েছে। কেরেটের প্রতিটি বই-ই বেস্টসেলার খেতাবপ্রাপ্ত এবং ৪০ হাজারের অধিক কপি বিক্রিত হয় বলে বেশ কয়েকবার বুক পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্লাটিনাম পুরস্কার জিতেছেন। ফ্রান্সের এক জরিপে দশকের সেরা ২০০টি বইয়ের তালিকায় কেরেটের ‘নেলার্স হ্যাপি ক্যাম্পার্স’ বইটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এটগার কেরেট বর্তমানে তেল আবিবের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও প্রায় সময়ই তিনি পোল্যান্ডের ওয়ার-শ তে যান। কারণ, ওখানে আছে তার আরেকটি বাড়ি; যেটিকে বাড়ি না বলে শিল্প স্থাপনাই বলা ভালো। কেরেট হাউজ নামের এই বাড়ি দুটি বহুতল ভবনের মধ্যকার ৫ ফুটের মতো ফাঁকা অংশে নির্মিত। আর তাই এই বাড়িটি পৃথিবীর সবচেয়ে পাতলা বা চিকন বাড়ি বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাড়িটি নির্মাণ করেছেন পোলিশ স্থপতি ইয়াকুব চেসনি।
পোলিশ আইন অনুযায়ী, এ স্থাপনা বসবাসের অযোগ্য তাই, একে বেশিরভাগ সময় শিল্পস্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়; তবে এটগার কেরেট মাঝেমধ্যেই এখানে আসেন, লেখালেখি করেন, কিছুটা সময় একাকিত্বে কাটান। তার মতে, এই বাসায় থাকা আর টিনের কৌটায় একটা সার্ডিন মাছের জীবন- একই কথা।
জাতীয় আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অসংখ্য পত্রিকা বহুবার এটগার কেরেটের সাক্ষাৎকার ছেপেছে। সেসব সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন নিজের জীবনের কথা, লেখালেখির শুরুর দিককার কথা এবং লেখালেখির উপজীব্য বিষয়গুলোর কথা। সেসব পত্রিকার সাক্ষাৎকার থেকে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ পাঠকদের স্বার্থে অনুবাদ করে দেয়া হলো।
কোর্টনি বেক: লেখার জগতে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, ছোটগল্প আসলে বাণিজ্যিকভাবে কখনও সফল হয় না! কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, আপনি এই প্রথাটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। তো ছোটগল্প না লেখার পরামর্শ কেমন পেয়েছেন?
এটগার কেরেট: এযাবতকালের লেখালেখির জীবনে প্রতিটা পদে পদে লোকেরা আমাকে বলেছে, ছোট গল্প লেখা বন্ধ করা উচিত আমার। উপন্যাস লেখা শুরু করা উচিত। আমার এজেন্ট, ইসরায়েলি প্রকাশক, বিদেশি প্রকাশক এবং এমনকি আমার ব্যাংক ম্যানেজার পর্যন্ত এ কথা বলেছে আমাকে। তাদের সবার এটাই মনে হয়েছে যে- এখন অবধি আমি যা লিখেছি বা করেছি, তার সবটাই ভুল। কিন্তু আমার মনে হয়, শিল্পের বিষয়ে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে সিদ্ধান্ত নেয়া, অনেকটা বিরোধিতা করার মতোই।
এর কারণ হচ্ছে আমি যখন প্রথম কলম তুলে একটা গল্প লিখেছিলাম, তখন কিন্তু তাতে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির মতো কোনো ব্যাপার ছিল না। চরিত্র গঠন, স্থান নির্বাচন বা গল্পের পটভূমি রচনা- এসব কিছু নদীর গভীরতা মাপা কিংবা থালাবাসন পরিষ্কার করার মতো বাস্তবিক কিংবা যুক্তিসম্পন্ন কোনো কাজ নয়। আমি তা-ই লিখি, যা লেখা দরকার এবং যাতে বিষয়টার আসল রূপ প্রকাশ পায়। আর সেগুলো থেকে যা বেরিয়ে আসে, তা যদি গল্প হয়- আমার লেখার প্রবৃত্তিটা তখন আরো বৃদ্ধি পায়; কারণ, সেগুলো মানুষকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে এবং কে জানে হয়তো তাদের জীবনে প্রভাবও বিস্তার করে সেগুলো।
অ্যালেক্স ক্লার্ক: আপনার গল্পে প্রায়ই অদ্ভুত আর আকার-পরিবর্তন করে এমন প্রাণীদের দেখা মেলে। শুনেছি, আপনার একটা পোষা খরগোশও আছে?
এটগার কেরেট: হ্যাঁ, সত্যিই আমার একটা পোষা খরগোশ আছে। আমার লেখা গল্পগুলো ওর ভীষণ পছন্দের। অবাক করা হলেও এটাই সত্যি যে, আমি যখন কম্পিউটারের সামনে বসে ই-মেইল বা অন্য কিছু নিয়ে কাজ করি, তখন ও আমার ধারেকাছেও আসে না। এমনকি ওকে ডেকেও আনা যায় না। কিন্তু যখনই কোনো গল্প লিখতে শুরু করি, তখনই ও আমার পায়ের কাছে এসে বসে থাকে। আর লেখা শেষ হবার আগ অবধি নড়ে না সেখান থেকে; লেখা শেষ হলে কী করে টের পায় কে জানে! তখন ঠিকই উঠে চলে যায় আবার। ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেই অনেক মজার মনে হয়।
রেবেকা সেকস: বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দেয় যে, আপনার লেখায় অনেকের প্রভাব আছে। তবে আপনার কী মনে হয়? কিংবা কার লেখা পড়ে আপনার লেখালেখিতে আগ্রহ বেড়েছে?
এটগার কেরেট: এটা তো জানেনই যে, ইসরায়েলিদের বছর দুয়েক বাধ্যতামূলক আর্মির প্রশিক্ষণ নেয়া লাগে। তখনকার সময়ে কাফকার রচনার সঙ্গে আমার পরিচয় আর প্রণয় দুটোই ঘটেছিল। মানসিক চাপে ছিলাম বলেই কি না জানি না, তবে কাফকার লেখা আমার কাছে অত্যধিক বাস্তবধর্মী মনে হয়েছিল। কাফকার অনেক রচনাই আমি পড়েছি, যা আমাকে উৎসাহিত করতো। তবে সেভাবে কখনোই নিজে কিছু লেখার কথা ভাবিনি। কিন্তু, যখন কাফকার ছোটগল্পগুলো পড়তে শুরু করলাম, আমার ভেতরে কিছু একটা আমাকে পীড়া দিল। আমার নিজেরও মনে হলো অন্তত চেষ্টা করা উচিত। এই তো।
রেবেকা: আপনার নিজের রচনা কি পরাবাস্তব? কী মনে হয় আপনার?
এটগার কেরেট: ভাবনার নিরপেক্ষতা কিংবা ভাবনাহীনতা- এই দুয়ের মধ্যেই মূলত বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতা নিহিত। কেননা, সত্য আর অসত্যের মধ্যে পার্থক্য কেবল চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমেই করা যায়। তার কারণ হচ্ছে, আমাদের বিষয়গত অভিজ্ঞতা যেমন পরাবাস্তব আর সত্যি হতে পারে; ঠিক তেমনি বাস্তব আর পুরোপুরি মিথ্যে হওয়াটাও অসম্ভব নয়। সেই অর্থে বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতা, অনেকাংশেই সত্য আর অসত্যের মতো। আমি সত্য গল্প লিখি এবং কোনোভাবেই অসত্য বা মিথ্যা কিংবা কাল্পনিক গল্প আমি লিখতে পারি না। আর একবার আমি তা লিখে ফেললে কেবল এটাই চিন্তা করি যে, সেগুলো আমাকে কেমন অনুভূতি দেয় এবং ওগুলো কি আসলেও বৈজ্ঞানিক যুক্তিসম্পন্ন কি না!
ড্যানিয়েলা হুরেজানু: ছোটবেলায় যে বইটা আমি প্রথম পড়েছিলাম, তার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। আপনার ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা একই?
এটগার কেরেট: হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা মা-বাবার সন্তান আমি। আমার মা ওয়ার-শ ঘেটোর বাসিন্দা ছিলেন আর বাবা ছিলেন রাশিয়া-পোল্যান্ডের সীমান্তে। যুদ্ধের সময় তাদের বয়স অনেক কম ছিল। পড়ার মতো কোনো বই তাদের কাছে ছিল না, তাই দাদাজি তাদেরকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে শোনাতেন। তাই, আমার বাবা-মার বংশানুক্রমে এটাই দায়িত্ব ছিল, যেন তারাও আমাদেরকে এভাবে গল্প বলে শোনান। তাদের কাছে বই পড়াটা অনেকটা ম্যাকডোনাল্ডসে বসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার মতোই ছিল। গরীবের বিলাসিতা যাকে বলে আর কি।
ড্যানিয়েলা: তাহলে কি তারা শিক্ষিত ছিলেন না?
এটগার কেরেট: অবশ্যই শিক্ষিত ছিলেন আর ভালোই শিক্ষিত ছিলেন। হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের ছিল না, কিন্তু তারা খুব পড়তেন; কারণ, বই ছিল তাদের কাছে দুর্লভ বস্তু। সেজন্য যা-ই পেতেন হাতের কাছে, তা-ই পড়ে ফেলতেন। এমনকি তারা পড়তে পড়তে কয়েকটা ভাষায় কথা বলাও শিখে নিয়েছিলেন। আমার মা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড কিংবা গালিভার’স ট্রাভেলের মতো গল্পগুলো শোনাতেন আমাদের; কিন্তু সেগুলো ছিল তার নিজস্ব সংস্করণ। আমার বাবা আবোলতাবোল গল্প বলতেন এবং সেগুলো আসলে খুব যুক্তিসম্পন্ন ছিল না। তাই, বলতে পারেন আমি বড় হয়েছি মৌখিক সাহিত্য শুনে।
তবে তিন বছর বয়সে আমার ভাই আমাকে পড়তে শিখিয়েছিল এবং পাঁচ বছর বয়সে আমি হাকলবেরি ফিন এবং টম সয়্যারের খুবই সহজ আর সাধারণ একটা সংস্করণ পড়েছিলাম। তাই, যখন আমি কথোকপথন ধরনের কিছু লিখি সেগুলো আমাকে মার্ক টোয়েনের কথা মনে করিয়ে দেয়; কেননা মার্ক টোয়েনের বই-ই আমি প্রথম পড়েছিলাম।
ড্যানিয়েলা: লোককথা বা পৌরাণিক কাহিনী কি পড়েননি তাহলে?
এটগার কেরেট: হ্যাঁ পড়েছি। গ্রিক আর রোমান মিথোলজি, ওহ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ানও। যদিও আমরা বেশ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলাম, কিন্তু তাও আমার বোন বেশ ধার্মিক হয়ে উঠেছিল সেই সময়। তার সাথে আমার মিল কম ছিল; তাই আমি হ্যাসিডিক গল্পগুলো পড়তে শুরু করেছিলাম তার সঙ্গে খাতির জমাতে। এর বেশি কিছু মনে পড়ে না ঠিক।
ড্যানিয়েলা: লেখালেখি কি ছোটগল্পেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
এটগার কেরেট: একটা নভেলা লিখেছি তো, নেলার্স হ্যাপি কেম্পার্স নামে। আত্মহত্যা করার পরের জীবনটা কেমন, তা নিয়েই মূলত গল্পটা।
গুয়ের্নিকা: আপনি তো হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা মা বাবার সন্তান। তাদের হলোকাস্টের যন্ত্রণা কি আপনাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে?
এটগার কেরেট: হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা লোকেদের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় যে, তারা খুব নিশ্চুপ এবং খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যায়। আবার, অনেকে জীবনটাকেই আর নতুন করে ভালোবাসতে পারে না, মানুষকে ফের বিশ্বাস করতে পারে না। তবে আমার বাবা-মা হলোকাস্টের সময় ছোট ছিলেন। আর তাছাড়া আমার বাবা বেশ আশাবাদী একজন মানুষ। তিনি সবসময়ই বলতেন,
“আমার শৈশব ছিল প্রচণ্ড ভয়ানক, তবে আমি আশা করতাম সামনে আরও ভালো দিন আসবে এবং এখনো সেই একই আশা করি আমি।”
তবে আমার মা অনেক বেশিই যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। কেননা, চোখের সামনেই মাকে তার ভাইয়ের মৃত্যু দেখতে হয়েছে। সাত বছর বয়স থেকেই আমার মা নিজেকে রক্ষা করার উপায়গুলো খুঁজে নিয়েছিলেন। তবে তারা কখনোই আমাদের সাথে এমন কোনো আচরণ করেননি, যাতে আমরা কষ্ট পাই কিংবা বুঝতে পারি যে, তারা খুব যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে। তবে তাদের ভেতরের ক্ষতটা কেন জানি টের পেতাম আমরা। আর হয়তো এই ব্যাপারটাই আমাকে লিখতে সাহায্য করেছে বা এখনো করে।
গুয়ের্নিকা: আচ্ছা, অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো। কখনো এমন কোনো চরিত্র তৈরি করেছেন নিজের লেখায়, যে কি না খুবই খারাপ বা অশুভ?
এটগার কেরেট: প্রথমত, আমি বিশ্বাসই করি না যে, এরকম কোনো লোকের অস্তিত্ব আছে। আর ঘৃণা কোনো আদিম প্রবৃত্তিও নয়; আপনি প্রকৃতিতে এমন কোনো উপাদান খুঁজে পাবেন না, অন্তত আমি তা-ই বিশ্বাস করি। এটা আসলে ভয়ের একধরনের বিকৃত রূপ। লোকেরা ভয়ানক কাজ করে বসে এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে আর তারপরে তা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলে। তবে পাশাপাশি এ ধারণাও রাখি যে, কিছু লোক আছে যারা পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ায় নিজেকে স্টার ওয়ার্সের ডার্থ ভেডার ভেবে…
গুয়ের্নিকা: তাহলে আপনার দৃষ্টিতে খারাপ বা অশুভের সংজ্ঞা কী?
এটগার কেরেট: নাহ আমি আসলে এটা বলিনি যে, খারাপ মানুষের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে নেই। তবে লেখালেখি হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার, যেখানে উন্মত্ততার কোনো জায়গা নেই। একমাত্র লেখালেখিই হচ্ছে এমন একটা জায়গা, যেখানে আমরা কেবল মানুষ হবার চেষ্টা করতে পারি। আমার মনে হয়, আমি এমন কিছু শিল্পীকে চিনি, যারা আসলে অসামাজিক কাজকর্ম করে। যখন আমি এ ধরনের কাজ দেখি, তখন ভাবি যে, তারা আসলে কতটা বুদ্ধিমান! কেননা, মানুষকে গাধা বলার জন্য কিংবা প্রমাণ করার জন্যে আমার মতে শিল্পের কোনো দরকার নেই। রাস্তায় দু’দণ্ড ঘুরে বেড়ালেই বোঝা যায় তা।
গুয়ের্নিকা: আপনারও কি রাইটার্স ব্লক হয়?
এটগার কেরেট: ‘রাইটার্স ব্লক’ বলতে যে অনুভূতির কথা আপনারা বুঝিয়ে থাকেন, সে অনুভূতিটাকেই প্রকাশ করাটা আসলে আমার বিশেষ পছন্দের। কেননা ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, আপনি আগেভাগেই মেনে নিয়েছেন আপনার এ ধরনের একটা সমস্যা হচ্ছে বা হবে। এছাড়া অন্য কোনোভাবেই ব্যাপারটাকে আমি মানতে পারি না। আমার মতে, যখন আপনি লিখবেন সেই সময়টাকে তাহলে ‘রাইটিং স্প্রি’ বলা উচিত আপনার। আমি প্রতিদিনও লিখি না আবার প্রতিনিয়তও লিখি না। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলেও সত্যি যে, আমি কেবল গল্পগুলোর কথা চিন্তা করি; যেগুলো আসলে আমার চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তাই তারাই বুদ্ধি খাটিয়ে আমাকে দিয়ে সময় করে লিখিয়ে নেয় বলতে পারেন।
অ্যালিস ও’ক্যাফে: ফিকশন মানে গল্প লিখে কেমন আনন্দ পান? নাকি শুধু লেখার জন্য লেখেন?
এটগার কেরেট: কী বলেন? আমি তো মনে করি এবং বিশ্বাসও করি যে, পৃথিবীর অন্যতম মজার কাজ হচ্ছে গল্প লেখা। কথাসাহিত্য আমার সবচাইতে স্বাচ্ছন্দ্যের একটা জায়গা। একজন মানুষ- হোক সে পাঠক কিংবা লেখক, নিজেকে পূর্ণভাবে মেলে ধরতে পারে কেবল এই একটা জায়গাতেই। যদিও শিল্পের প্রতিটা ক্ষেত্রেই তা বিদ্যমান। আসলে ফিকশন বা গল্প হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার, ধরুন আপনি ট্রেনে করে যাচ্ছেন কোথাও। একজন অপরিচিতের সঙ্গে দেখা হলে তাকে আপনি যে গল্পটা বলতে পারবেন, সেই একই গল্প কিন্তু আপনি আপনার আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীদের বলতে পারবেন না।
যদি বলেও ফেলেন তাতেও অনেকটা অস্বস্তি রয়ে যাবে আপনার। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিন্তু আপনি নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন। কে জানে, হয়তো আর কখনো দেখাই হবে না তার সঙ্গে আপনার। কিন্তু প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়রা তো প্রতিনিয়তই আপনাকে দেখছে। তাই, আমার পাঠক কে তা কখনোই জানতে চাই না আমি; কারণ, সে অপরিচিত একজন আমার কাছে।
অ্যালিস ও’ক্যাফে: ভিন্ন কিছু বলুন?
এটগার কেরেট: ভিন্ন! আমাদের জীবনটাই তো ভিন্ন কিছু। ইদানিং একটা শিলাখণ্ড আর নিজের মধ্যে তেমন কোনো তফাত খুঁজে পাই না আমি। আমার বাবা হলোকাস্টের সময় প্রায় ৬০০ দিন একটা মাটির গর্তে কাটিয়েছেন। আর আমার মা, তিনি তো সেই ছোট বয়স থেকেই নিজের পরিবারের সবার মৃত্যু স্বচক্ষে দেখে বড় হয়েছেন। ছোটবেলায় আমি স্কুলে না গিয়ে বাসায় থাকলেই তারা বেশি খুশি হতেন; কেননা যেকোনো পাবলিক প্লেসের চাইতে বাসায় থাকাটা তখন অনেকাংশে নিরাপদ ছিল। অন্তত বোমার আঘাতে তাদের সন্তানের মৃত্যুভয় থেকে তারা মুক্ত থাকতেন। আমার শৈশব আট-দশটা ছেলে-মেয়ের মতো ছিল না; তাই খুব ছোট বয়সেই ‘ভিন্ন’ শব্দের অর্থটা খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলাম।
গত বছর গ্রীষ্মের সময়ে আমি ইসরায়েলে ছিলাম। আমার জীবনের মতোই ইসরায়েল নামটার সঙ্গেও যুদ্ধ ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। স্বচক্ষে দেখলাম সে যুদ্ধ। আমি তো নিজেকে প্রতিবাদী মানুষ মনে করি না, আমি কেবল লিখতে জানি। তাই লিখলাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে, গাজায় সংগঠিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে, এমনকি ন্যায়ের পক্ষেও। সেজন্যে নিজের এবং পরিবারের সকলের মৃত্যু হুমকিও পেলাম অসংখ্যবার, তা-ও নিজের দেশে থাকা অবস্থায়ই। আমার দেশের লোকেরাই কলম ধরার অপরাধে রাজাকার* উপাধি দিল আমাকে। মনগড়া গল্প না বলে সত্য বলেছি, এটাই আমার দোষ। শুধু কি তা-ই? যখনই আমি বিদেশ-বিভূঁইয়ে যাই, আমাকে শুনতে হয়-
“তুমি একজন শিশু হত্যাকারী, তোমার হাত নিষ্পাপ লোকেদের রক্তে রঞ্জিত; আদতে তুমি একজন খুনী। আপনি কি এর চাইতেও ভিন্ন কিছু শুনতে চান?”
স্বদেশীরা আমাকে বয়কট করেছে, কারণ আমি একজন বিশ্বাসঘাতক, আর বিদেশিরা আমাকে বয়কট করেছে, কারণ আমি একজন ইসরায়েলি লেখক।
টীকা:
*রাজাকার = লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘রাজাকার’ শব্দটি আসলে ফার্সি; এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবী। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের পক্ষে যেসব বাঙালি ছিলেন, তাদেরকে নিয়ে একটা স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা হয়, যাদের নাম দেয়া হয় রাজাকার বাহিনী। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য স্বেচ্ছাসেবী অর্থে ব্যবহৃত এই রাজাকার শব্দটাই প্রবল ঘৃণা প্রকাশ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বাংলাদেশে।
উপরিউক্ত স্থানে বিশ্বাসঘাতক কিংবা দেশদ্রোহী শব্দের পরিবর্তে লেখকের চরম অপমানিত বোধটাকে ফুটিয়ে তুলতেই উক্ত শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।