বইয়ের রাজ্যে এ যেন এক অন্য জগতঃ বার্নস এন্ড নোবেল

‘বই’- আজকাল শব্দটি খুব যেন পাঠ্যপুস্তক ঘেঁষা হয়ে গেছে। ইন্টারনেট আর ভিডিও গেমস্ এর বদৌলতে পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। কারও মাঝে এখন সময়ই বা কোথায় হাত পা ছড়িয়ে বই নিয়ে বসার? এর চাইতে বরং ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করা বা কমেন্টগুলো পড়া আরও বেশি জরুরি।

বলাই বাহুল্য, বর্তমান সমাজে চলতে গেল এই সবকিছুর প্রয়োজন প্রশ্নাতীত। তথাপি আমরা অনুকরণ অনুরাগীও তো কম নয়। সমাজের চাল বলে কথা, বেচাল হলে হয় কীভাবে? তাই ভাসিয়ে দাও নোঙর, দাঁড় ঐ মাঝিই বয়ে নিয়ে যাবে, সে যেদিকেই যাক না কেন! এ সবকিছু একটু অভিমানের কথা বটে, তবে এই অভিমান শুধু আমাদের নয়, সকল সুস্থমনা সাহিত্য, শিল্প-অনুরাগীদের। নতুনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে আমরা বড্ড বেশি ব্যস্ত। পিছে ফিরে তাকাবার সময় তো নেই। অথচ অবাক হলেও সত্য যে, পাশ্চাত্যে এখনও বই পড়া লোকের কমতি নেই বললেই চলে। ট্রেনে, বাসে বা যেকোনো যানবাহনে হাতে তাদের বই দেখা খুব একটা অবাক করা বিষয় নয়। অথচ আমাদের দেশে বই হাতে কাউকে দেখলেই সে আঁতেল শ্রেণীর জীব হতে বাধ্য।

ট্রেনে পড়ুয়ারত কিছু লোক

ট্রেনে পড়ুয়ারত কিছু লোক

আমাদের সব বই কেনার হিড়িক যেন ফেব্রুয়ারির বই মেলার জন্যই তোলা থাকে। সারা বছর আর বইয়ের দোকানের আশে পাশে ঘেঁষাও যেন বিশাল অপারগতা। বই উপহারের অন্যতম মাধ্যম বলে ধারণা করা হলেও এখন তা নিন্দুকের টিপ্পনি শোনার শামিল। তাই আজকাল অমুখো কেউ হয় বলে মনে হয় না। এসবের ঠিক উল্টো এক চিত্র দেখা যায় সুদূর আমেরিকায় এক বর্ণাঢ্য বইয়ের দোকান ‘বার্নস এন্ড নোবেল’-এ। আমেরিকায় সব চাইতে জনপ্রিয় বইয়ের এই দোকানটি ১৮৮৬ সালে যাত্রা শুরু করে নিউইয়র্কের কুপার ইউনিয়ন বিল্ডিং থেকে। তারপর থেকে এটি ছড়িয়ে পরে পুরো আমেরিকা শহরে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এই কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ৬৩৮টি দোকান পরিচালনা করা হয়। শুনতে খানিকটা কানে বাঁধছে ঠিকই। কী করে এতগুলো শাখা শুধু বই বিক্রয় করে চলছে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। বৈষয়িক জ্ঞান আর প্রজ্ঞা থাকলে যে যেকোনো অসাধ্য সাধন করা যায় তা বার্নস এন্ড নোবেল থেকে শেখা যায়।

বার্নেস এন্ড নোবেল এর একটি শাখার সামনের চিত্র

বার্নস এন্ড নোবেল-এর একটি শাখার সামনের চিত্র

তাহলে এবার চলুন এর ভেতরটা দেখা যাক। বোঝা যাক কেন এত জমজমাট বইয়ের এ দোকান? উত্তরটা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। চাহিদা এবং যোগানের সামঞ্জস্যতা মাত্র। এখানে আছে সাজানো-গোছানো সংস্কৃতি চেতনা যা যেকোনো পাঠককেই সম্মোহিতের মতো ডেকে নিয়ে যায় বই ঘরে। আর একবার ঢোকাতে পারলেই কেল্লাফতে, পাঠককে নিয়ে গেল এক নতুন জগতে, যেখানে অবারিত দ্বার আছে মুক্ত বিচরণ করার।

থরে থরে সাজানো বিভিন্ন স্বাদের বই। বিষয় ভিত্তিতে বইয়ের তাক আলাদা। যার যে শাখা পছন্দ, সেখান থেকে পছন্দসই বই নিয়ে শুরু করে দাও পড়া। কেউ পিছে এসে দাঁড়িয়ে বলবে না “কী ব্যাপার? বই পড়ছেন যে বড়? আগে কিনুন তারপর পড়ুন।” না, এসব কিছুই হবে না। এ যেন জ্ঞানের চারণভূমি। চাষ কর যত পার। কেউ বাঁধা দেয়ার নেই, মানা করার নেই। শুনতে কিছুটা অবাক শোনায় বৈকি! কিন্তু এর পেছনেই লুকিয়ে আছে সুনির্দিষ্ট এবং প্রশংসনীয় ব্যবসায়িক মনোভাব।

সব পাঠকই যে সারাদিন ধরে বসে সে বই পড়বে তা কিন্তু নয়। যার বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই ভাল লেগে যাবে, সে বইটি কিনে নিবেন তার পড়ার জন্য এবং সংগ্রহের জন্য। বই কেনার মনোভাব ও তাদের বেজায়। আর কেউ যদি বার্নস এন্ড নোবেলে বসে পুরো বইটি পড়তে চান, তার জন্য কোনো প্রকার মানা নেই। কিন্তু শুধু বসে বসে তো আর বই পড়া যায় না। সাথে এক কাপ কফি হলে বেশ হয়। আছে স্টার বাকসের সুস্বাদু কফি। সেই কফিও কি আর এক কাপে হয়? তাহলেই ভাবুন ব্যবসায়িক চিন্তা-ভাবনাটা কোথায়। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মাঝে সাঝে জমজমাট আড্ডা যে গড়ে ওঠে না তা কিন্তু নয়। সেটাও তো উপভোগ্য।

বার্নেস এন্ড নোবেল এর কফিশপ

বার্নস এন্ড নোবেল এর কফিশপ

বাচ্চাদের জন্য আছে পৃথক বিভাগ যেখানে আছে বই, খাতা, কলম, কার্টুন, খেলনা এই ধরনের আকর্ষণীয় জিনিসপত্র। বাচ্চারাও খুশি মনে ঘুরতে থাকে, আর একটু পর পর বায়না করতে থাকে তার পছন্দমতো জিনিস কেনার। আছে হরেক ধরনের পুতুল যেগুলো জড়িয়ে ছোট বাচ্চারা বসে থাকে আর খেলা করে। ওদিকে তার মা-বাবা দিব্বি পছন্দের বইটি নিয়ে পড়া শুরু করে দিয়েছেন। টানা বই পড়তে পড়তে কারও যদি এক ঘেয়েমি চলে আসে, তবে আছে শৌখিন জিনিসপত্র নেড়ে চেড়ে দেখার সুযোগ। বই খুঁজে পাওয়ার জন্য সাজানো কম্পিউটার রয়েছে, যাতে পছন্দসই বইয়ের নাম দেয়ার সাথে সাথে তার উপস্থিত জায়গা সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়।

বার্নেস এন্ড নোবেল এর ভেতরকার চিত্র

বার্নস এন্ড নোবেল এর ভেতরকার চিত্র

বার্নস এন্ড নোবেলের চেষ্টা বই কীভাবে বিক্রি করা যায় তা নয়, বরঞ্চ কীভাবে বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানো যায়। এই আগ্রহের প্রতি লক্ষ্য রেখেই দোকানটি এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন থিমের বই এখানে পাওয়া যায়। ছোট গল্প থেকে রান্নার গল্প, ভ্রমণ কাহিনী থেকে কবিতার বই, কী নেই এখানে? বিভিন্ন বয়সের মানুষজন ভিড় করে এই দোকানে। তবে কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। আমাদের দেশের বিচারে খানিকটা অবাকই ঠেকে বৈকি।

বার্নস এন্ড নোবেল এর বাইরে রাতের দৃশ্য

বার্নস এন্ড নোবেল এর বাইরে রাতের দৃশ্য

নিউইয়র্কভিত্তিক হেড কোয়ার্টার বার্নস এন্ড নোবেলের। যখন তারা প্রথম নিউইয়র্কে যাত্রা শুরু করে, তখন কে ভেবেছিল এটি সারা আমেরিকায় এতো সাড়া ফেলবে? বর্তমানে প্রতিটি ছোট বড় অঞ্চলে একটি করে বার্নস এন্ড নোবেলের দোকান আছে। ‘বি অ্যান্ড এন’ নামে এই বিখ্যাত দোকানের একটি ওয়েবসাইট আছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই ওয়েবসাইট থেকেও বেশ ভালোভাবেই বিক্রি হচ্ছে। ইন্টারনেট এর মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে বিভিন্ন স্বাদের বই। এই ধরনের সেবাও পাঠকের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করছে।

বার্নেস এন্ড নোবেল এর ওয়েবসাইট

বার্নস এন্ড নোবেল এর ওয়েবসাইট

বার্নস এন্ড নোবেলে প্রায়ই বিখ্যাত কবি-সাহিত্যকদের বই প্রকাশনা অনুষ্ঠান করা হয়। এতে পাঠকদের সাথে সরাসরি লেখকের ভাবের আদান প্রদান ঘটে। লেখকরা তাদের পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন, আবার তাদের বই এ স্বাক্ষরও দিয়ে দেন। মাঝে মাঝে অনেক লেখক তাদের লেখা পাঠকদের মাঝে পড়ে শোনান। এ যেন লেখক আর পাঠকের অন্যতম সেতুবন্ধন। এর আবেগ ও দাবি যেন চিরন্তন। অনেক সময় লেখার ওয়ার্কশপও হয়ে থাকে। তখন খ্যাত-অখ্যাত সব ধরনের লেখকদের আমন্ত্রণ করা হয়।

পাঠকদের সমাবেশে মুখর “বার্নস এন্ড নোবেল” এর চত্বর

পাঠকদের সমাবেশে মুখর বার্নস এন্ড নোবেলের চত্বর

শুধু বিদেশের কথায় বলছি কেন? বার্নস এন্ড নোবেল এর মতো প্রচেষ্টা বাংলাদেশেও যে নেই তা কিন্তু নয়। এই ধরনের একটি প্রচেস্টা শুরু করেছে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেট এর বিপরীত পাশে অবস্থিত ‘পাঠক সমাবেশ’। এখানেও বিভিন্ন স্বাদের বই এর গোছানো প্রতিফলন যে কারো নজর কাড়ে। আছে বসে পড়ার সুব্যবস্থাও। কিন্তু আমরা কয়জনই বা এর খবর রাখি?

এই ধরনের প্রচেষ্টার আরেকটি উদাহরন হল চট্টগ্রামের প্রেস ক্লাব ভবনে অবস্থিত ‘বাতিঘর’। স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর ভিড় রয়েছে এই দোকানে। খুব বড় পরিসরে না হলেও তারাও চেষ্টা করছে পাঠকশ্রেণী বৃদ্ধি করার। বর্তমানের এই পোড়-খাওয়া সংস্কৃতি আর পরিবেশ থেকে উত্তরণের আর যে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

 

 

The above article is about a popular bookshop in NewYork called 'Barnes &Noble'.

References:

1) en.wikipedia.org/wiki/Barnes_%26_Noble
2) barnesandnoble.com/
3) barnesandnobleinc.com/

Featured image: theodysseyonline.com

Related Articles

Exit mobile version