নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যু: কলকাতার যিশুর কবি রোদ্দুর হয়ে থাকুন আকাশে

গত মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পরলোকগমন করেছেন। ৯৪ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। বয়সের কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই অসুখে ভুগছিলেন। বেসরকারি এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, সেখানেই মঙ্গলবার ১২টা ১৫ মিনিটে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি না ফেরার দেশে।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শুধু কবিই ছিলেন না, কবিতা জিনিসটা তাঁর রক্তে ছিল। তিনি বলতেন, কবিতাই হলো তাঁর মাতৃভাষা।

এমন কাউকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শব্দের পর শব্দ বসানো বেশ দুরূহ কাজ। একজন কবি বেঁচে থাকেন কবিতার মাঝে। তাঁকে অনুভব করার জন্য কবিতার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?

তাঁর সাথে আমার পরিচয়ের গল্পটা বলি।

বাঙালী হয়েছে জন্মেছে, অথচ দু-চার লাইন কবিতা লেখেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তখন কেবল অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি। এক-আধটু সন্ধি-সমাস ছাড়া ভাষার ব্যাকরণের আর কিছু বুঝি না। কিন্তু কবিতা লেখার খুব শখ, লুকিয়ে এক-দু’লাইন মাঝে মাঝে লিখেও ফেলি। পড়তাম সাভারের এক আবাসিক মাদরাসায়। বন্ধুবান্ধব ওসব টুকটাক চেষ্টা নিয়ে কত যে হাসাহাসি করেছে! আমার বাংলা শিক্ষকের নাম লুৎফর রহমান। তিনিও কেমন করে যেন জেনে গেলেন, আমার কবিতায় আগ্রহ। একদিন ডেকে নিয়ে একটি বই ধরিয়ে দিলেন হাতে। ‘কবিতার ক্লাস’, লেখক: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

কবিতার ক্লাস; Image Source: Writer

তখনো ছন্দ, অন্ত্যমিল- এসব কী জিনিস বা এদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়, সে সবের কিছুই বুঝি না। কিন্তু বোঝার খুব আগ্রহ ছিল। মনে হতো, জীবনে এক-দুটো কবিতা অন্তত না লিখতে পারলে বাঙালী জীবনই তো বৃথা! আর কবিতার মধ্যে ছন্দ থাকে, কাজেই সেটা শিখতেও হবে সেভাবে। কবিতার ক্লাসে ঢুকে অদ্ভুত এক কথা পড়লাম। কবি লিখেছেন,

ছন্দ আছে সর্বত্র। চোখের সামনে আমরা যা কিছু দেখি, যা কিছু শুনি, তার সব কিছুতেই- সমস্ত চলায়, সমস্ত বলায়, সব রকমের কাজে কিংবা অকাজে ছন্দ রয়েছে। ছন্দ মানে ঢং কিংবা ডৌল কিংবা রীতি।

ছন্দ কেবল নেই কবিতায়, মানে আগে থেকে থাকে না। সেটা আনতে হয়। মুখে আমরা যেসব কথা বলি, তাকে যদি কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারতুম, মুখের কথাও তাহলে কবিতা হয়ে উঠত।

সত্যি বলতে, বইটি পড়ে আমি বিশাল কোনো কবি হয়ে যাইনি। কিন্তু পড়তে পড়তে কবিতা জিনিসটা আমার মাথায় ঢুকে গেল। দিন-রাত কবিতা পড়তাম, আবৃত্তি করতাম মনে মনে। কবিতা নিয়ে আমার মধ্যে প্রচন্ডরকম পাগলামী তৈরি হলো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা, সিনেমা দেখতে দেখতে ভালো পরিচালক না হয়ে উঠলেও ভালো দর্শক হয়ে ওঠা যায়। কানে শুনে, চোখে দেখে অনুভব করা যায় ভেতরের রসটুকু। তেমনি, হিসবে নিকেষ করে কবিতার ছন্দ সেভাবে বোঝা যায় না, বুঝতে হয় কানে শুনে, কানের হিসেবে। বইটি পড়ে অনেক ভালো না হলেও, কেমন করে যেন কবিতা জিনিসটাকে অনুভব করতে শিখে গিয়েছিলাম কিছুটা হলেও।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী; Image Source: anandabazar.com

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এক বাচ্চা ছেলের জীবনে কীভাবে কবিতার পাগলামি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, সে কথা বলছিলাম এতক্ষণ। সত্যি বলতে, এই মানুষটি বাংলাদেশ থেকে কলকাতা, সবখানেই অনেক অনেক মানুষের মনেই এই পাগলামী ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘অমল কান্তি’র কয়েকটি লাইন তুলে দেয়া যাক,

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম
কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সেসব কিছুই হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!

মানুষটির জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর, বাংলাদেশের ফরিদপুরে। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে ১৯৩০ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন কলকাতায়। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার তথ্যমতে, ১৯৫১ সালে তিনি পত্রিকাটিতে যোগ দেন এবং দীর্ঘদিন ‘আনন্দমেলা’ সম্পাদনা করেছেন। ৩০ বছর বয়সে, ১৯৫৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’ প্রকাশিত হয়। এরপর খালি লিখে যাওয়া। অনেক বলতেন কথাটা, কবিতাই ছিল তাঁর মাতৃভাষা। অবশ্য পত্রিকায় কাজ করার ফলে মাঝে মাঝে গল্পও লিখেছেন। তাঁর নিজের ভাষ্যমতে, “কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।” তিনি মনে করতেন, কবিতা রচনায় তাঁর তেমন কল্পনার জোর নেই! একবার বলেছিলেন,

কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা।

Image Source: News18 Bengali

বিখ্যাত কবিতা ‘কলকাতার যিশু’ প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেছিলেন,

একবার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে রাস্তার উল্টো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।

কলকাতার যিশু কবিতাটির কিছু অংশ তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না,

স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।

আর, আমাদের জন্য তাঁর যে কবিতাটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক, তা হলো ‘উলঙ্গ রাজা’। উলঙ্গ রাজার গল্পটি আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। তা-ও, ছোট্ট করে গল্পটা বলে নেয়া যাক।

এক রাজা দর্জিকে কাপড় বানিয়ে দিতে বলেছেন। দর্জি খালি হাতে এসে রাজাকে বলেছে, “এই নিন কাপড়। যে এ কাপড় দেখতে পায় না, বুঝতে হবে, সে মহাবোকা!” রাজা কিছু না দেখতে পেলেও বোকা হতে রাজি ছিলেন না। কাজেই, সব জামাকাপড় খুলে কিছু না পরেই উলঙ্গ অবস্থায় নেমে পড়লেন রাস্তায়। ভয়েই হোক আর চাটুকারিতা স্বভাবের জন্যেই হোক, সবাই রাজাকে বলছিল, “দারুণ, দারুণ! শাবাশ!

Image Source: Barta24

কবি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেন, সেই গল্পে এক শিশুও ছিল, সত্যবাদী সরল এক শিশু। যে রাজার মুখের উপর বলে বসেছিল, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?

কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।
শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?

এই কবিতাটি অসম্ভব শক্তিমান। কারণ, শিশুটি হারিয়ে গেলেও কবিতা সেখানে শেষ হয়ে যায় না। কবি আমাদেরকে সেই শিশুর খোঁজ করতে বলেন। বলেন,

সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

সেই শিশুটিকে আমাদেরও বড় দরকার।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শুধু কবি বা গল্পকারই ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং ভ্রমণ-কাহিনির লেখক। লেখালেখি ছিল তাঁর জীবন। এই মানুষটির নতুন কোনো লেখা আর পড়তে পারবো না আমরা, বিশ্বাস হতে চায় না সেটা।

অমল কান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পারেনি। আমাদের সমস্তটুকু ঘিরে যে প্রলয় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, প্রিয় কবি, আপনি অন্তত আমাদের মাথার উপরে, আকাশের নীল নির্জনে রোদ্দুর হয়ে থাকুন।

This article is in Bangla language. It is a tribute to poet Nirendranath Chakravarty, who died recently. Necessary references have been mentioned below.

References:

[1] Ulongo Raza by Nirendranath Chakravarty

[2] Kobitar Class by Nirendranath Chakravarty

Featured Image: abpananda.abplive.in

Related Articles

Exit mobile version